এস কে সুর চৌধুরী ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব স্থগিত

আগের সংবাদ

রূপগঞ্জে হতাহত বেড়েছে চার কারণে : ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার, আহত শতাধিক, এখনো নিখোঁজ ৫১ জন

পরের সংবাদ

পরম আত্মীয় ফজল-এ-খোদা

প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তাকে কোনোদিন বলা হয়নি, আপনাকে অভিবাদন। আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। আপনি সালাম সালাম হাজার সালামের লেখক। আপনি ‘পাকতাড়–য়া’ শব্দটি নির্মাণ করেছেন। আপনি ছড়াকার। বাংলাদেশ বেতারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। একদা দুর্দান্ত শিশু সংগঠক। আপনি খুবই খ্যাতিমান সংগীত-রচয়িতা।
অনেক পরিচয় তার। অনেক কর্মময় জীবন। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির স্নেহধন্য। অনেক তরুণকে তিনি উদার হস্তে স্নেহ বর্ষণ করেছেন।
এক আশ্চর্য মানুষ তিনি। শিশুর মতো সরল। তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল শিশু-কিশোরকালে। রেডিও বাংলাদেশে ছড়া পড়তে গেছি। তারই পরিকল্পনায় অনুষ্ঠান। দেখা হলো ব্যস্ত সেই ছোটখাটো মানুষটির সঙ্গে। খুব আন্তরিকভাবে কুশল বিনিময় করলেন, সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। আমাদের বালক বয়স। তার তখন ভরা যৌবন। এক মাথা বাবরি চুল। ডোরাকাটা একটা কোট পরনে। খুব আন্তরিক। জানলাম তিনি মিতাভাই। তিনি ‘শাপলা শালুক’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিন বছর। দেশব্যাপী গড়ে তুলেছিলেন শাপলা শালুকের আসর। তারই লেখা সেই বিখ্যাত গান :
যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে
যে দেশেতে কলমি কমল কনক হয়ে হাসে
সে আমাদের জন্মভূমি মাতৃভূমি বাংলাদেশ \
হাঁ, তার নাম ফজল-এ-খোদা (১৯৪১-২০২১ )। আমাদের প্রিয় এক মানুষ। আমার প্রিয় ছড়াকবি তিনি। খুব নিভৃতচারী। দলবাজি ও ভিড় এড়িয়ে ¯িœগ্ধ জীবনযাপন করে গেলেন। তার বড় সন্তান ওয়াসিফ-এ-খোদা। আমাদের খুব ঘনিষ্ঠজন। অনুজ বন্ধু। ওয়াসিফ বড়ো হলো আমাদের সামনেই হাসতে হাসতে। ওয়াসিফের সেই হাসি এখনো অমলিন। যখনই দেখা হবে, কথা হবে তখনই ওয়াসিফ একপ্রস্থ হাসি দিয়ে আলোচনা শুরু করবে। ওয়াসিফের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে যাওয়ায় ফজল-এ-খোদার সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এলো। কারণ ওয়াসিফের কাছেই বাবার সব খবরাখবর পাই। ওয়াসিফরা এখন থাকে বাবর রোডে। বাংলাদেশ বেতার কার্যালয় আগারগাঁওতে। তারই উল্টোদিকে কোনো এক কোয়ার্টারে জীবনের দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন।
তাকে আমরা ‘খোদা ভাই’ সম্বোধন করি। ছোটবেলায় ভাবতাম, ড. কুদরাত-এ-খুদার তিনি হয়তো নিকট আত্মীয়! কিছুদিনের মধ্যেই সে ভুল ভাঙল।
খোদা ভাইয়ের সঙ্গে বেতারের কার্যালয় ছাড়াও দেখা হয়েছে বাংলাদেশ টেলিভিশনে। তিনি সেখানে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। আমরা ছিলাম আলী ইমাম ভাইয়ের সহকারী। টেলিভিশনে নিয়মিত কাজ করতাম। খোদা ভাই একইরকম আন্তরিকতায় স্বল্পভাষণে বলতেন, কী আমীরুল, কেমন আছ? তোমার লেখা নিয়মিত পড়ছি। ভালো লিখছ।
লজ্জায় মাথা নত করে রাখতাম।
কয়েক বছর আগে ‘গানে গানে সকাল শুরু’ অনুষ্ঠানে ফজল-এ-খোদাকে নিয়ে এলাম। আবদুল জব্বার এবং ফজল-এ-খোদা। সালাম সালাম হাজার সালাম গানটি নির্মাণের স্মৃতিকথা বললেন তারা। খোদা ভাই খুব খুশি হয়েছিলেন। বারবার বললেন, আমীরুল ছোটদের একটা নিয়মিত অনুষ্ঠান করো। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।
অনেক প্রতিশ্রæতি যেমন জীবনে পালন করা হয় না, তেমনি ফজল-এ-খোদার সঙ্গে অনুষ্ঠানও করা হয়নি আমাদের।
শুনেছি, বয়সের কারণে খোদা ভাই এখন স্মৃতিভ্রংশ হয়ে যাচ্ছেন। বর্ণাঢ্য জীবন। ধূসর হয়ে গেছে সব স্মৃতি! খোদা ভাই একটা বই স্মৃতিকথা লিখেছেন : আলো ছায়ার জোয়ার-ভাটা।
