ইসলামী আন্দোলন : নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের রূপরেখা ঘোষণা

আগের সংবাদ

কুরবানির পশুর দাম বেশি যে কারণে > আফতাবনগর হাট : এখনো জমেনি হাট গরুও উঠেছে কম

পরের সংবাদ

অনিতা সেনের স্মৃতিকথা

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মা বলতেন- কার্স! অভিশাপ! অভিশাপ পড়েছে আমাদের ওপর। ‘অভিশাপ পড়বে কেন মা? আমরা কার অনিষ্ট করেছি?’ বলতে গিয়ে থেমে যাই। দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু বা বোমার আঘাতে দেশের লোকের হত হওয়ার খবর সান্ত¡না হতে পারে না, যার স্বামী মারা গেছে, একমাত্র ছেলে নিখোঁজ।
আমি বাবাকে চলে যেতে দেখিনি। বাড়ি এসে দেখেছিলাম চেনা-অচেনা মানুষের ভিড়। শীতের ঘুমন্ত বাগান। বারান্দায় ওঠার কাঠের সিঁড়িতে নানা মাপের ধুলোমলিন জুতোর সারি। ছোট মাসি আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে আগে আগে যান। মায়ের ঘরের জানালার তাকে বসানো সাদা মসলিনে ঢাকা চিতাভস্মের মাটির ঘড়াটা দেখিয়ে বলেন, ‘ওখানে তোর বাবা। প্রণাম কর।’ বসার ঘরের দেয়ালে বাবার আবক্ষ ছবি ঘিরে মায়ের বাগানের রক্ত লাল রডোডেনড্রন। ছবির নিচের তাকে দুটি আধপোড়া ধূপকাঠি। সাদা থানে মাকে অদ্ভুত লাগছিল। তিনি বাবার মৃত্যুশয্যায় বলা শেষ কথাগুলো এমনভাবে সবাইকে শোনাচ্ছিলেন, তার প্রতিটা কথা যেন দৈববাণী বা নিগূঢ় কোনো অর্থবাহী। মানুষ তো ওপারের ডাক শুনতে পায়, হয়তো বুঝতে পারে তার চলে যাবার সময় হয়েছে! আমি মায়ের পাশ থেকে উঠে এঘর-ওঘর ঘুরে অতিথিদের খোঁজ-খবর নিই। লোকজনের ভিড়ে শোকতাপ যেন গলে তরল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আমার শরীরজুড়ে অসম্ভব ক্লান্তি। তখনো লঙ্গরখানায় ছোটাছুটির ধকল কাটেনি। বাড়িতে বসার মতো একটুখানি জায়গা পেলেই ঘুমিয়ে পড়তাম। রান্না-খাবার-বাজার, বাবার ক্রিয়াকর্ম সবকিছুর দেখাশোনা করছিলেন সুনামগঞ্জ-ময়মনসিংহ-কলকাতা থেকে আসা মামা-কাকারা। বাবা নেই, সেই উপলব্ধিটাই তখন হচ্ছিল না। বাড়ি ফাঁকা হতে আমি আর মা। আর বাবার অশরীরী উপস্থিতি। আমি হঠাৎ হঠাৎ বাবার গলা শুনতে পেতাম পাশের ঘরে বা পোর্চে। কাঠের মেঝেতে এ ঘর থেকে ও ঘরে চটি ঘষে তার হেঁটে চলার শব্দ। গায়ের গন্ধটাও হিমেল বাতাসে ভেসে বেড়াত। একদিন আলমারির ওপর থেকে রেডিওটা নামাতে মনে হলো কার যেন দীর্ঘশ্বাস পড়ল। মা বললেন, ‘পরের দিকে আর রেডিও শুনত না তোর বাবা। তাই পড়ে পড়ে যন্ত্রটায় ধুলো জমে গেছে।’
আমি বারান্দার রোদে বসে ছোট্ট ব্রাশ দিয়ে রেডিও পরিষ্কার করছি। মা কাঠের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে। ‘নীরুকে খবরটা জানানো দরকার।’ তিনি আপনমনেই কি বললেন কথাটা? দেখি আমার জবাবের অপেক্ষা করছেন মা। আমি মাথা নেড়ে ফের ব্রাশ চালাই। ব্যাটারি বদলে দেই। তারপরও দেখি চলে না। পেছনের স্টিলের ঢাকনা সরিয়ে নাড়িভুঁড়ির মতো প্যাঁচানো তারগুলো যে নেড়েচেড়ে দেখব, সে সাহস হলো না। কোনো গণ্ডগোল দেখা দিলে দাদাই টুলবক্স নিয়ে রেডিও সারাতে বসে যেত। ছোটবেলা থেকে যন্ত্রপাতি ঘাঁটাঘাঁটি ওর অভ্যাস। আমি স্টিলের ঢাকনাটা জায়গামতো বসিয়ে দিই। বলি, ‘বাবার সঙ্গে রেডিওটাও গেছে!’
