বাইক দুর্ঘটনায় কিশোর নিহত

আগের সংবাদ

প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে ডেঙ্গু : ২৪ ঘণ্টায় ১৯ মৃত্যু, আক্রান্ত ১৭৯২ > অধিকাংশ মৃত্যুর কারণ শক সিনড্রোম

পরের সংবাদ

ডি-টিকটিকি

প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

যাত্রাবাড়ীর এই গলিটায় একেকজন দিন শুরু করে একেক সময়। মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেব, পত্রিকার হকার শিমুল, হাসপাতালের আয়া বুবলি খালা, ওয়ার্ড বয় শান্তু ভোর ৪টা বাজলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আবার লেগুনার হেলপার সিদ্দিক, বাসের সুপারভাইজার আবুল- ওদের কাজ শুরু সকাল ৬টার দিকে। সবার শেষে উঠেন রাতে ট্রাক চালানো সাইফুল কাকা। ১১টার দিকে খালি গায়ে দাঁতে ব্রাশ করতে করতে মেসের টয়লেটের দরজায় তার ধাক্কার শব্দ শুনতে পায় মহল্লার সবাই। আমাদের গল্পটা অবশ্য শিমুলকে নিয়ে।
ভোর ৪টায় ও চলে আসে যাত্রাবাড়ীর পত্রিকা কালেকশন সেন্টারে। নিজের পত্রিকাগুলো বুঝে নিয়ে বাড়ি বাড়ি বিলি করা শুরু করতে বেজে যায় ৬টার মতো। ওর মা গার্মেন্টসে যায় সাড়ে ৬টার দিকে। পত্রিকা বিলি করে ফিরতে ফিরতে বাজে ১১টা। ওর এখন পড়ার কথা ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম শ্রেণিতে। কিন্তু গেল করোনায় বাবা মারা গিয়ে সব ওলটপালট হয়ে যায়। দুপুর গড়ালে ও যায় আতিক ভাইয়ের ক্লাসে। ভার্সিটিপড়ুয়া আতিক ভাই ওই সময়টায় বস্তির সুবিধাবঞ্চিত ও স্কুল থেকে ঝরে পড়া ছেলেদের নিয়ে এখানে বসেন। উনার কল্যাণে শিমুলরা রবি ঠাকুর, নজরুলের পাশাপাশি নিউটন, কলম্বাস, সিরাজ-উদ-দৌলা থেকে শুরু করে গালিভার, আলাদিন, ফেলুদাকেও চিনে গেছে।
টাটকা খবরের কাগজ নিয়ে শিমুল হাঁটছে সায়েদাবাদের দিকে। চারদিক এখনো অন্ধকার। ফজরের আজান হয়ে গেছে। রাস্তা ফাঁকা। মাঝেমাঝে একটা-দুইটা রিকশা, অ্যাম্বুলেন্স আসা-যাওয়া করছে। বামের গলিটাতে ঢুকতে যাবে এমন সময় একটা কাণ্ড ঘটে যায়। দুইটা ছেলে রিকশা করে যাচ্ছিল। একটা মোটরসাইকেলে হেলমেট পরা দুইটা লোক বিদ্যুতের মতো এসে রিকশার ছেলেটার হাতের মোবাইল ফোন টান দেয়। ধস্তাধস্তিতে ছেলেটা পড়ে আঘাত পায় ঠিক মাথায়। গলগল রক্তে চারদিক সয়লাব। আর মোটরসাইকেলের লোকেরা মোবাইল, ট্র্যাভেল ব্যাগ নিয়ে যেন শিমুলের উপর পড়তে যায়। ও তাৎক্ষণিক সরে বেঁচে যায়। কিন্তু খুব কাছ থেকে দেখে ফেলে হেলমেটের ফাঁক দিয়ে ভুরুতে রিং লাগানো চোখ, টিশার্টের ডিজাইন আর আরেকটা জিনিস। ভয়ে উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে শিমুল।

