প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন

আগের সংবাদ

নবম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপা বন্ধ : অর্ধেক বই নিয়েই পাঠ্যপুস্তক উৎসব ১ জানুয়ারি, মাঠে নামল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর

পরের সংবাদ

রংতুলির মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাস থেকে নামিয়ে সারি সারি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল বিভিন্ন বয়সি প্রায় ১৫ জন পুরুষকে। নানা রকম প্রশ্নের পর তাদের মাঝ থেকে তিনজনকে আলাদা করে চোখ বেঁধে জঙ্গলের দিকে নিয়ে গেল পাকিস্তানি সৈন্যরা। বাকিরা এক এক করে উপরে উঠে পড়তেই বাস ছেড়ে দিল দ্রুতবেগে।
এক রাশ এলোমেলো ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাপটা মেরে গেল টুকুমনির চোখে-মুখে। মনে হচ্ছিল যেন পেছনে তাড়া করে আসছে একদল হিংস্র হায়েনা। নেমে যাওয়া পুরুষদের মাঝে টুকুর সাদাসিধে বাবাটাও ছিলেন। ভাগ্যিস তাকে ছেড়ে দিয়েছে ওরা!
বাস চলা শুরু হতেই এতক্ষণ ধরে দম আটকে রাখা মহিলা যাত্রীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কান্নার শব্দ ভেসে আসতেই ছোট্ট টুকুর বুকের ভেতর কেমন এক চিনচিনে ব্যথার জন্ম নিল।
জন্ম থেকেই দেখে আসছে, আব্বাটা কেমন যেন চুপচাপ ধরনের। সারাদিন ছবি আঁকা-আঁকি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আম্মা সরকারি চাকরিজীবী। খুব সাহসী মানুষ। অন্য মহিলাদের মতো তিনি ভয়ে কাঁদলেন না। অফিস থেকে আম্মা ফেরার পর কোনোরকম নাকে-মুখে দুপুরের ভাত খেয়ে বেরিয়ে এসেছিল তারা, গন্তব্য দাদু বাড়ি।
গ্রামে এসেও খুব একটা খুশি হতে পারল না টুকুদের পরিবার। পাশের গ্রামে প্রাইমারি স্কুলে রাজাকার আর পাকবাহিনীর বিরাট ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। যে কোনো মুহূর্তে ওদের বাড়িতেও হামলা হতে পারে। কারণ বড় চাচা, ছোট চাচাসহ টুকুর চাচাতো ভাই বিপুও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে চলে গেছে। ভাইয়া ট্রেনিং নিয়ে এসে গ্রামে গ্রামে রাজাকার মেরে সাফ করছে, বুদ্ধি খাটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা মিলিটারি ক্যাম্পে সুযোগ বুঝে আক্রমণ করছে। ওর আতঙ্কে এখন সবাই অস্থির। চাচাতো বোন টিয়ার কাছে বিস্তারিত জানল সে।
টুকুর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। দুই বছর আগেও তো যখন বেড়াতে এসেছিল, বিপু ভাইয়া তখন হাফ প্যান্ট পরেই খেলত ওদের সঙ্গে। সেই ছেলে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে আবার একাই নাকি ধরে ধরে রাজাকার মারছে! কীভাবে সম্ভব?
‘টিয়াদি, টিয়াদি, খারাপ খবর আছে!’ দৌড়ে এসে হাঁপাতে লাগল তারেক- চাচাদের জমিতে কাজ করে এই লোক।
বুকটা ধড়ফড় করে উঠল টিয়ার। ‘কী হয়েছে তারেক ভাই?’
