আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য পেছাল

আগের সংবাদ

শান্তি সমাবেশে আওয়ামী লীগের ঘোষণা : শেখ হাসিনার অধীনেই হবে আগামী নির্বাচন > ‘ফ্রি এন্ড ফেয়ার’ ইলেকশনে বাধাদানকারীদের প্রতিহত করা হবে

পরের সংবাদ

তুমুল বৃষ্টি ও একশটা কৈ মাছ

প্রকাশিত: জুলাই ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিন্নি তাকিয়ে ছিল জানালায়। তাকিয়ে তাকিয়ে মেঘ দেখছিল। মেঘরা ছোটাছুটি করছে। ছুটোছুটি নয়, যেন গোল্লাছুট খেলছে সব বন্ধুরা একসঙ্গে হয়ে।
আশ্চর্য! একটু পরেই গোল্লাছুট খেলা মেঘের দল কেমন জট পাকিয়ে গেল। দুলদুল ঘোড়ার মতো সাদা মেঘগুলো মহিষের মতো কালো হয়ে গেল। কালো হয়ে নিচে নেমে আসতে লাগল। আরো একটু পর এত নিচে নেমে এলো, যেন সামনের পাঁচতলার দালানটার ছাদ ছুঁয়ে দেবে। চারদিক কেমন অন্ধকার।
আচানক আলোর ঝলকানি। তারপরই গুরুম গুরুম শব্দ। শুরু হলো বৃষ্টি। প্রথম ঝিরঝির। ঝিরঝির বৃষ্টির ইংরেজি যেন কী? ড্রিজলিং? তারপর রিমঝিম। রিমঝিম বৃষ্টির ইংরেজি আছে? তারপর একেবারে শেয়াল-কুকুর বৃষ্টি। মানে ক্যাটস এন্ড ডগস।
বিন্নি কিন্তু জানালা থেকে সরল না। সে গেয়ে উঠল- আয় বৃষ্টি ঝেপে/ধান দেব মেপে।
বিন্নির ভাইয়া সন্তু। ক্লাস সিক্সে পড়ে। বলল- তোমার ধান-চাল দেয়ার ধার আষাঢ় মাসের বৃষ্টি ধারে না।
হঠাৎ বিন্নি চিৎকার করে উঠল- ওই যে বাবা!
সন্তু ছুটে গেল জানালায়। বাবা রিকশায় বসে আসে। তার সামনে তিন/চারটে ব্যাগ। ব্যাগ থেকে পুঁই শাক, লাউ বের হয়ে আছে। গেট থেকে সিঁড়ি বেশ একটু দূরে। সিঁড়ি পর্যন্ত রিকশা আসে না। সিঁড়ি পর্যন্ত আসতে গেলেই বাবা ভিজে যাবে। বাবা প্যান্ট গোছাল। স্যান্ডেল খুলে হাতে নিল। একটা ব্যাগ নিল বাঁ হাতে। ডান হাত দিয়ে আরেকটা ব্যাগ টান দিতেই তৃতীয়টা উল্টে পড়ে গেল। তারপর ঘটল আশ্চর্যজনক ঘটনা। বাবা তার হাতের ব্যাগ আর স্যান্ডেল সিঁড়ির পাশে ছুড়ে দিয়েই পানির মধ্যে কি যেন ধরতে শুরু করে দিল। সন্তু তেতলার জানালা থেকে বলল- বাবা, আসব?
– আসবি না মানে? মাছগুলো ধরে নিয়ে যা।
মাছ ধরে নিয়ে যা! ওখানে মাছ এলো কোথা থেকে? সন্তু নিচে দৌড় দিল। সঙ্গে বিন্নিও।
নিচে গিয়ে হতবাক। বড় বড় কৈ মাছ ছুটোছুটি করছে। বৃষ্টির পানিতে ওদের সে কী আনন্দ! সন্তু বলল- বাবা, এখানে কৈ মাছ এলো কী করে?
বিন্নিরও একই প্রশ্ন। বাবা বলল- তোদের মাথায় তো কিচ্ছু নাই, জাস্ট আষাঢ় মাসের বৃষ্টির পানি।
বিন্নি বলল- কেন বাবা?
– দেখলি না আমার ব্যাগ উল্টে পড়ে গেল? একশটা কৈ। প্রতিটির দাম ২০ টাকা। গুনে গুনে ধরতে হবে।
বিন্নি আর সন্তু নেমে পড়ল কৈ মাছ ধরতে। কি বৃষ্টিরে বাবা! যেন বর্শার ফলা। গায়ে এসে বিঁধে। মাছরা তো আনন্দে মাতোয়ারা। বিন্নি আর সন্তু ধরতেই পারে না। চেপে ধরতে গেলেই হাত ফসকে বের হয়ে যায়।
এমন সময় পাশের বাসার মুহিত, নিলয় আর শুভ্র এলো বল হাতে। বৃষ্টির মধ্যে বল খেলবে। বাবা বলল- তোমরা বল খেলা রাখো। আমার মাছ ধরে দাও।
ওরা হাঁ। মুহিত বলল- কী মাছ আঙ্কেল?
– দেখছো না কৈ মাছ ছোটাছুটি করছে?
– বৃষ্টির পানিতে আপনি কৈ মাছের চাষ শুরু করে দিয়েছেন!
শুরু হলো ছয়জনের মাছ ধরা। নিলয় বলল- জাল হলে ভালো হতো।
বাবা বলল- দুই হাজার টাকার মাছ ধরতে এখন তিন হাজার টাকার জাল কিনে নিয়ে আসি আর কি!