‘মালয়-বর্মা জাপানের দখলে থাকলে কি, ওখান থেকে বেতারযোগে খবর চালাচালি তো হচ্ছে! তোর বাবা বলছিলেন…’
‘কী বলেছিলেন বাবা?’
‘অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে নীরুকে যদি জানানো হয়, নীরদচন্দ্র সেন! নীরদচন্দ্র সেন! আপনার বাবা মৃত্যুশয্যায়, শেষবারের মতো আপনাকে দেখতে চান, তাহলে দু-একদিন পরই বর্মা বা সিঙ্গাপুর বেতার কেন্দ্র নীরুর হয়ে জানাবে, হ্যাঁ আমি আসছি! আমি আসছি!’
দিল্লির অল ইন্ডিয়া রেডিওর বহির্বিভাগীয় কেন্দ্র থেকে কুশল-সংবাদ আদান-প্রদানের কথা আমিও শুনেছি। বর্মা-মালয়ের প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য সরকারের এ ব্যবস্থা। তাও বেসামরিক লোকদের জন্য যারা জাপান-অধিকৃত অঞ্চলে আটকা পড়েছে। দাদা আইএনএর বৈদেশিক প্রোপাগান্ডা বিভাগে। দু-চারবার ওর গলাটা শোনা গেছে। তখন এ রকম খবর আদান-প্রদানের ব্যবস্থা নেয়নি ও। তাহলে তো বাবার নাম-ঠিকানাও প্রচার করতে হতো। এমনিতেই সরকারের চোখে দাগি বাবা। সঙ্গে সঙ্গে স্পাই লেগে যেত। ছেলে আইএনএ। বাবা কংগ্রেসি নাশকতাকারী। একেবারে সোনায় সোহাগা। তাই হয়তো বাবাও নিজে থেকে কোনো উদ্যোগ নেননি। কিন্তু সে সব ভুলে মৃত্যুশয্যায় দাদাকে দেখতে চেয়েছিলেন! অসম্ভব এক আবদার করে গেছেন বাবা। দাদা কোনো দিন জানতে পারলে মনে বড় দুঃখ পাবে।
মা কথা বলেই যাচ্ছেন। তার ইচ্ছা, অল ইন্ডিয়া রেডিও মারফত বাবার মৃত্যুসংবাদটা জানাই দাদাকে। তাহলে ও বাড়ি না এসে পারবে না।
এ কি প্রলাপ? নাকি মায়েরও তা শেষ ইচ্ছা? আমি নষ্ট রেডিওটা বারান্দায় রেখে ঘরে চলে আসি। নিজেকে বড় অসহায় লাগছিল। ভাবছিলাম, কমরেড অকে ফোন করলে কেমন হয়। ফরোয়ার্ড ব্লকের কেউ নিশ্চয় গোপনে বর্মা ফ্রন্টিয়ারের দিকে যায়, নেতাজির সঙ্গে যোগ দিতে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-বুথিডং-মংডু। নাফ, ইরাবতী, মায়ুনদী। কতদিনের চেনা সব নদী আর জনপদের নাম! সেসব জনপদ এখন যুদ্ধের আগুনে জ্বলছে। মুখে মুখেও যদি খবরটা পৌঁছানো যেত দাদার কাছে!