সেদিন দুপুরের কথা।
– আরেকটু হইলে আমার উপর উইঠা যাইত মোটরসাইকেল, আতিক ভাই। জানে বাঁচছি।
– তোকে না আমি গোয়েন্দাগিরি শিখিয়েছি? তোর তো চোরদের ধরা উচিত ছিল।
– কী বলেন। ঘটনার পর পরই পুলিশ আসল। কই, তারাওতো কিছু করতে পারল না। শুধু আহত ছেলে দুইটাকে হাসপাতালে ভর্তি করল।
– ওদের কাছে তো ক্লু নেই। ওই গলিতে সিসি ক্যামেরা নেইতো। তুই তো সব দেখেছিস। তুই পুলিশের চেয়ে এগিয়ে। তুই হলি ডিটেকটিভ। মানে টিকটিকি। ডিজিটাল প্রজন্মের ডি-টিকটিকি।

আতিক ভাই যতই হাসির কথা বলে শিমুলের ভয় কাটাতে চান না কেন, ওর আতঙ্ক কাটছেই না। রাতে প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখছে সে। হলুদ টিশার্ট। তাতে ভয়ংকরভাবে চেয়ে থাকা রেসলার ‘আন্ডার টেকার’। এই ডিজাইন কোনোদিন ভুলবে না সে।
আরো কিছুদিন চলে যায়। পত্রিকা উলটে-পালটে দেখে সে প্রতিদিন। মাত্র তিন দিনে এই খবর সবাই ভুলে যায়। কেউ ধরা পড়ে না। সবকিছু স্বাভাবিক। শিমুল আগের মতো পত্রিকা বিলি করে। আতিক ভাই একটা কথা বলে রেখেছেন, যদি কিছু জানতে পারিস আমাকে বলবি। আমার এক কাজিন ডিবিতে আছে। তোর কোনো ভয় নেই।
মাসের আজ ৭ তারিখ। জুরাইনের খোন্দকার সাহেবদের পত্রিকা বিল এখনো বাকি। টাকাটা আজ লাগবেই। মার জ্বর। ওষুধ কিনতে হবে। ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে খোন্দকার চাচি বলেন, ‘আচ্ছা দাঁড়া মিনিট দশেক। তোর চাচা সেলুনে চুল কাটতে গেছে। আইলেই টাকা দিমু। এক কাজ কর। তুই তো আমাদের চেনা পোলা। ড্রয়িংরুমে বইসা লালশাকের আঁটিগুলা পরিষ্কার কইরা দে।’
শিমুল সানন্দে বসে যায়। চাচি চলে যায় রান্না ঘরে। ওকে সবাই বিশ্বাস আর আদর করে। ড্রয়িংরুমটা খুবই অগোছানো আর কটু গন্ধযুক্ত। ঘাম, মশার কয়েল আর এয়ার ফ্রেশনারের মেশানো গন্ধ থেকে একটা তীব্র পারফিউমের গন্ধ ওর নাকে ভেসে আসে। মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো তীক্ষè গন্ধ। গন্ধটা খুব চেনা চেনা লাগছে। সেদিন ভোরে মোটরসাইকেল থেকেও আসছিল এই গন্ধ। গন্ধটার উৎস খুঁজতে খুঁজতে সে চলে আসে টয়লেটের সামনে রাখা কাপড়ের বালটিতে। একটু নাড়াচাড়া করতেই বেরিয়ে আসে হলুদ টিশার্ট। ভয়ংকর চেয়ে থাকা ‘আন্ডার টেকার’।
রান্নাঘরে শব্দ হতেই শিমুল এক ঝটকায় চলে আসে শাকের আঁটিতে। ‘তুই তো ভালা কাজ জানিস। নে আরেক আঁটি শাক নে। আমি কাপড়গুলা সাবানে ভিজাইয়া আসি’।
