খরায় পুড়ছে জনজীবন : আরো বাড়তে পারে তাপপ্রবাহ

আগের সংবাদ

দলীয় নেতাকর্মীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী : দেশি-বিদেশি চক্রান্ত হতে পারে, তাই সতর্ক থাকুন

পরের সংবাদ

শুভ নববর্ষ

প্রকাশিত: এপ্রিল ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জানালায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে বাঁশিতে একটা সুর তুললো বুলবুলি। সাথে সাথে কাছাকাছি কোথাও একটা কোকিলও ডেকে উঠলো, কুউউ। বুলবুলির বাঁশির সুর যত উঁচুতে উঠছে, কোকিলের গলার স্বরও পাল্লা দিয়ে চড়ছে। বুলবুলি হঠাৎ করেই তার বাঁশিটা থামিয়ে দিল। কোকিলটাও সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল। তারপর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। পুব আকাশের টকটকে কমলা রঙের সূর্যের আলো এসে পড়েছে বুলবুলির চুলে। সেই আলোতে তার চুলগুলো যেন কমলা আভা ছড়াচ্ছে। বাতাসে খানিকটা চুল এলোমেলো হয়ে তার মুখে এসে পড়লো। মাথাটা দুপাশে ঝাঁকাতেই চুলগুলো মুখের ওপর থেকে সরে গেল। একটু পর সে আবার সুর তুললো বাঁশিতে। ঠিক সাথে সাথেই কোকিলও শুরু করলো তার কুহুতান। বুলবুলি বেশ মজা পেয়ে গেল। সে ইচ্ছে করেই তার বাঁশির সুর উঁচুতে উঠাতে শুরু করলো। কোকিলও যথারীতি গলার আওয়াজ বাড়াতে থাকলো। বেশ কিছুক্ষণ চললো এই খেলা। চার পাঁচবার এমন করে সে হাত থেকে বাঁশিটা নামিয়ে রাখলো। কোকিলটাও যেন ক্লান্ত হয়ে তার গলা সাধা থামিয়ে দিল।
– বাহ্! কি সুন্দর বাঁশি বাজাও তুমি।
একটা পুরুষালী কণ্ঠে এমন কথা কানে যেতেই চমকে ঘুরে তাকালো সে। উল্টো দিকে ঘুরে বসায় তাকে এতক্ষণ দেখতে পাায়নি। ২৫-৩০ বছর বয়সি একটি ছেলে সকালবেলা দৌড়াতে বেরিয়েছে। পরনে তার নীল রঙের ট্রাউজার আর সাদা টিশার্ট। মাথায় একটা সাদা স্পোর্টস ক্যাপ।
মুখটা আবার ঘুরিয়ে নিয়ে বুলবুলি বলল, ধন্যবাদ।
– কার কাছে শিখেছো এমন সুন্দর বাঁশি বাজানো?
– আমার বাবা। তিনি গান করেন।
– তাইতো বলি! রক্তে না থাকলে এমন সুর বের হতে
পারে না।
– আমার মাও গান করে।
– তাই নাকি! কি নাম তোমার?
– বুলবুলি
– বাহ্ সুন্দর নাম। তা তুমি মুখটা এমন ঘুরিয়ে রেখেছো কেন? আমি কিন্তু খারাপ মানুষ নই।
– আমার মুখে জলবসন্ত হয়েছে। আমাকে দেখতে খুব বিশ্রী লাগছে। আমার দিকে তাকালে আপনারও হবে।
– হাহাহাহাহা… নাহ আমার হবে না। তুমি নির্ভয়ে আমার দিকে তাকাতে পারো।
– বুলবুলি এবার ঘুরে তাকালো ছেলেটির দিকে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেন হবে না?
– আমার একবার বসন্ত হয়ে গেছে। আর যার একবার বসন্ত হয় তার শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। তার আর সহজে বসন্ত হয় না। আর তোমার গোটাগুলোতো সব শুকিয়েই গেছে। আর দুয়েকদিনের মধ্যেই দেখবে মুখটা আগের মতো হয়ে গেছে। তাই তুমি আর কষ্ট পেও না।
বুলবুলির মুখটা খুশিতে ভরে উঠলো। সেই উচ্ছ¡াস ফুটে উঠলো তার গলার স্বরেও। সত্যি বলছেন? আমি তাহলে নববর্ষের দিন ব্যান্ডের গান শুনতে যেতে পারবো?
– কিসের ব্যান্ডের গান বলোতো?
– ওমা আপনি শোনেননি? শিমুলতলী ক্রীড়াচক্র খেলার মাঠে নববর্ষের দিন বিকেলবেলা কনসার্ট হবে। শহর থেকে বড় ব্যান্ডের দল আসবে। আমার ব্যান্ডের গান শুনতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু বাবা বলেছে যতদিন আমি সুস্থ না হবো ততদিন বাসা থেকে বের হতে পারবো না।
– নববর্ষ আসতে তো আরো কিছুদিন বাকি আছে। দেখবে ততদিনে তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।
বুলবুলি আর ছেলেটির মধ্যে কথা হচ্ছিল রাস্তায় দাঁড়িয়ে। বুলবুলিদের টিনের ঘরের পাশ দিয়ে একটা পায়ে হাঁটা পথ আছে। সাইকেল আর ভ্যান ছাড়া কোনো ভারি যান চলে না এ পথে। মাঝে মাঝে একটা দুটো রিকশা চলে। কোনো পাঁচিল না থাকায় জানালা দিয়ে রাস্তার লোকজনের সাথে কথা বলা যায়। বুলবুলি দেখলো তার বাবা আর মা হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে আসছে। গতরাতে তাদের একটা গানের আসর ছিল। অন্য সময় বুলবুলিও সাথে যায়। এবার যেতে পারেনি। দাদা-দাদির সাথে তাকে বাড়িতেই থাকতে হয়েছে।
বুলবুলি বললো, আমার বাবা-মা আসছেন।
ছেলেটি মাথা ঘুরিয়ে দেখলো দুজন মানুষ হেঁটে আসছেন। একজনের পরনে সাদা পায়জামা আর লাল পাঞ্জাবি। মাথায় একটা লাল কাপড় বাঁধা। তাতে কপালের অর্ধেক আর চুলের অর্ধেক ঢেকে আছে। মাথার কোঁকড়া চুলগুলো ঘাড় পর্যন্ত লম্বা। হাতে একটা একতারা আর কোমরে একটা ছোট তবলার মতো দেখতে বাদ্যযন্ত্র বাঁধা। মহিলাটির পরনে একটা লালপাড় হলুদ তাঁতের শাড়ি। আর কাঁধে একটা বড় কাপড়ের ব্যাগ ঝুলানো। চুলগুলো খোঁপা করে বাঁধা। খুব সাধারণ একটা বাঙালি দম্পতি।
আপনাকেতো ঠিক চিনতে পারলাম না? আগন্তুক ছেলেটিকে দেখে বুলবুলির বাবা জানতে চাইলেন।
– আমার নাম শান্ত। জগিং করতে বেরিয়েছিলাম। বুলবুলির বাঁশির সুর শুনে থামতে হলো।
– বুলবুলি আমার মেয়ে। আমার নাম লোকমান হাকিম। লোকে লোকমান বয়াতী নামেই চিনে। তারপর স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার সহধর্মিণী, আমার সংগীতজীবনের সাথী।
শান্ত বললো, আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। তবে আরো ভালো লাগতো যদি আপনাদের গলায় দু’লাইন গান শুনতে পারতাম।
– বেশতো ঘরে আসুন। বসে আলাপ করা যাবে।
লোকমান বয়াতী শান্তকে নিয়ে ঘরে আসলেন। শান্ত দেখলো বসার ঘরটা নানারকম দেশীয় বাদ্যযন্ত্রে ঠাসা। পাশের ঘর থেকে বুলবুলি একটু পরপরই বাবা আর মায়ের গানের গলা শুনতে পাচ্ছে। একবার বাবার গলায় শুনতে পেল, আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল। একটু পরে আবার শুনলো, নিম তিতা নিশিন্দা তিতা তিতা পানের খয়ের। এবার মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে, লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি ভালা না আমার।