‘ও পাড়ার বিষ্ণু খবরটা দিয়া গেল। দিয়াবাড়ী ব্রিজের ওইদিকে কাইল রাইতের অপারেশনে বিপুদা গুলি খাইসে। খুব সম্ভবত মারা গেসে!’
‘আয় হায়! কী বলো এসব?’ চোখের জল মুছতে মুছতে ভেতর বাড়িতে ছুট লাগাল টিয়া।
হতভম্ব হয়ে তারেকের দিকে তাকিয়ে রইল টুকু।
বিপু ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে টিয়াদের বাড়ির আশপাশে রাজাকারদের আনাগোনা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেল। সেদিন থেকে পুরো বাড়ি একদম থমথমে। মাঝেমধ্যে বড় চাচির মিহি সুরের কান্না ছাড়া, এ বাড়িতে সবাই কথা বলাই যেন বন্ধ করে দিয়েছে। ওদিকে সবকিছু ছাপিয়ে চলছে আব্বার আঁকা-আঁকি। প্রায়ই বাড়ি থেকে গায়েব হয়ে যাচ্ছেন তিনি। একদিন টুকু আবিষ্কার করে ফেলল, জঙ্গলের ভেতরে পুরনো আধা ভাঙা এক প্রাসাদের বারান্দায় ইজেল, ক্যানভাস আর রঙের ভুবনে মত্ত হয়ে আছেন আব্বা। কেবল খাওয়ার সময় বাড়ি ফিরে দু’মুঠো খেয়ে আবার দৌড় দেন। কী এত আঁকেন তিনি?
‘আব্বা, সবাই তো যুদ্ধে গেছে। তুমি যাবা না?’ টুকুর প্রশ্ন শুনে গভীর চোখে তাকালেন নুরুল ইসলাম।
‘এই যে আমি ছবি আঁকছি, এটাও একরকম যুদ্ধ রে বাবা।’
যাহ, ছবি আঁকা কখনো যুদ্ধ হয় কী করে? আব্বা যে কী বলে না? মনে মনে ভাবল টুকু।
সেদিন আব্বাকে খেতে ডেকে কী মনে করে বাড়ির পেছনের বেড়া ডিঙিয়ে পুরনো বাগানে ঢুকে গেল টুকু। বড়ই গাছ ধরে ঝাঁকাতেই টুপটুপ করে অনেকগুলো ফল ঝরে পড়ল মাটিতে বিছিয়ে থাকা শুকনো পাতার ওপর। কোচড় ভরে বড়ই তুলে নিতে লাগল সে।
হঠাৎ ওপাশে ঘন হয়ে থাকা ঝোঁপের আড়াল থেকে ফিসফাস শব্দ ভেসে এলো। মুহূর্তে সতর্ক হয়ে গেল টুকু। পা টিপে টিপে ঝোঁপ সরিয়ে উঁকি দিল সে। ওর দিকে পেছন ফিরে টিয়া কথা বলছে কারো সঙ্গে। ঝাড়গুলো আরেকটু সরালো।
অবাক হয়ে গেল ও, যখন দেখল, টিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়ে যাওয়া বিপু ভাইয়া!
‘বিপু ভাইয়া, তুমি না মারা গেছ?’ টুকু চিৎকার করে উঠতেই হুড়মুড় করে ছুটে এসে ওর মুখে হাত চাপা দিল টিয়া।
বিপু ভাই ঠোঁটে আঙুল রাখলেন, ‘হুশ! আস্তে কথা বল, টুকু। আমি মারা যাইনি। পুরোটাই নাটক।’
‘নাটক! কিন্তু কেন?’
‘পাশের গ্রামের রাজাকার ঘাঁটিটা বেশ বড়। আমার ব্যাপারে ওরা অনেকটা সতর্ক হয়ে গেছিল। তাই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পরামর্শ করে এই রটনা ছড়াতে হয়েছে, যেন আমরা ওদের অসতর্ক মুহূর্তের সদ্ব্যবহার করতে পারি। তুই এখন চেঁচামেচি করে সব পণ্ড করিস না, প্লিজ।’
‘করব না, এক শর্তে।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল টুকু।
‘শর্ত!’ একত্রে বলে উঠল টিয়া আর বিপু।
‘হ্যাঁ, আমাকেও তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে নিতে হবে!’
ছোট্ট টুকুর আবদার শুনে নিঃশব্দে হেসে উঠল ওরা দুজন।