চাচি টয়লেটে ঢুকতেই শিমুল উঁকি মারতে থাকে প্রতিটা ঘরে। আসলে কাগজ বিলি করা ছাড়া সে আর কাউকে চেনে নাতো। ও জানে, এভাবে অন্যের ঘরে উঁকি মারা অন্যায়। বিশেষ করে চাচি তাকে বিশ্বাস করে বসিয়ে রেখে গেছে। কিন্তু শিমুলের মাথায় একটা কথাই ঘুরছে। টিকটিকি, ডি-টিকটিকি। আইনকে সাহায্য করতে গেলে এমন করতে হয়। এটাকে বলে তদন্ত। আতিক ভাই বলেছেন।
তিনটা ঘরের দুইটাই খালি। আরেকটা ভেজানো দরজা টোকা দিতেই কড়কড় শব্দ হয়। ভয় পেয়ে যায় শিমুল। ওকে সবাই এখন চোর ভাববে। কিন্তু কী আশ্চর্য, এমন শব্দেও ঘুম ভাঙে না বিছানায় শোয়া লোকটার। বেলা ১১টায় ঘুমায় কেউ? সারারাত কী করেছে লোকটা! নিঃশব্দে ঘরে ঢুকতেই বিশ্রী গন্ধ নাকে আসে। গাঁজা মেশানো সিগারেটের তামাকের গন্ধ। বমি পায় শিমুলের। আরেকটু কাছে আসতেই মুখটা দেখতে পায় সে। কালো করে একটা লোক। মোটা গোঁফ, মাথার দুইদিকের চুল মেশিনে কামানো আর কপালের বাম দিকে চোখের উপরে ভুরুতে রিং। সেই রিং। দৌড়ে সে ড্রয়িংরুমে ফিরে আসতেই দরজা খুলে ঘরে ঢোকেন খোন্দকার চাচা।
– তুই হকার পোলাটা, না? ভেতর কী করিস?
– বিলের জন্য বইসা আছি। চাচি শাক বাছতে দিছে।
উত্তেজনা সামলে, বুকের ধুকধুক গোপন রেখে, জড়িয়ে যাওয়া জিহ্বা নিয়ন্ত্রণে রেখে পাঁচ মিনিট পর বিল নিয়ে কেটে পড়ে শিমুল। এক দৌড়ে যায় আতিক ভাইয়ের বাসায়। ডিবি পুলিশে উনার চেনাজানা আছে।
– কাল সব পত্রিকায় তোর নাম ছড়িয়ে পড়বে। তুই যে বর্ণনা দিলি, অপরাধী একটু পরই ধরা পড়ে যাবে। টিভি ক্যামেরার সামনে কী বলবি ঠিক করেছিস?
– কিছু বলব না।
– মানে কী?
– আপনে আমার একটা উপকার করবেন। আপনার পুলিশের ভাইরে বলবেন আমার কথা যেন কেউ না জানে। সব খবর তারা পাবে ‘অজ্ঞাত সূত্র’ থেকে। আমি আর মা থাকি এই বস্তিতে। এখানে ঘরে ঘরে ছিঁচকে চোর, ছিনতাইকারী। আমি বিপদে পড়তে চাই না।
– ওয়েলডান, টিকটিকি। আমিও এটাই চাইতাম। ঘরে টিকটিকি দেখিসনি? এক কোনায় বসে সব কিছু চুপিচুপি দেখতে থাকে। তাকে কিন্তু সহজে কেউ দেখে না।
সেদিন সন্ধ্যাতেই আতিক ভাইয়ের বাসায় টিভিতে সংবাদ হচ্ছিল। গোপন সূত্রের ওপর ভিত্তি করে জুরাইন থেকে সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার। তাকে জেরা করে পুরো একটা গ্যাং ধরা পড়েছে। ওদের কাজই মোটরসাইকেল নিয়ে মাঝরাত থেকে ভোর পর্যন্ত ছিনতাই করা। পুলিশ বলেছে, এ রকমভাবে জনগণ সচেতন হলে, আমাদের তথ্য দিলে অনেক অপরাধের সুরাহা সম্ভব।

– আহাদ আদনান

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়