গান শুনতে শুনতে বুলবুলির দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। বুলবুলি স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খেলার মাঠে কনসার্ট হচ্ছে। শত শত দর্শকে মাঠটা ভরে গেছে। স্পিকারে কানফাটানো শব্দ। ড্রাম, গিটার, কি বোর্ডের বাজনা। এত শব্দে একটা গানের কথাও বুলবুলি বুঝতে পারছে না। শুধু দেখছে গানের সাথে সাথে শত শত মানুষ নাচছে। বুলবুলিরও খুব নাচতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে অনেক চেষ্টা করেও নাচতে পারছে না। গিটারের শব্দে তার কানে তালা লেগে যাচ্ছে। সে দুই হাতে কান চেপে বসে পড়লো, উফ! এমন সময় সে একটা দোতারার সুর শুনতে পেল। কী মধুর সেই সুর। বুলবুলি বুঝতে পারলো তার ঘুমটা ভেঙে গেছে। সে শুনতে পেল বাবা দোতারা বাজিয়ে গান গাইছে, ভালো করিয়া বাজাও গো দোতারা সুন্দরী কমলা নাচে। সে দেখলো জানালার রোদটা সরে গেছে। বেলা বোধ হয় অনেক হলো।
আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। বুলবুলি গোসল করে একটা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরেছে। শাড়িটার পুরো জমিনে ডুগডুগি আর হাতপাখার ছাপ আঁকা। গতকাল বাবা শাড়িটা এনে দিয়েছে তাকে। মেয়েটার চুলগুলো বেশ লম্বা। খোলা চুলে আর লালটিপে মেয়েটাকে কি মিষ্টি দেখায়। হালকা দু’একটা দাগ ছাড়া বুলবুলি এখন পুরোপুরি সুস্থ। রান্নাঘর থেকে ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল সে মাকে বলেছিল, মা, আমরাতো সবসময় কেবল পান্তাভাত আর আলুভর্তা খাই। ইলিশ মাছ ভাজা কেন খাই না? মা বলেছিল, আজ সকালে বাবা ইলিশ মাছ আনবে। মা ভেজে দিবে। এই প্রথম বুলবুলি ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তাভাত খাবে।
খাওয়া শেষে হাত ভরে কাঁচের চুড়ি আর আলতা পরে তৈরি হয়ে নিল সে। বিকেলে শিমুলতলী ক্রীড়াচক্রের খেলার মাঠে অনুষ্ঠান আছে। এরই মধ্যে লোক জমতে শুরু করেছে সেখানে। মা-বাবা তাড়া দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি বের হতে হবে।
মা-বাবাকে নিয়ে বুলবুলি পৌঁছে গেল খেলার মাঠে। মাঠের তিন দিক ঘিরে বৈশাখীমেলা বসেছে। বড় একটা মঞ্চ করা হয়েছে ঠিক কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে। গাছে লাল লাল থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে। কি সুন্দর লাগছে গাছটাকে। মাঠজুড়ে ছেলে, মেয়ে, বাচ্চা, বুড়ো অগুনিত মানুষ। সবাই আজ গান শুনতে এসেছে। নাহ আজ এখানে কোন ব্যান্ডের গান হবে না। মঞ্চে গান গাইবে তার বাবা লোকমান বয়াতী, মা শিরীন বানু আর পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া বুলবুলি নিজে। বুলবুলির আজ এত আনন্দ হচ্ছে! এত খুশি সে জীবনে কোনদিন হয়নি। এই প্রথম সে নিজের এলাকার অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজাবে। শান্ত নামের ছেলেটিই সব ব্যবস্থা করেছেন। শিমুলতলী ক্রীড়াচক্রের সাধারণ সম্পাদক তিনি। তিনিই সেদিন বাবার গান শুনে বাবাকে অনুরোধ করে এসেছেন।
বুলবুলিদের আসতে দেখে শান্ত আরো দুজনকে সাথে নিয়ে এগিয়ে এলেন তাদের স্বাগত জানাতে। অভিবাদন জানিয়ে বললেন, শুভ নববর্ষ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়