এস কে সুর চৌধুরী ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব স্থগিত

আগের সংবাদ

রূপগঞ্জে হতাহত বেড়েছে চার কারণে : ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার, আহত শতাধিক, এখনো নিখোঁজ ৫১ জন

পরের সংবাদ

পারমিতার জগৎ

প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শপিংব্যাগগুলো বিছানার উপর রেখে বললো, “দেখো, এগুলো তোমার বিয়ের বাজার। দেখো পছন্দ হয় কি-না, ইউসুফ আর আলম গেছে সোনার দোকানে আংটি আর চেইন কিনতে। আর হুমায়ুন গেছে কাজী সাহেবের খোঁজ নিতে। তাড়াহুড়ায় এরচেয়ে বেশি করা সম্ভব নয়।” আমি চুপচাপ বসে রইলাম। বিয়ের বাজার দেখার সামান্য আগ্রহও হলো না। ভাবলাম, বাজার দেখে লাভ কী, পছন্দ না হলে তো বদলানোর উপায় নেই। আমাকে নড়তে না দেখে মাসুম তাগাদা করলো, “কী হলো, দেখছো না?” আমি মৃদু স্বরে বললাম, “কী হবে দেখে? যা এনেছো ঠিকই আছে।” নিজের কথায় আমি নিজেই অবাক হলাম, আমি যেনো জোরে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। মাসুম আমার গা ঘেঁষে বসলো। আমার পিঠের সাথে ওর বুকটা মিশিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলো। আমি ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলাম। ভয়-সংকোচ-দ্বিধা মিলিয়ে বুকে আমার কম্পন জাগলো। মুহূর্তেই ভয়টা কেটেও গেলো। মাসুমের স্পর্শে আমি বাড়তি কোন ইঙ্গিত টের পেলাম না; কিন্তু ওর কণ্ঠে আমি একটা কম্পন অনুভব করলাম। মাসুম কম্পিত কণ্ঠে বললো, “দেখো পারমিতা এখানে আমরা আজ এবং আগামীকাল থাকতে পারবো। পরশু আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। সুতরাং আমাদের সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে দ্রুততার সাথে। প্রথম কথা হলো আমরা বিয়ের পর যাবো কোথায়? জামালপুরে তোমাদের বাসায়? না-কি আমাদের বাসায়?” মাসুমের কথায় আমার বুকের ভেতর আরেকবার ধক করে উঠলো। আমার হাত-পা যেনো শক্তি হারাচ্ছে, জিহ্বা যেনো আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে। হয়তো মাসুম আমার বুকের কথা বুঝতে পারলো। ও আমায় সাহস দিয়ে বললো, “এখনও সময় আছে পারমিতা, তোমার মনে যদি কোনো দ্বিধা থাকে, তাহলে এখনো বলো; আমি তোমায় হোস্টেলে রেখে আসছি। প্রয়োজনে আরও একটু সময় নাও।” আমি নিজেকে মাসুমের স্পর্শ থেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ালাম। ঘরের মধ্যে একটু পায়চারী করে নিজেকে সহজ করতে চেষ্টা করলাম। নিজেকে সহজ করে নিয়ে বললাম, “তুমি কি ভয় পাচ্ছো বিয়ে করতে?” মাসুম মৃদু হেসে বললো, “ভয় তো একটু হচ্ছেই। তোমায় বিয়ে করেছি শুনলে বাসায় সবাই কী ভাববে, ভাবী কী মনে করবে; এসব ভেবে ভয় তো কিছুটা হচ্ছেই।” মাসুমের কথায় আমার হাসি পেলো, হাসি লুকিয়ে বললাম, “আমি কি তাহলে ফিরে যাবো?” মাসুম একটু যেনো শক্ত হলো, “আমার ভয়ের কথা ভেবে নয়, যদি তোমার মনে হয় সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই চলে যেতে পারো। আমি তো তোমার এ সিদ্ধান্তের সাথে একমত নই। আমি জানি, একদিন তুমি তোমার এ অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্তের জন্য পরিতাপ করবে।” হঠাৎ আমার রাগ হলো, “পরিতাপ করার কিছু নেই। আমি জানি, আমি যা করেছি সেটাই সঙ্গত। আমি বুঝে গেছি, জলে থেকে কুমীরের সাথে বিবাদ করা সহজ নয়! তাছাড়া জীবনে ডাক্তার হতে হবে তেমন স্বপ্ন তো আমার কোনদিন ছিলোই না, সুতরাং স্বপ্নভঙ্গের বেদনাও নেই। অবশ্য কখনো কখনো কোন কোন রুগীর সেবা করতে গিয়ে বুকের মধ্যে ডাক্তার হবার আকাক্সক্ষা জেগেছে।” মাসুম আবার তর্ক জুড়তে চাইলো, “তাহলে কেনো আজ তোমার এমন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে? আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা দু’জন আজ বিয়ে করে নিচ্ছি, কিন্তু পড়ালেখা চালিয়ে গেলে দোষ কী?” মাসুমকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “বাদ দাও তো এসব কথা। আমি গতকাল সারারাত ভেবেছি। সবদিক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার আপত্তি থাকলে এখনও বল, আমি চলে যাচ্ছি! আগামীকাল অন্যকাউকে বিয়ে করে নেবো।” আমার কথায় মাসুম যেনো ভড়কে গেল, “আমি কি বলেছি, আপত্তির কথা? আয়োজন সব তো চলছেই।” আহ্লাদ করে মাসুম আমায় চুমু দিতে চাইলো, আমি হাত বাড়িয়ে ওকে ফিরিয়ে দিলাম। মুখে হাসি নিয়ে বললাম, “আমরা পরশু ঢাকা চলে যাবো।” মাসুমও মৃদু হাসলো, “ঢাকায় গিয়ে তো কোথাও থাকতে হবে। বাসা খুঁজে পেতেও তো দুই-চার-পাঁচদিন সময় লাগবে। নিজেদের জন্য বাসা খুঁজে পাবার আগ পর্যন্ত কোথাও তো থাকতে হবে। সবকিছুই আমাদের আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” মাসুমের কথা শেষ হতেই দরোজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। দরজা খুলে দিলে ইউসুফ ভাই আর আলম ভাই ঢুকলেন। ছোট্ট একটা লকেটসহ একটা চেইন, কানের একজোড়া রিং আর দু’টো আংটি আমার হাতে দিয়ে আলম ভাই বললেন, “দেখো পারমিতা তোমার পছন্দ হয় কি-না?” আমি ওগুলো বিছানায় শপিংব্যাগগুলোর পাশে রাখলাম। ইউসুফ ভাই বললেন, “অভিজ্ঞতা নেই তো, তাই ভয়ে ভয়ে কিনেছি এগুলো। তোমার পছন্দ না হলে বদলে আনা যাবে।” আমি আবার মৃদু হাসলাম, “সবকিছুই ভালো হয়েছে। আমার পছন্দ না হবার কারণ নেই।” সবাই একটু অবাক হলো। এ সময় দরজায় আবার কড়া নাড়ার শব্দ। হুমায়ুন ভাই এলেন। এসেই একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। সবাই প্রশ্ন নিয়ে তাকালো তার দিকে। হুমায়ুন ভাই সবাইকে আস্বস্ত করে বললেন, “ভয় নেই, আমি কাজী সাহেবের সাথে যোগাযোগ করেই এসেছি। আটটায় টাইম দিয়েছেন। নাটকঘর লেনে কাজীর অফিস, আমরা আটটায় যাবো। কাছেই, হেঁটে গেলে বড়জোর পাঁচমিনিট। কাজী সাহেব আটটার মধ্যেই আসবেন।” হাতে তখনো একঘণ্টা সময় আছে। হুমায়ুন ভাই আবার বললেন, “আংটি দু’টি আনা হয়েছে তো? এখন চলো দু’জন দু’জনকে আংটি পরিয়ে দাও।” সবাই তৎপর হয়ে উঠলেন। আমরা দু’জন দু’জনকে আংটি পরিয়ে দিলাম। আমার জন্য আনা আংটিটা অনামিকায় থাকছিলো না, অগত্যা মধ্যমায় পরে নিলাম। এবার হুমায়ুন ভাই বললেন, “তুমি এবার একটা শাড়ি পরে নাও।” আমি শাড়ি-ব্লাউজ-পেটিকোট নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলাম। বুকের ভেতর কী যেনো হলো, কান্না পেলো খুব। একটুক্ষণ কাঁদলাম বসে। তার পর শাড়ি-ব্লাউজ পরে নিলাম। ব্লাউজটা আমার গায়ে আঁটোসাটো হয়ে আছে। শাড়ি পরে বেরিয়ে এলাম আমি। মাসুম কিছুই বললো না, ইউসুফ ভাই বললেন, “বাহ্ পারমিতা! তোমাকে তো নতুন বউ-নতুন বউ লাগছে এখন! বেশ মানিয়েছে তোমায়।” আটটা বাজার একটু আগেই আমরা কাজীর অফিসের দিকে রওনা করলাম।

