চন্দনাইশে পুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্যু

আগের সংবাদ

সব বাঙালির উৎসব : সনজীদা খাতুন

পরের সংবাদ

ইষ্টির মন খারাপ

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ১৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সকাল থেকেই ইষ্টির মুখ ভার। ছোট্ট বেতের চেয়ারটায় বসে কী যেন ভাবছে। যে কেউ দেখলে ভাববে, সারা পৃথিবীর অন্ধকার যেন জড়ো হয়েছে তার চোখে। আজ বাংলা বছরের প্রথম দিন। অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ। বাঙালিদের প্রাণের উৎসব। বাড়িতে কমবেশি সবাই সেজেছে। আগ্রহ এসে বারবার তাগাদা দিচ্ছে, নতুন কাপড়টা যেন পরে নেয়। যতবারই আগ্রহ আসে ততবারই দেখে ইষ্টি চেয়ারে বসা। হোক না করোনাকাল। ছোট্ট পরিসরে হলেও বাড়িতে একটা অন্যরকম আনন্দ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাড়িতে সবাই নতুন কাপড় পরেছে। শুধু দুজন ছাড়া।
ইষ্টিরা যৌথ পরিবার। বাপ-কাকারা মিলে বিশ ছুঁই ছুঁই। তাই এই বাড়িতে প্রতিদিন উৎসব উৎসব মনে হয়। খাবার টেবিলে একসঙ্গে খাওয়া। বাড়িতে সারাক্ষণ হইচই লেগেই থাকে। তবে আজকের দিনটা অন্যরকম। বছরে একবার মোটে আসে। ইষ্টির সমবয়সি ভাই-বোন পাঁচজন। যে কোনো অনুষ্ঠানে বোনরা একই রঙের জামা পরে। ভাইরাও বোনদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একই রঙের পোশাক পরে। এটা এই বাড়িতে শুরু হয়েছে বছর কয়েক আগে। রাস্তায় দেখলে সবাই বুঝতে পারে, ওরা কোন বাড়ির।
ইষ্টিকে বাবা খুব ভালোবাসে। ছোট বেলা থেকেই ও খুব চুপচাপ। জোরে কথা বলে না। বাবা-মা যাই বলে ও ল²ী মেয়ের মতো শোনে। বাবার যেটা সবচেয়ে ভালো লাগে সেটা হলো, আজ-কালকের ছেলেমেয়েদের মতো মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে না। টেলিভিশন দেখলেও সেটা দেশীয় কোনো অনুষ্ঠান অথবা তথ্যমূলক। যা দেখলে কিছু জানা যায়। বাবা এ কারণে ইষ্টিকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। যা চায় তাই এনে দেয়। একবার বায়না ধরল, বৈশাখে গ্রামের বাড়িতে যাবে। বাবা অমনি প্রোগ্রাম সাজিয়ে ফেলল। দিনকয়েক পর বাড়ির উদ্দেশে রওনা। সঙ্গে ছোট কাকার ছেলে আগ্রহ। আগ্রহের সঙ্গেও ওর খুব মিল। ইষ্টি যা করে আগ্রহ সবকিছুতে সায় দেয়। ছোট বয়সের এই মিল একটু বড় হওয়ার পরও আছে। বড় কাকারও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অফিসের জরুরি কাজে আটকে যান। সে কারণে বড় চাচার কোনো ছেলেমেয়েও যায়নি।
নিজেদের গাড়িতে পাক্কা ৩ ঘণ্টায় গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায় ইষ্টিরা। গাড়ি বাড়িতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাড়ির সবাই দৌড়ে আসে। এক অন্যরকম দৃশ্য। সবাই ইষ্টিকে দেখতে চায়। এর আগে একবার এসেছিল। তখন ও খুব ছোট। অর্থাৎ কিনা মায়ের কোলে। তখনকার কিছুই মনে নেই ইষ্টির। এই বাড়িতে ইষ্টিদের আপন বলতে কেউ থাকে না। তাদের এক দূর সম্পর্কীয় কাকা দেখাশোনা করে। নাম আপন। মাঝে মাঝে শহরের বাড়িতে আপন কাকা আসেন। ইষ্টিকে খুব আদর করেন। সব ভাইবোন থেকে ইষ্টিকে আলাদা মনে হয় আপন কাকার। কাকির নিজ হাতে বানানো নারিকেলের নাড়ু এনে ইষ্টিকে চুপি চুপি দেন। অন্য কাকাদের জন্য যাই আনুক, ইষ্টির জন্য নাড়ু আনা চাই। নারিকেলের নাড়ু ইষ্টির খুব প্রিয়। কেউ দেখলে বুঝতে পারবে না, আপন কাকা আপন না পর। ইষ্টিরাও বোঝে না আপন-পর। গাড়ি থেকে নেমে আপন কাকাকে জড়িয়ে ধরে ইষ্টি। কাকি এসে কোলে নিতে চায় ইষ্টিকে। সেই ছোট্ট বেলার মতো। ইষ্টি একটু বড় হয়েছে। তাই কোলে না উঠে কাকিকে পায়ে ধরে প্রণাম করে। কাকি বুকে জড়িয়ে রাখে। আপন কাকারও এক মেয়ে। নাম সূচনা। ইষ্টির চাইতে এক বছরের বড়। তারপরও ওদের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব। আগ্রহ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। পরক্ষণেই কাকা-কাকিকে প্রণাম করে বাড়ির ভেতরে ঢোকে।