কমরেড কথার মাঝখানে আমাকে থামিয়ে দিল। বলল, দুদিন পর শিলং আসবে, তখন সামনা-সামনি কথা হবে। এসেই জোরে ধমক, ‘আমি কি পঞ্চম বাহিনীর এজেন্ট যে, বর্মা ফ্রন্টিয়ারে কে বা কারা যায়, আমাকে গোপন তথ্য দেবে?’ মা পাশের ঘরে। আমি ওকে আস্তে কথা বলতে বললাম। কমরেডকে বিশ্বাস করি বলেই তো ফোনে কথাটা বলেছি! আমার গাল বেয়ে জলের ধারা নামলো। আমি কি দাদার জন্য কাঁদছি? বাবার জন্য কাঁদছি? বাবার মৃত্যুর সময় কাছে থাকতে পারিনি পার্টির কাজের জন্যই তো। পার্টি যদি আমাকে সরকারি রিলিফ-কিচেন তদারকিতে মৌলভীবাজার না পাঠাত, ঠিকই সময়মতো আসতে পারতাম। প্রথম টেলিগ্রামটা পেলাম তিনদিন পর, যখন কাঠের হাতায় তুলে কলাপাতায় খিচুড়ি বিলাচ্ছি। যে খিচুড়ি খেয়ে দাস্তবমি করে মরে ক্ষুধার্ত মানুষ। তারপরও থাকতে হলো আরো দুদিন। আমাকে বলা হলো, ভলান্টিয়াররা করিমগঞ্জ থেকে আসবে, তারপর তোমার ছুটি। সিলেটে ফিরে পরের টেলিগ্রাম যখন পাই, ততদিনে সব শেষ। এ সমস্ত কথাই সম্ভবত চোখের জল মুছতে মুছতে বলেছিলাম সেদিন। কমরেড অপ্রস্তুত হয়ে পাতার বিড়ি ধরাল। কি বাজে গন্ধ! প্রচণ্ড শীত সত্ত্বেও ঘরের জানালা খুলে দিলাম। চা খেতেও বললাম না একবার। অ্যাসট্রেতে বিড়িটা নিভিয়ে জোসেফ স্ট্যালিনের ‘দ্ব›দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ বইটা ঝোলা থেকে বের করল কমরেড। আমি যেহেতু মাঠে নেই, আমাকে এখন বই পড়তে হবে। তা যত তেতোই হোক। মন খারাপের বাহানা আর কতদিন? জন্মালে মরতেই হয় মানুষকে। এ প্রাকৃতিক নিয়ম। তবে পার্টি অতটা দায়িত্বহীন নয় যে, মায়ের একা থাকার সমস্যাটা বোঝে না। এটুকু বলে জল খেতে চাইল। তার নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা শুনে মনে হলো, আমার সঙ্গে দেখা করাটা পার্টি অনুমোদন করলেও গুরুদায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে, যাতে শোকের সমুদ্রে ডুবে আমি আত্মবিস্মৃত না হই। আফটার অল আমি তো পার্টির কার্ডহোল্ডার। দায়িত্বটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে বলে গোবেচারার প্রতি মায়াই হচ্ছিল। দেখলাম মনে মনে একটুখানি রেগেও যাচ্ছি। আমি তো শোকের সমুদ্রে ভেসে থাকতেই চাই। তার জন্য সামান্য খড়কুটো বা একখানা তক্তা চাই তো! ঘরে আমরা দুজনই শুধু। একটুখানি হাত ধরে আমাকে পাশে বসালে বাম-বিচ্যুতি ঘটত ওর? আমি গøাসে করে জল এনে দেখি এবার ঝোলা থেকে জনযুদ্ধ-এর টাটকা কপি বেরিয়েছে। পার্টির বাইরে সাধারণের মাঝে পত্রিকাটির গ্রাহক বাড়ানো দরকার। শিলংয়ে চাকরিবাজ কেরানি, ছাত্র-ছাত্রী, স্বাস্থ্যান্বেষী হাওয়া-খোর মিলিয়ে এ যুদ্ধের বাজারেও বাঙালি পপুলেশন কম নয়। আপাতত এ কাজটা তো করতে পারি?

