এস কে সুর চৌধুরী ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব স্থগিত

আগের সংবাদ

রূপগঞ্জে হতাহত বেড়েছে চার কারণে : ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার, আহত শতাধিক, এখনো নিখোঁজ ৫১ জন

পরের সংবাদ

দাদামণি, আড্ডার মধ্যমণি

প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আড্ডার মধ্যমণি হন যদি একজন জ্ঞানী, আন্তরিক এবং সহনশীল মানুষ তাহলে সে আড্ডা যে সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিকাশে সহায়ক, এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করার সুযোগ নেই। এটা সত্য, বাঙালি বেলাগাম আড্ডাবাজিতে ভীষণ আগ্রহী। এটাও সত্য, আড্ডাকে আমাদের সমাজ খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। কারণও আছে। বেশিরভাগ আড্ডায় পরচর্চা, দিশাহারা বিষয় উঠে আসে, কোনো কোনো সময় আড্ডা সমাজে অনাচারও ছাড়ায়। তাই গড়পড়তা আড্ডার প্রতি মানুষের বাঁকা-দৃষ্টি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আড্ডা যে বাঙালি সমাজের সৃজনশীল বিকাশে কত বড় ভূমিকা রেখেছে ইতিহাস তার সাক্ষী।
কথাগুলো বললাম এই কারণে, চট্টগ্রাম শহরের যে কয়েকটি আড্ডা, লেখালেখি এবং সংস্কৃতি চর্চায় নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে তার একটি হলো শহরের বৌদ্ধ মন্দির লাগোয়া কবি ও সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত’র বাসার আড্ডা। কে কে আসতেন এই আড্ডায় তা জানার চাইতে কে কে আসতেন না সেটা জানার চেষ্টাই উত্তম। এটাও জানা যেতে পারে কারা নিয়মিত আসতেন, কারা অনিয়মিত।
দৈনিক আজাদী’র প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, ড. অনুপম সেন, ড. হরেন দে যেমন আসতেন তেমনি উপস্থিত হতেন সবে লেখালেখি শুরু করেছে এমন যুবকও। সবার জন্যই দরজা ছিল অবারিত।
দীর্ঘকাল অরুণ দাশগুপ্ত চমৎকার এই দোতলা ভবনের নিচতলায় থাকতেন। তারপর আরো একটি জায়গায় অল্প কিছুদিন থেকে রহমতগঞ্জের জে এম সেন হল থেকে ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে শিক্ষক ও রবীন্দ্র গবেষক যোগেশ সিংহের স্মৃতিবিজড়িত যোগেশ ভবনে বসবাস করতে থাকেন। বৌদ্ধ মন্দিরের পাশের ভবন থেকে সরে যাওয়ার পর আড্ডার পরিসর আস্তে আস্তে কমছিল। অরুণ দাশগুপ্ত’র শরীরের বয়স বাড়ছিল, কিন্তু মন যৌবন ধরে রেখেছিল। তাই তিনি গ্রামে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তরুণদের সাহচর্য সবসময় উপভোগ করেছেন।
অরুণ দাশগুপ্ত থাকার জায়গা বদল করেছেন। অনেকেই নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে সরে গেছেন। কিন্তু আগাগোড়া যে সজ্জন মানুষটি তার সঙ্গে ছিলেন তিনি কবি আশীষ সেন।
চট্টগ্রামবাসী অরুণ দাশগুপ্তকে চেনেন কবি ও সাংবাদিক হিসেবে। তাকে কেউ ডাকতেন অরুণদা, কেউ অরুণ বাবু। আমরা ডাকতাম দাদামণি। তার পিসতুতো ভাইরা তাকে এই নামে ডাকত। তাদের কাছ থেকে সম্বোধনটি আমাদের মুখে উঠে এসেছিল।
এক বর্ণময় জীবনের অধিকারী তিনি। পিতার ভিটা ধলঘাটে। একটা সময়ে তিনি কলকাতা চলে যান। সেখানে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা শেষ করে নাকি চলাকালীন জানি না, তিনি জড়িয়ে পড়েন বামপন্থি রাজনীতিতে। তার মুখে শোনা, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুও একই সময়ে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতেন।
কলকাতা থাকাকালীন অরুণ দাশগুপ্ত লেখালেখিও করতেন নিয়মিত। একবার আজাদী অফিসের সামনে কলকাতার একটা লিটন ম্যাগাজিন তার হাতে দেখে জিজ্ঞাসা করাতে দেখতে দিয়েছিলেন। খুলে দেখেছিলাম তার লেখা একটি গল্প। একই সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পও। কিন্তু আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে তাকে আর কোনো গল্প লিখতে দেখিনি।