বাড়ি থেকে কিছু দূরে মেলা বসেছে। বৈশাখী মেলা। বিকেলে সবাইকে নিয়ে বাবা মেলায় গেলেন। মেলায় গিয়ে সবার আনন্দ দেখে কে? মেলায় প্রথমে উঠল নাগরদোলায়। বাবা সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে উঠল। ইষ্টি, আগ্রহ ও সূচনার সে কী আনন্দ। যতবার উপরে উঠে একযোগে সবার চিৎকার। পরে কাঠ দিয়ে বানানো ঘোড়া, সিংহ, বাঘের ওপর চড়ে। একজন লোক হাত দিয়ে চড়কির মতো ঘোরায়। মেলার অন্য কোণে পর্দা দিয়ে ঘেরা একটা ঘরের মধ্যে ঢোকে। সেখানে খুব সুন্দর পুতুল নাচ দেখলো। ওখান থেকে বের হয়ে বায়স্কোপ দেখল। একটা ছোট্ট চৌকোনা বাক্স। গোল গোল বড় বড় ছিদ্র দিয়ে বায়স্কোপ দেখতে হয়। ইষ্টিরা এটাও খুব মজা পায়। মাটির পুতুল, নকশী পাখা, খেলনাপাতিসহ আরো অনেক জিনিস কিনল ইষ্টি। গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে- এরকম জিনিসই কিনেছে। বাবা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল।
সন্ধ্যায় পাশের বাড়িতে গিয়ে আরো অবাক ইষ্টি। উঠোনের মাঝখানে গাছ-গাছড়ায় আগুন দিয়ে সবাই গোল হয়ে ঘুরছে। ওদের মুখে শুনেছে এটাকে জাক দেয়া বলে। পুরাতন বছরের সমস্ত অশুভ যেন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই থাকে সবার প্রার্থনা। সবাই সুরে সুরে ছড়া কাটছে। ইষ্টিরাও দলে ভিড়ে গিয়ে গোল হয়ে ঘুরতে থাকে।
এক বছর বাবা ওকে পহেলা বৈশাখের ছায়ানটের অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। খুব ভোরে উঠে রওনা হয়েছিল। এই ভোরেও মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। পার্কে লাইন দিয়ে ঢুকতে হয়। বাবা ভিড় এড়িয়ে কোনোরকমে অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হয়। অশ্বত্থ গাছের নিচে ছায়ানটের শিল্পীরা সারিবদ্ধভাবে বসা। ইষ্টি এদিক ওদিক উঁকি মারছিল। একদল ঢুলি ঢোল বাজিয়ে দিনের সূচনা করে। পরে শুরু হয় গান। ইষ্টি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গান শুনছে। গান শেষে বাবা ওকে রমনা পার্কের চারদিকটা ঘুরিয়ে দেখায়। এরই মধ্যে এক জায়গায় বসে বিভিন্ন ভর্তা দিয়ে পান্তা ভাতও খেল। বাবা বুঝতে পারে ইষ্টির মধ্যে সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানা ভর করেছে। বাবা তাই বেশি বেশি বাঙালির সার্বজনীন উৎসবগুলোতে মেতে থাকে।
ইষ্টির বয়স এখন দশ পেরিয়ে এগারোতে পড়েছে। ভালোমন্দও বুঝতে শিখেছে। গত বছর এক সর্বনাশা করোনার কারণে ঘর হতে বের হতে পারেনি। সবাই এক অজানা আতঙ্কে ছিল। ঘরের মধ্যে পহেলা বৈশাখ পালন। ভাবছিল এ বছর উৎসবটা খুব জাঁকজমকপূর্ণ হবে। মনে মনে তাই প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু কি হতে কী হয়ে গেল। এবারো ঠিক প্রাণের এই উৎসবের আগে আগে সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। আবারো সবাই আতঙ্কে। তাই মন খারাপ করে বাসায় বসে আছে ইষ্টি। বাবা বুঝতে পেরেছে ওর কষ্ট। তাই বাবাও আজ কোনো নতুন কাপড় পরেননি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়