আশপাশে সব ঘরেই বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে, কিন্তু কাজী সাহেবের ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, একটা হারিকেন জ্বলছে টেবিলে। ঘরে একটা পুরোনো আলমারি, একটা লম্বা মতো টেবিল, টেবিলের উপর লাল-হলুদ ফুল আঁকা গাঢ় নীল রঙের প্লাস্টিক কভার। টেবিলের এক পাশে দু’টি চেয়ার, একটা কুশনআঁটা, অন্যটা কাঠের। সহজেই বোঝা যায় কুশনআঁটা চেয়ারটা কাজী সাহেবের, অন্যটা তাঁর সহকারীর। টেবিলের সামনে তেলচিটে একটা লম্বা বেঞ্চি, বাঁ পাশে সামনে-পিছনে দু’টি ছোট বেঞ্চি; আর ডানপাশে নড়বড়ে আলমারির সামনে আরও একটা নড়বড়ে কাঠের চেয়ার। কাজী সাহেব এসে পৌঁছাননি। সহকারীর চেয়ারে মাথায় টুপি পরা একজন ক্ষীণকায় মানুষ বসে আছেন। তিনিই আমাদের অভ্যর্থনা করে বললেন, “আপনারা বসুন। হুজুর চলে আসবেন এখনই।” আমাকে সবাই ডানপাশের চেয়ারটাতে বসতে বললেন, আমি বাঁ পাশের দুই বেঞ্চির সামনেরটাতে বসলাম ভয়ে ভয়ে। হুমায়ুন ভাই হাসতে হাসতে বললেন, “তুমিই একমাত্র নারী আমাদের মধ্যে, চেয়ারও একটাই; তুমি ওটাতে বসলেই ভালো হয়।” সহকারী সাহেব অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললেন, “আসলে আমাদের অফিসটা তাড়াতাড়িই এখান থেকে নওমহলে চলে যাবে, তাই এখানে আর নতুন ফার্নিচার আনা হচ্ছে না। একটু কষ্ট করে বসুন হুমায়ুন ভাই।” বুঝলাম, হুমায়ুন ভাই এখানে পরিচিত, হবারই কথা, একই এলাকায় থাকেন। আমরা সবাই বসলাম। সহকারী এবার প্রশ্ন করলেন, “হুমায়ুন ভাই, বিয়েতে উকিল কে হবেন?” মাসুম আর ওর বন্ধুরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। হুমায়ুন ভাই সহজেই বলে দিলেন, “কাজী সাহেবকেই উকিল করে দিন!” সহকারী আলমারি থেকে একটা রেজিস্টার বের করতে করতে বললেন, “না-না, তাতো হবে না। আপনারাই কেউ হন, না হয় একজন কাউকে নিয়ে আসুন! হুজুরের সাথে আমার কথা হইছে আপনার বিষয়ে। আপনি উকিল নিয়ে আসেন, আমি লেখালেখিটা আগায়া রাখি।” রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন একজন ভদ্রলোক, হুমায়ুন ভাই তাকে হাত ধরে টেনে আনলেন। ভদ্রলোক বলছেন, “আরে পাগল কী হইছে টানাটানি করে ক্যা?” হুমায়ুন ভাই তাকে টেনে এনে ডানপাশের চেয়ারটাতে বসিয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের হাত ধরে বললেন, “খোকন ভাই বড় বিপদে পইরা গেছি। আমার বন্ধু মাসুমের বিয়া; আপনের ইকটু উকিল হইতে অইবো!” খোকন ভাই হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন, “তুমার কি মিয়া মাথা খারাপ না-কি! আমি কি এখন কুনু ভেজালে থাকি? এক কাম করো দুলাল কমিশনারের কাছে যাও। আমার লগে চল, আমি কইয়া দিতাছি।” হুমায়ুন ভাই দমবার পাত্র নন, বললেন, “খোকন ভাই আপনে কার নাম কন! রাইত আটটা বাজলে দুলাল ভাইয়ের কি দিমাগ ঠিক থাকে? তাছাড়া আপনে হইলেন আমগর কাছে হিরো, সেই পাকিস্তান আমল থাইক্যা দেখতাছি আপনেরে! আপনে জানেন না আমরা আপনেরে কতডা মান্য করি?” হুমায়ুন ভাইয়ের কথায় মনে হলো মন গললো খোকন ভাইয়ের। এবার উনি খোঁজ নিলেন পাত্রপাত্রীর, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সহকারীকে বললেন, “জব্বার মিয়া, তুমি সব লেখালেখি কইরা ফালাও, আমি বাসা থাইক্যা আসতাছি পনের মিনিটে।” বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, “দেইখ্যো মিয়া, আমারে এই বুড়া বয়সে বেইজ্জত কইরো না! তুমরা সব গুছাও, কাজী সাইব আসুক, আমি আইতাছি।” বেরিয়ে গেলেন খোকন ভাই। আমি অনেক কষ্টে নিজের হাসি লুকিয়ে রাখলাম। মাসুম কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে বললো, “খোকন ভাই কি ফিরে আসবেন?” হুমায়ুন ভাই হাসলেন, “খোকনভাই কথা মিস করে না। রাজী যখন হয়েছেন, অবশ্যই আসবেন। আরে উনি ‘কানা খোকন’! তুই তার নাম শুনস নাই? এনএসএফ-এর কানা খোকন!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়