প্রবন্ধ লিখতেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তার প্রথম পছন্দ ছিল রবীন্দ্রনাথ। কলকাতায় থাকার সময় রবীন্দ্রসংগীতে তালিম নিয়েছিলেন গুণী শিল্পীদের কাছে। মাঝে মধ্যে ছোট পরিসরের আড্ডায় গেয়েও শোনাতেন রবীন্দ্রসংগীত। চট্টগ্রামে রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগিতায় বিচারকের কাজও করেছেন বহুবার।
অরুণ দাশগুপ্ত আজাদীতে সাংবাদিকতা করতেন। দেখেছি, আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ তাঁকে অনুজের মতো ¯েœহ এবং বিশ্বাস করতেন। অধ্যাপক খালেদ যতদিন বেঁচেছিলেন অরুণ দাশগুপ্ত’র পরামর্শ ছাড়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সম্ভবত নেননি।
দীর্ঘদিন নিউজ ডেস্কে কাজ করার পর তিনি এডিটোরিয়াল সেকশনে যোগ দেন। নিউজে কাজ করার সময় থেকেই তিনি আজাদীর সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করতেন। কাজটা করে তিনি খুব আনন্দ পেতেন। সেটা বোঝা যেত। বলতেনও নিজে।
একসময় লিখতেন, মাঝখানে কয়েক বছর বিরতি দিয়ে তিনি আবার কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন নিয়মিত। নতুন ভাবনার কবিতা, নতুন ধারার কবিতা।
পরিচয় অনেক আগে, ঘনিষ্ঠতা আমার দাদামণির সঙ্গে আশির দশকে। ’৮৭ সালের কথা। তখন চুটিয়ে নাটক করছি। হঠাৎ একবার নাটক মঞ্চায়নের দিন ৫০০ টাকার খুব প্রয়োজন পড়ল। এলাম দাদামণির বাসায়। বললাম তাঁকে। তিনি কোনো কথা ছাড়াই ৫০০ টাকা বের করে দিয়েছিলেন। কথাটা বললাম এই কারণে, সেই সময়ে ৫০০ টাকা খুব একটা কম টাকা ছিল না। আমি দেখেছি, টাকার প্রতি লোভ তার একেবারেই ছিল না। তাই তিনি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বিপুল ধন-সম্পত্তি প্রায় বিলিয়ে দিয়েছেন বললেই চলে।
কলকাতা থেকে ফেরার পর বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষকতাও করছেন তিনি। এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন তিনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রায়ই তার একজন শিক্ষকের কথা বলতেন, যিনি তাকে ‘বাচ্চা’ বলে ডাকতেন। ধলঘাটের পাশের গ্রাম রতনপুর নিবাসী ওই শিক্ষক অরুণ দাশগুপ্তের মানস গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।
চিরকুমার অরুণ দাশগুপ্ত নিজের শর্তেই জীবনযাপন করেছেন। মানুষের কল্যাণ কামনা করেছেন, তরুণদের ভালো কাজে উৎসাহিত করেছেন, প্রচুর লেখককে তিনি তৈরি করেছেন। নিজেকে গুটিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন তিনি। শুভার্থীদের পীড়াপীড়িতে রবীন্দ্রনাথের গান বিষয়ে একটি মূল্যবান প্রবন্ধ গ্রন্থ তিনি প্রকাশ করেছেন। আরো কয়েকটি গ্রন্থ তার আছে।
মাস ছয় আগে ধলঘাটের প্রীতিলতা ট্রাস্ট তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে দেখেছিলাম আমরা দুইজন দুদিক থেকে ধরার পরও তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। তার অবস্থা দেখে সত্যিই আমি শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। অনেক আগে থেকেই অরুণ দাশগুপ্ত ধলঘাট গ্রামে নিজের ভিটায় থাকছেন। জরা আস্তে আস্তে তাকে গ্রাস করছে। সম্প্রতি লেখক ও আবৃত্তিশিল্পী রবীন ঘোষ ফেসবুকে তাকে নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এরপর নানা মহলে সাড়া পড়ে যায়। অনেকেই নানাভাবে তাকে শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি জানাচ্ছেন।
যতদিন তিনি শারীরিক এবং মানসিকভাবে সচল ছিলেন, ততদিন চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মধ্যমণি হয়েই ছিলেন। তার মতো মানুষ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাওয়া উচিত কি না তা অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়