ওপর থেকে মা চেঁচিয়ে বলল- এ্যাই কী হচ্ছে ওখানে?
বিন্নি বলল- মাছ ধরছি মা।
– মাছ ধরছি মানে?
– কৈ মাছ। গুনে গুনে একশটা ধরতে হবে। একটা হারিয়ে যাওয়া মানেই ২০ টাকা লস।
অন্য পাশের জানালা থেকে মুহিতের মা বলল- অ্যাই কী হচ্ছে?
মুহিত বলল- আঙ্কেল কৈ মাছের চাষ করেছেন। ধরে দিচ্ছি। ভাজা হলে আমাদের খাওয়াবেন।
বাবা বলল- খাওয়ার চিন্তা তো ঠিকই আছে। কয়টা ধরেছে?
– তিনটা আঙ্কেল। আমার হাতে কানসা দিয়ে গ্যাঁতরা মেরেছে। রক্ত বের হচ্ছে।
– গ্যাঁতরা কী?
– মানে গোত্তা মারা। ঘুড়ি গোত্তা মারে না?
– শব্দ তৈরি করো, না?
বৃষ্টি যেন সাত দিনেও থামবে না। বিন্নির তো প্রায় হাঁটু ডুবে যাচ্ছে। ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় ৯৪টা মাছ ধরা হলো। বাবা বলল- বাদ দে এখন। ছয়টা ধরতে হবে না। ওরা বেঁচে থাক যতদিন পারে।
সবারই শীত করছে। বিন্নির ঠোঁট নীল হয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত ঠুকছে। বাবা বলল- চল, ছাদে গিয়ে গোসল করে ফেলি।
ছয়জন ছাদে উঠে গেল। বাবা যেন শিশু হয়ে গেছে। বলল- আয় পানি ছিটাছিটি খেলি।
দুই ভাগে ভাগ হয়ে পানি ছিটাছিটি। এক পক্ষে বিন্নি, বাবা আর মুহিত। অন্য পক্ষে নিলয়, সন্তু আর শুভ্র।
প্রথম ঝটকায়ই বাবা সন্তুর মুখে এক রাশ পানি ছিটিয়ে দিল। সন্তু কি আবার ছেড়ে কথা বলবে? সেও দিল বাবার গায়ে।
পানি ছিটাছিটি করে সবাই ক্লান্ত। এবার বসল সবাই গোল হয়ে। বাবা বলল- অনেক দিন পর আমি আমার শৈশবের বর্ষায় ফিরে গেলাম।
মুহিত বলল- আঙ্কেল, আপনার শৈশব তো গ্রামে কেটেছে, তাই না?
তা তো বটেই। তখনকার বর্ষা ছিল অন্যরকম। খাল-বিল, নদী-নালা পানিতে টইটম্বুর। পাল তোলা নৌকা। মাঝির ভাটিয়ালি গান। শাপলা-শালুক। কেয়া-কেতকি-কদম্ব। একদিনের কথা। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে মাছ ধরতে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি পুকুর পাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কৈ মাছ। ওরা কানকা দিয়ে হেঁটে পুকুর থেকে উঠে এসেছে। আমি আর বাবা কৈ মাছ ধরে খালুই ভরতে লাগলাম। কি আনন্দময় সময়! সেই বর্ষা এখনও আছে। আছে সেই বৃষ্টি। নেই আমার শৈশব। আমার গ্রাম-প্রিয় জন্মভূমি। বাবা মরে গেলেন এমনই বৃষ্টির দিনে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। বাবা বললেন- মনোয়ার, চল, মাছ ধরে নিয়ে আসি। পুকুর পাড়ে কৈ মাছ উঠেছে। আমি বললাম- বাবা, তুমি সুস্থ হও, তারপর…! বাবা বললেন- আমি তো সুস্থইরে পাগল। এই যে আমি কৈ মাছ ধরতে যাচ্ছি। কত কৈ… কেমন খলবল করছে… বলতে বলতে বাবা মরে গেলেন।
বাবার চোখে জল। বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে বাবার চোখের জল। বিন্নি, সন্তু, মুহিত, নিলয়, শুভ্র বাবার চোখে তাকিয়ে। ওরা স্তব্ধ। আচানক বাবা পরিবেশটাকে কেমন ভারি করে দিল।
বাবা বলল- চল, এবার বাসায় ফিরে যাই।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাবা মুহিত, নিলয়, শুভ্রকে বলল- রাতে কিন্তু কৈ মাছ খেতে আসবে।
মুিহত বলল- সিওর আসব।
– না এলে…! আমার রাগ তো দেখনি…। বাসা থেকে কান ধরে হুরহুর করে টেনে নিয়ে আসব।

-আবুল কালাম আজাদ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়