এস কে সুর চৌধুরী ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব স্থগিত

আগের সংবাদ

রূপগঞ্জে হতাহত বেড়েছে চার কারণে : ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার, আহত শতাধিক, এখনো নিখোঁজ ৫১ জন

পরের সংবাদ

রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও অন্যান্য

প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অ রুণ দাশগুপ্তের রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও অন্যান্য বইটি আমাদের রবীন্দ্রসংগীতের সেই সীমাহীন সুন্দর ভুবনে নিয়ে যাওয়ার পথপ্রদর্শী এক অমূল্য গ্রন্থ। তার এই গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধে রবীন্দ্রসংগীতের অন্তহীন সৌন্দর্যের সন্ধান দিয়ে তার বৈশিষ্ট্য কোথায়, কীভাবে তা ভারতীয় সংগীতকে বিশ্ব-সংগীতের আসরে নিয়ে গেছে, কীভাবে তা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই সুরধারার সম্মিলন ঘটিয়ে এক নতুন আধুনিক সুরধারার সৃষ্টি করেছে- যা আধুনিক হলেও ভারতীয় মার্গ সংগীতের ঐতিহ্যেই প্রোথিত- তা অত্যন্ত গভীরভাবে কিন্তু সরল ভাষায় তিনি ব্যাখা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের সংগীতে ভারতীয় সংগীত ও বিশ্ব-সংগীতের বিভিন্ন ধারা ও ¯্রােতের এক অপূর্ব মিলন ঘটেছে এবং এই মিলন এক সীমাহীন অতলান্ত সুর-সমুদ্রের সৃষ্টি করেছে যা অমৃত পিপাসু মানুষের তৃষ্ণা মেটাবার এক অসামান্য উৎস। ব্যাখ্যা করে আরো দেখানো হয়েছে, অষ্টাদশ শতকে বাঙালি তার ঐশ্বর্যমণ্ডিত সঙ্গীত ঐতিহ্য- যার মূলে রয়েছে চর্যাপদ, পদাবলী কীর্তন, লোকসংগীত, বাউল ও রামপোসাদী ইত্যাদি- তা থেকে পথ হারিয়ে খেউর, হাফ আখরাই, তর্জা, পক্ষীগান ইত্যাদি রুচি বিগর্হিত চটুল ও লঘু গানে বিভোর হয়েছিল। এর কারণ তিনি খুঁজে পেয়েছেন অষ্টাদশ শতকের রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটে।
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে বাংলাদেশে যখন ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সে সময় বাঙালির সামাজিক অবক্ষয় চূড়ান্তে পৌঁছেছিল। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে সতীদাহ, পর্দাপ্রথা ও বাল্যবিবাহের ব্যাপক প্রসার হয়েছিল; সার্বিকভাবে শিক্ষা ও সংস্কৃতির চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা দখলের পর অর্ধশতাব্দী মুখ্যত লুণ্ঠনেই ব্যস্ত ছিল। ইংরেজ শাসনের অভিঘাত হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইংরেজি শিক্ষাপুষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে উন্মেষ তা তখনো ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথ অষ্টাদশ শতকের শেষে ও ঊনবিংশ শতকের প্রথম বাঙালি সমাজে রামমোহনের অবদান উল্লেখ করতে গিয়ে তাঁর ‘চরিত্রপূজা’ গ্রন্থে এই কালটিকে বর্ণনা করেছেন এই ভাবে, ‘তখন চারিদিকে মৃত্যু বিরাজ করিতেছিল’।