লোক হিসাবেও তিনি খুব দরদি মনের লেখক। ছড়া রচনায় খুব আন্তরিক। জয় মুক্তিযুদ্ধ, আড়ি, টুনটুনি তার ছড়াগ্রন্থ। রয়েল বেঙ্গল নামে তার একটি গল্পগ্রন্থ আছে। সবিনয়ে উল্লেখ করতে চাই- বইটি আমাকে উৎসর্গ করা। লেখা আছে : ছড়াবিদ আমীরুল ইসলাম। এছাড়াও খোদা ভাই টুনটুনি ছড়ার বইটি প্রিয় এগারোজনকে উৎসর্গ করেছেন। সেই এগারো ছড়াকবির মধ্যে আমিও একজন। এ আমার অনেক বড় গর্ব।
খোদা ভাই আমার ছড়া নিয়মিত পড়তেন। ওয়াসিফ আমার ছড়া রচনাবলী পাঁচ খণ্ডই নিয়ে গিয়েছিল বাবার জন্য। খোদা ভাই মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। আর ওয়াসিফকে বলতেন, আমীরুলের ছড়া অন্যরকম। ও আলাদাভাবে লেখে।
ওয়াসিফ বাবার সঙ্গে একমত। এবং আমাকে সেসব কথা বলত খুব গর্ব নিয়ে। খোদা ভাইয়ের মন্তব্যে আমিও গর্ববোধ করতাম।
এ আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি।
ফজল-এ-খোদা খুব বিখ্যাত সংগীত-রচয়িতা : এ কথা সবাই জানেন। সালাম সালাম হাজার সালাম ছাড়াও তার লেখা দু-একটি গানের কথা উল্লেখ করতেই হয়। যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে- গানটির সুর দিয়েছিলেন আবেদ হোসেন খান। খুব বেশি গান তিনি সুরারোপ করেননি। আরেকটি গান : কলসি কাঁখে ঘাটে যায় কোন রূপসী। ধীর আলী মিয়ার সুর। বাসন্তী রং শাড়ি পরে কোন বঁধুয়া চলে যায়- খোন্দকার ফারুক আহমদের গাওয়া ষাট দশকের জনপ্রিয় গান।
তার একটি ছড়াগান শুনতে শুনতে ছোটবেলা পার করেছি-
খোকনমণি রাগ করে না
বায়না অমন ধরে না
মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের গাওয়া। এই গানে শিশুকণ্ঠ দিয়েছিলেন শিমুল ইউসুফ। এই গান শোনেনি এমন চল্লিশোর্ধ ব্যক্তি বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ বেতারে অনুষ্ঠান নির্মাণ ছাড়াও বেতার বাংলা ও শাপলা শালুক পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। শাপলা শালুক পত্রিকাটার ২৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তাতেই ব্যাপক আলোচিত হয় এই শিশু-কিশোর মাসিকটি। দেশজুড়ে বেতারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শাপলা শালুকের আসর নামের শিশুসংগঠন গড়ে ওঠে। অল্প সময়ে খুব আলোচিত সংগঠন।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশজুড়ে শিশু সংগঠনের কার্যক্রম ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশু সংগঠনের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। খোদা ভাই বলেছিলেন শাপলা শালুকের আসরের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল নভেম্বরে, ১৯৭৫ সালে। কিন্তু চরম দুর্ভাগ্য! ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সব এলোমেলো হয়ে যায়। সংগঠনটিও স্তিমিত হয়ে আসে।
ওয়াসিফের মধ্য দিয়ে ফজল-এ-খোদা সবসময় আমাদের মধ্যে জীবন্ত থাকেন। শুনেছি- খোদা ভাইয়ের এখন অখণ্ড অবসর। শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। তিন নাতনি আছে। ওয়াসিফের তিন মেয়ে। একসঙ্গে জন্ম নিয়েছে। বিন্তি, বিন্দি আর বিন্নি। খোদা ভাইয়ের রাখা নাম। নাতনিদের সঙ্গেও দিনের অনেকটা সময় কেটে যায়।
ফজল-এ-খোদার অনেক গৌরবময় জীবন। সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেক। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি কি পেয়েছেন? একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার কোনোটাই তিনি পাননি। এই দীনতা ও লজ্জা নিশ্চয়ই আমাদের।
কিন্তু মানুষের যে ভালোবাসা আপনি পেয়েছেন তার মূল্যও কম নয়। আপনার মতো সৎ, নির্বিরোধী, শান্ত মানুষ ক’জন আছেন? শিশুর মতো জীবনযাপন করে গেলেন। এতেই আপনার আনন্দ।
কত কথা বলার ছিল বলা হলো না। যেখানে থাকুন ভালো থাকুন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়