আমি বললাম, তথাস্তু।
কমরেড চলে গেলে আমি ভাবতে বসলাম। মাকে কী বলব? মা তো আশা করে আছেন, বাবার মৃত্যুসংবাদ দাদার কাছে পৌঁছে দিতে পারবে। তারপর মনে হলো এমন আশা করাটাই অন্যায়, যেখানে ইন্দো-বার্মা সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মাকে বোঝাবার মতো একখানা খবরও পেয়ে গেলাম ২৩ ফেব্রুয়ারির জনযুদ্ধের প্রথম পাতায়।
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪, ফরোয়ার্ড ব্লকের ইশতেহার- নেতাজি সুভাষ বসুর নেতৃত্বে ভারতীয় মুক্তিফৌজ তাহাদের মিত্রশক্তি অপরাজেয় জাপানি সেনাবাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া ভারতের দিকে অগ্রসর হইতেছে। হে বাংলার জনগণ তোমরা বিদ্রোহ করো। নেতাজি বোসের সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করো।
‘কীভাবে সহযোগিতা করব?’ মা চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমি বললাম, ‘আপাতত বাড়ির পেছনে ট্রেঞ্চ কাটতে পারি। দাদাকে খবর পাঠাবার দরকার নেই। ও তো আসছেই।’ মা আমার কথা বিশ্বাস করেছিলেন। ডাকে জনযুদ্ধ এলে আমার আগে মা-ই টেনে নিয়ে পড়তে বসতেন। রেশনে খারাপ চাল কেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তাই মাগ্গিভাতা বাড়াতে হবে, লবণ চোরাদের শায়েস্তা করো, বাজার থেকে কুইনিন উধাও, কয়লা নিয়ে কচকচানি চলবে না, কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে কী করছে লীগ সরকার…
‘সবই দরকারি কথা।’ মা বললেন, ‘কিন্তু ভাষাটা দুর্বল কেন?’
‘দুর্বল নয়, মা।’ আমি বলি, ‘খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের বোঝবার উপযোগী ভাষা এটি।’
‘ক’জন খেটে খাওয়া মানুষ পড়তে জানে?’
লাগসই প্রশ্ন বটে। মা যে কিছুটা হলেও অতীতের মতো দেশকাল নিয়ে ভাবছেন, তর্ক করছেন, মনে মনে খুশি হই আমি। মুখে বলি, ‘আমরা পড়ে শোনাই মা, যারা পড়তে জানেন না।’
মাকে উত্ত্যক্ত করত বেশি জনযুদ্ধ-এর পঞ্চমবাহিনী সংক্রান্ত খবরগুলো। তার মন খারাপ হবার মতো একটি-দুটি খবর থাকতই প্রতিটা সংখ্যায়। অবশ্য জাপানিদের অগ্রগতি নিয়ে জনযুদ্ধ-এর কটূক্তি গায়ে মাখতেন না মা। লালফৌজের সাফল্যগাঁথাও রীতিমতো উপভোগ করতেন। বলতেন হিটলারের মতো লোককে ঘৃণা করাই উচিত। একদিন দেখি জাপানিরা মংডু থেকে হটে গেছে শুনে মায়ের ভীষণ মন খারাপ। আমি বললাম, ‘সে তো আরাকান সীমান্তে, মা। দেখোই না কোহিমা-ইম্ফলে কী হয়!’ সত্যি সত্যি পরের সপ্তাহে জাপানিদের ইম্ফল অবরোধের খবর। জাপানি না বলে আমি আর মা বলতাম, আইএনএ অবরোধ করে রেখেছে ইম্ফল। ডিমাপুর থেকে ইম্ফল তো মাত্র ১৩২ মাইল। নাগা পাহাড়ের ওপাশে, এখনকার মণিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল।