বাঙালির সামাজিক অবক্ষয় ও সংগীত ঐশ্বর্যের এই বিপর্যয়ের সময়ে অরুণ দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন নতুন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ক্ষুদ্র এক সংগীত সাধক গোষ্ঠী; এদের মধ্যে রয়েছেন সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় ও যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। এদেরই যৌথ প্রয়াসে বাঙালি সংগীতে এক নতুন স্বরলিপির সৃষ্টি করে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শৈশবে ও কৈশোরে যদুভট্ট প্রমুখ মার্গ সংগীতের শিক্ষক ও মেজ ভাই যতীন্দ্রনাথের কাছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় সংগীতের শিক্ষা পেয়েছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পরেই তিনি লেখেন বাল্মীকির প্রতিভা। ইংল্যান্ডে যেয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ইউরোপীয় সংগীতের সঙ্গে ভারতীয় সংগীতের একটা মৌল পার্থক্য রয়েছে। তাঁর ভাষায়; ‘আমাদের দেশে গান সাধাটাই মুখ্য, সেই গানেই আমাদের যতটুকু দুরূহতা; ইউরোপে গলা সাধাটাই মুখ্য, সেই গলার স্বরে তাঁহারা অসাধ্য সাধন করেন। আমাদের দেশে যাহারা প্রকৃত শ্রোতা তাহারা গানটাকে শুনিলেই সন্তুষ্ট থাকেন। ইউরোপের শ্রোতারা গান গাওয়াটাকে শোনে’। দুই সংগীত ধারার বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ইউরোপের সংগীত যেন মানুষ বাস্তব জীবনের সঙ্গে বিচিত্রভাবে জড়িত। তাই দেখিতে পাই, সকল রকমের ঘটনা ও বর্ণনা আশ্রয় করিয়া ইউরোপে গানের সুর খাটানো চলে। আমাদের গান যেন জীবনের প্রতিদিনের বেষ্টন অতিক্রম করিয়া যায়, এজন্য তাহার মধ্যে এত করুণা এবং বৈরাগ্য- সে যেন বিশ্ব-প্রকৃতি ও মানব হৃদয়ের একটি অন্তরতর ও অনির্বচনীয় রহস্যের রূপটিকে দেখাইয়া দেবার জন্য নিযুক্ত; সেই রহস্যলোক বড়ো নিভৃত, নির্জন, গভীর; সেখানে ভোগরি আরামকুঞ্জ ও ভক্তের তপোবন রচিত আছে, কিন্তু সেখানে কর্মনিরত সংসারীর জন্য কোনো প্রকার সুব্যবস্থা নেই।
রবীন্দ্রনাথ যে দু’হাজারের বেশি গান লিখেছেন তার একটা বড় অংশই প্রকৃতিকে নিয়ে। উপমহাদেশের সাহিত্যে, সংগীতে প্রকৃতি সবসময়ই প্রবলভাবে রয়েছে যা আমরা গ্রিক ও রোমের সাহিত্যে দেখি না। পাশ্চাত্যে প্রকৃতি বন্দনা শুরু হয়েছে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে রোম্যান্টিক মুভমেন্টের সূচনা থেকে। কিন্তু এই উপমহাদেশে তা অতি প্রাচীন। ‘বাল্মীকির রামায়ণে’ আমরা বর্ষার অপরূপ বর্ণনা পাই এই বাণী- ‘ গর্জন্তি মেঘা সমুদীর্ণ নাদা মত্তা গজেন্দ্র ইব’ অর্থাৎ ‘মেঘ গর্জন হচ্ছে যেন মর্ত হাতি গর্জন করছে। কালিদাসও তার প্রথম জীবনের ষড়ঋতু নিয়ে ‘ঋতু সংহার’ লিখেছেন। সেখানে রয়েছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শিশির (শীত) ও বসন্ত কালের কথা। বাঙালি কবি জয়দেবও বর্ষাকে অপরূপভাবে বর্ণনা করেছেন- ‘মেঘৈমেদর্েুরম্বরম’ মেঘে মেদুর আকাশ- এই বলে। বিদ্যাপতির বর্ণনায় বিরহ যেন মর্ত হয়ে উঠেছে ভরা ভাদ্রে, ‘ই-ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’। এই বর্ণনা রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও কবিতা সীমাহীন সুন্দর। সুর বাণীতে এবং বাণী সুরে মিলেমিশে আমাদের দু’চোখে-দেখা বিভিন্ন ঋতুর দিনগুলো অন্তরের চোখে ও কানে অপরূপ রূপে ও মাধুর্যে মূর্ত হয়েছে তাঁর গানে; কিভাবে, তাই বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেছেন কবি অরুণ দাশগুপ্ত তাঁর এই ঋদ্ধ গ্রন্থে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়