২.
আমগ্রামের মিলিটারি ক্যাম্প উড়িয়ে দেয়ার আগে সময় মতো পর পর তিনটে শিস বাজানোই ছিল টুকুর কাজ। রাজাকার আর মিলিটারিরা দুপুরের ভাতঘুমের প্রথম স্তর পার করার পরপরই তার কাজ শুরু করার কথা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটাই তার প্রথম দায়িত্ব। বাকিটা বিপু ভাই আর ওর দল বুঝে নেবে।
মিলিটারি ক্যাম্পের আশপাশে ছেলে-ছোকড়াদের দেখলে কেউ তেমন কিছু বলে না। প্রথমে টুকুর মনে হয়েছিল, এ আর এমন কী? কিন্তু সময় যত গড়াতে লাগল, ততই বুঝতে পারল খুব একটা সহজ কাজ জোটেনি তার ভাগ্যে। পাকিস্তান বাহিনীর অনেকেই ভাতঘুমে ব্যস্ত থাকলেও বাইরের বারান্দায় পালা করে টহল দিচ্ছিল রাজাকাররা।
বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর তার মনে হলো, পুরো ক্যাম্প মনে হয় নীরব, নিথর হয়ে পড়েছে আচমকা। চারপাশটা একবার উঁকি মেরে এলো সে। বারান্দাতেও এখন কেউ নেই। গেটের ওধারে বন্দুক কাঁধে এক সৈনিক অন্যমনস্ক হয়ে সিগারেট ফুঁকছে টুলে বসে।
এটাই সুযোগ। পর পর তিনবার শিস বাজাল সে। মুহূর্তে দক্ষিণের বারান্দা বরাবর উড়ে এসে পড়ল একটা গ্রেনেড।
ভাগ্য অসহায়। ফাটল না সেটা! আজ পর্যন্ত কোনো অপারেশনেই ব্যর্থ হয়নি বিপু। আজ না টুকুর কারণে কোনো একটা ভুল হয়ে যায়!
ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বারান্দার প্রহরীগুলো। ‘আশপাশে মুক্তি আছে!’ চিৎকার করে উঠল একজন।
ঘটনার আকস্মিকতায় কোনো কিছুর আড়ালে লুকাতে ভুলে গিয়েছিল সে। গ্রেনেড ছোড়ার সংকেত হিসেবে শিসটা যে সে বাজিয়েছিল, সামনে তাকিয়ে অচিরেই বুঝে নিল রাজাকার শামসু।
‘ওই ধর, এই বিচ্ছুটারে!’
ছুট লাগাল রাজাকার শামসু। টুকুও আর মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে দে ছুট। ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পথ চলেছে সে। ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু!
হঠাৎ সে টের পেল, সামনেই ওই পুরনো আধা ভাঙা অট্টালিকাটা। ধুপধাপ দৌড়ে বারান্দায় উঠে এলো। চুপচাপ খাড়া সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় এসে বিরাট এক পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।
‘কই, বিচ্ছু পোলা, কই তুই? আজ তোর কোনো নিস্তার নাই!’ নিচ থেকে ভেসে এলো শামসুর জোর গলার হুমকি। ওই মুহূর্তে ভেসে এলো বন্দুকের কয়েক রাউন্ড গুলির মুহুর্মুহু আওয়াজ। তারপর সব নিশ্চুপ।
কয়েক মিনিট ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকার পর ভাঙা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল শামসু চলে গেছে বেশ খানিকটা দূরে। ও গুলি করল কাকে? আজব! পা টিপে টিপে নিচে নেমে এলো টুকু। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাঝের করিডোর!
কার রক্ত?
পেছনের বারান্দার একদম শেষ মাথায় লম্বা হয়ে পড়ে আছে একটি লাশ!
কার লাশ ওটা?
তৎক্ষণাৎ টুকুর মনে পড়ল, আরে, এ বাড়িতে বসেই না বাবা পেইন্টিং করেন, রংতুলির খেলা খেলেন?
তাহলে তাহলে ওটা কী বাবা?
অজানা আশঙ্কায় ডুকরে কেঁদে উঠল ছেলেটি। স্টেনগান আর গ্রেনেড ছাড়াই রংতুলির মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে তাহলে শহীদ হয়ে গেলেন টুকুর আঁকিয়ে আব্বা?
– সুস্মিতা জাফর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়