ইম্ফল-ইম্ফল! অনেক দিন পর মায়ের গলায় মিষ্টি সুর। দুজনে নিড়ানি হাতে বাগানে নামলাম। এবার কাঁচালঙ্কা-মুলো-শালগমের চারা বুনেছি বাগানের এক পাশে। ফলেছেও বেশ। কচি মুলোশাক খেতে দিচ্ছেন না মা। বলেন যুদ্ধ শেষ হোক। যার অর্থ নীরু ফিরে আসুক। মাঝে মাঝে আমার হিংসে হতো। ছেলে বলে কথা! আলু খেয়ে খেয়ে মুখ পচে গেলেও বাগান থেকে রবিশস্য তোলা যাবে না। আমার জন্য কি কাঁচালঙ্কা গাছেই লাল হয়ে পচতে দিতেন? মুলো-শালগমও তো পেকে ঝুনো হয়ে যাচ্ছে। তবে আমাদের দিনগুলো তেমন খারাপ যাচ্ছিল না। বাবার না থাকার দুঃখটা যেন দাদার আগমনের উত্তেজনায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। যদিও তখন থেকেই আমাদের টাকাকড়ির টানাটানি শুরু। যুদ্ধ-মন্বন্তরে কে-ই বা সচ্ছল তখন! আসাম প্রদেশ বাংলার মতো দুর্ভিক্ষে তছনছ না হলেও সবজি-মাছ কিছুই মিলত না। মাছের ওপর আইনত কন্ট্রোল ছিল। লবণেরও সংকট। বাজারে কয়লা নেই। কেরোসিন নেই। বিদ্যুৎ সরবরাহ কম। তাই কাঠের চুলোয় কোনোরকমে আলুনি আলুর তরকারি আর দুর্গন্ধযুক্ত রেশনের চালের ভাত রেঁধে খেতে হচ্ছিল। রেশন না জুটলে খোলাবাজার থেকে কাঁকরমিশ্রিত চাল কিনে ফ্যান-ভাত। আমন ধান ওঠার পর বাজারে চাল পাওয়া গেলেও তখন মণপ্রতি দাম ছিল ষোল-সতের টাকা। আমাদের মা-মেয়ের কোনোক্রমে চলে যাচ্ছিল।
বোমার ভয়ে সপরিবারে মর্নিংস্টার বাড়ি চলে গেছে। ৪২ সাল থেকেই আমাদের সোফা নেই। এক যুগের পুরনো ড্রাইভার, সেনাবিভাগে নাম লেখালে বাবা আর নতুন করে কাউকে নেননি। ততদিনে আগস্ট আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। সুসময়েও ভোগ-বিলাসের জীবন ছিল না আমাদের। তবু ছিমছাম, মার্জিত খাওয়া-পরার পরিপাট্য নষ্ট হতে শুরু করে বাবার মৃত্যুর পর থেকে। যুদ্ধ-মন্বন্তরে গা ঢেকে এলেও তা ঠাঁই গেড়ে বসে। আশা-নিরাশার দোলায় দোলদোলানো মা আর আমার জীবন, তাই ঠাহর হয়নি। সে সময় জনযুদ্ধ-এর গ্রাহক বাড়ানোর পাশাপাশি আমি দুটি টিউশনি করতাম। সপ্তায় সপ্তায় চিঠি আসত কমরেড অর কাছ থেকে। যদিও জনযুদ্ধ ও পিপলস ওয়ারের নতুন গ্রাহকের লিস্ট চেয়ে। তখনো তো আমি সিলেট শাখার পার্টি সদস্য, কাগজে-কলমে সুরমাভ্যালির কমিউনিস্ট। শিলংয়ে ধরেবেঁধে জনা পঞ্চাশেক গ্রাহক বানিয়েছিলাম ঠিকই, তারা ডাকযোগে টাকা পাঠাতে নারাজ। তাই বাড়ি বাড়ি ঘুরে টাকা তুলতে হতো। প্রতি কপি পত্রিকার দাম ছ পয়সা। যুদ্ধের বাজারে খুচরো পয়সার খুব আকাল। তাতে বেশ নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছিল। পত্রিকার টাকা জমা দিতে সপ্তাহান্তে পার্টি অফিসে যেতাম। তবে সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরতে হতো। ঘরে বসে চিন্তা করতেন মা। তখন কয়েক মহাদেশের সৈন্যশিবির শিলংয়ে। রাস্তাঘাটে মেয়েরা নিরাপদ নয়। লরিতে কখন তুলে নেবে! দেশের অন্যত্র রেলযোগে কোথাও যাবার আগে দশবার ভাবতে হতো। পত্রিকায় খবর আসত, সেনা চলাচলের রাস্তার পাশের ছোট-বড় শহরগুলো ব্রথেলে ছেয়ে গেছে। চট্টগ্রামের দোহাজারির মতো অখ্যাত জায়গাতেও তখন নতুন গজানো পতিতাপল্লী। তা ছাড়া ওসব অঞ্চল থেকে সেনাদের নারী ধর্ষণ আর হত্যাকাণ্ডের খবর আসছিল, যা নিয়ে বাংলার গভর্নর জন হারবার্টের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের তিক্ততা বাড়ে। আগেই দুজনের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়ে গিয়েছিল বাংলা মুলুক থেকে চাল সরানো তথা ডিনায়্যাল পলিসিকে কেন্দ্র করে। তারপর তো মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে তাকে ইস্তফাই দিতে হলো ১৯৪৩ সালের মার্চ মাসে।
১৯৪৪ সালের বসন্তে আমাদের বাগানটা ফুলে ফুলে সেজে উঠেছিল। রঙে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। গন্ধে পুরো বাড়ি মাতোয়ারা। মা বলতেন, এ সুলক্ষণ। নীরু যত এগিয়ে আসছে, ততই বাগানের জলুস বাড়ছে। ও বাগানের সবজি খেতে না পারুক, ফুলের সম্ভার তো দেখতে পাবে! আর এটাই দরকার। যুদ্ধ মানুষের লালিত্য, কমনীয়তা নষ্ট করে দেয়। ফুল আর সংগীতই পারে সেই মানবিকবোধটুকু চট করে ফিরিয়ে আনতে।
মাকে নিরাশ করতে চাইতাম না আমি। বাগান নিয়ে পড়ে আছেন, তা বেশ। ফুল ফোটাবার মধ্যে নেই আমি। ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’, আমার মনে মনে গুঞ্জন।
বাংলা-আসাম মৈত্রী-বন্ধনের সফরে বেরিয়েছে ছাত্র ফেডারেশন। সঙ্গে কবি-শিল্পী। খবরটা পাওয়া মাত্র মনটা নেচে ওঠে। বাড়িতে বসে বাগানে নিড়ানি দেবার সময় নাকি এখন! ‘ওই কোহিমা, ওই মণিপুর/ আমার দেশের সীমা রে…’ শিল্পীরা দেশরক্ষার গানটি গেয়ে উঠতে নাচতে লাগল বিশালদেহী কাফ্রি সৈন্যরা। আমেরিকান, ব্রিটিশ সৈন্যরাও টিকেট কেটে অনুষ্ঠান দেখতে এসেছে। ভিড়ের মধ্যে দেখতে পেলাম রঞ্জিনীকে। সত্যি সত্যি ও বেশ রোগা হয়ে গেছে। বাড়ি ফেরার পথে বললাম, ‘ডায়েটিং করিস?’ মাথা নাড়ল ও। গত এক মাস রবার্টের খোঁজ নেই। সপ্তাহখানেক আগের খবর, কোহিমা-ডিমাপুর অঞ্চলে তুমুল লড়াই চলছে। বিষেণপুরে নেমেছে জাপানের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা। বোঝাই যাচ্ছে, যে কোনো মূল্যে ইম্ফলের বিমান-ঘাঁটি আর রসদ কব্জা করতে চায়। ইম্ফল নিয়ে দুই পক্ষই তো জান কবুল। মরছেও নিশ্চয় দেদার। কিন্তু সঠিক হতাহতের খবর জানবার উপায় নেই। পত্রিকা জাপানিদের মৃত্যুসংবাদই শুধু ফলাও করে ছাপে। ওদের সঙ্গে তো দাদাও রয়েছে।
ইদানীং পত্রিকার রণাঙ্গনের পাতাটা আগে-ভাগে সরিয়ে রাখি। মাকে পড়তে দেই না। কিন্তু রঞ্জিনীকে বলতে তো বাধা নেই! ও সবই জানে। বসন্ত-শেষের হাওয়া গায়ে মেখে আমার পথ চলতে বেশ লাগছিল। রোজ ঘড়ি ধরে বাড়ি ফিরতে হয় বলে হাঁপিয়ে উঠেছি। ছাত্র ফেডারেশন অনুষ্ঠানে না এলে মোম জ্বেলে ঘরে বসে থাকতে হতো। এখন ঠুলি-পড়া গ্যাসের বাতির নিচে আমি আর রঞ্জিনী। বাতাসে পাইনের সুবাস। আমাদের পাশ দিয়ে হুস হুস বেরিয়ে যাচ্ছে মিলিটারি লরি। চলন্ত আর্মাড কারের পিঠ ফুড়ে সঙ্গীন উঁচানো গোরা ফৌজ।
‘আমাদের কি কপাল, দেখ!’ রঞ্জিনীকে আমি ফিসফিসিয়ে বলি, ‘চোখের সামনে বিশ্বযুদ্ধ দেখছি। বেঁচে থাকলে নাতিপুতিকে বলতে পারব কথাটা।’ একটুখানি করুণ হাসে রঞ্জিনী। ‘আমার নাতিপুতি হলে তো! বিয়েই করব না।’ ‘ও কথা সবাই বলে।’ বলেই আমার মনে হলো, রঞ্জিনী কি রবার্টকে মৃত ভাবছে? নাকি রবার্ট যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচে ফিরলেও ও জানে ওদের বিয়ে হবে না? দেশে ফিরে যাবে রবার্ট। প্লিমাথ কি ডোবার বন্দরে ফুল হাতে বরণ করতে আসবে ওর কোনো স্বর্ণকেশী বান্ধবী। তাছাড়া দুজনের বিয়ে না হওয়ার আর কী কারণ? রবার্ট আমেরিকান হলে না হয় কথা ছিল। আমেরিকার নতুন অভিবাসী আইনে ভারতীয় বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েরা আমেরিকান নাগরিককে বিয়ে করে ওদেশে ঢুকতে পারবে না। খবরটা শুনে কবি জন বার্ডের মুখ কালি। ‘খুবই সুপরিকল্পিত বর্ণবাদী আইন, যা কেবল পুঁজিবাদী দেশের পক্ষেই প্রণয়ন সম্ভব।’ কথাটা ধরা গলায় বলেছিল আমেরিকান কমিউনিস্ট কবি বার্ড। কিন্তু ব্রিটিশ নাগরিক রবার্ট আর ভারতীয় রঞ্জিনীর বিয়ের পথে তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় বাধা নেই। ওরা চাইলে করতেই পারে। নাকি বিয়েতে বিশ্বাসী নয় দুজন? তাই কি অবিবাহিত থাকবার পণ করেছে রঞ্জিনী?
আমার বিয়ের বছর দুই আগে বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করে রঞ্জিনী। তখন বলেছিলাম, ‘কিরে, করলি তো বিয়ে। আনম্যারেড রইলো কে- তুই না আমি?’
সেদিন শিলংয়ের রাস্তায় রাস্তায় রাতভর ঘুরে বেড়াতে চাইছিলাম আমি। রঞ্জিনীর বাড়ি ফেরার তাড়া। সারাটা দিন বাইরে ছিল। মুখে বলল না যে, রবার্টের যদি চিঠি আসে, তাই বাড়ি যাচ্ছি। ছাত্র ফেডারেশনের দলটির সঙ্গে আমার খুব ডিব্রুগড় যাবার ইচ্ছা। রঞ্জিনীকে সাথী পেলে বেশ হতো। আমার প্রস্তাবটা নাকচ করে দিয়ে ও তিক্তস্বরে বলে, ‘ফেডারেশনের ভ্যারাইটি শোতে আমি কী করব? আমি কি গান গাইতে জানি? জনসভায় বক্তৃতা দিতে পারি!’
আজ রঞ্জিনীর মুখ মেঘলা আকাশের মতো থমথমে। ও যদি এভাবে রেগে না গিয়ে কেঁদে ফেলত, আমার কিছু করার ছিল। আমি রবার্টের মতো ওর দিকে রুমাল এগিয়ে দিতাম। এত রাগ আসলে কার ওপর রঞ্জিনীর? খানিক আগেই দিব্যি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গায়কদের দেশরক্ষার গান শুনছিল। বিজন ভট্টাচার্যের অভিনয় শেষে ক্ল্যাপ দিতেও দেখলাম জোরে জোরে। আমার গায়ে-পড়া স্বভাবটাই হয়তো ওর অপছন্দ। ওদিকে ডিব্রুগড় যাবার ইচ্ছা তো আমার ষোলোআনা। তাই মিউ মিউ করে বললাম, ‘আমিও কি গান গাইতে জানি? আর বক্তৃতার কথা যদি বলিস- কলকাতার বড় বড় ছাত্রনেতারা রয়েছেন, স্থানীয় কংগ্রেস-মুসলিম লীগারদেরও মঞ্চে তোলা হচ্ছে। আমরা ছাই চান্স পাব! কেউ ফিরেই তাকাবে না!’ তাহলে কেন যেতে চাইছি? রঞ্জিনী প্রশ্নটা করলে আমার অনেক কিছু বলার ছিল। ও আর কথা বাড়াল না। কমরেডসুলভ হাত মিলিয়ে চললো বাড়ির দিকে।

প্রথমা প্রকাশনী থেকে অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তে প্রকাশিত ‘অসুখী দিন’ উপন্যাস থেকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়