বিএসএমএমইউ : ইমেরিটাস অধ্যাপক হলেন ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ্

আগের সংবাদ

গতিহীন প্রকল্পে সীমাহীন দুর্গতি > টঙ্গী-গাজীপুর মহাসড়ক : ৫ বছরের কাজে ১০ বছর পার

পরের সংবাদ

ছোটমামার জ্যাকেট

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শীতের বিকাল। কিন্তু মনে হচ্ছে সন্ধ্যা। আজ একটু তাড়াতাড়ি কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। কনকনে ঠাণ্ডা। ছোটমামার গায়ে একটা হাফ শার্ট। মুখে সেই চেনা হাসি।
– ছোটমামা আপনার শীত লাগছে না?
আমার প্রশ্ন শুনে ছোটমামার হাসি আরো চওড়া হলো। তারপর বললেন- না, লাগছে না।
– বলেন কী!
– ঠিকই বলছি ভাগ্নে।
– কীভাবে সম্ভব! বিস্ময়ে কথাটা আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। কারণ গরম পোশাক পরার পরও আমার বেশ শীত লাগছে।
ছোটমামা যেন এই কথাটা শোনারই অপেক্ষায় ছিলেন। জামার পকেট থেকে তিনি চকচকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করলেন। তখন হাজার টাকার নোট বের হয়নি। পাঁচশ টাকাই সবচেয়ে বড় নোট। আমার চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। দশম শ্রেণিতে পড়–য়া ছোটমামার পকেটে এত টাকা! সদ্য ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠা আমার কেন যেন বিশ্বাস হতে চাইছিল না।
– বুঝলে ভাগ্নে, পকেটে পাঁচশ টাকার নোট থাকলে মাঘ মাসেও শীত লাগে না। টাকার আলাদা একটা গরম আছে না।
ছোটমামার বলার ধরনে আমি হেসে ফেললাম। রসিকতায় তিনি বরাবরই ওস্তাদ।
– চলো আজ তোমাকে কারখানায় নিয়ে গিয়ে গরমাগরম আইসক্রিম খাওয়াব। ছোটমামা বললেন।
বাজারে একটা নতুন আইসক্রিম কারখানা হয়েছে। মামাবাড়িতে আসা মাত্র তিনি আমাকে বলেছেন।
– ছোটমামা আইসক্রিম কখনো গরমাগরম হয় না।
– ঠিক আছে ভাগ্নে, তাহলে আজ তোমাকে হিম হিম আইসক্রিম খাওয়াবো।
– শীতের দিনে আইসক্রিম খাবেন?
– হ্যাঁ, অসুবিধা কী। শীতের দিনেই তো আইসক্রিম খেতে মজা। আইসক্রিম পেটে গেলেই কাজ সারা। শরীরের ভেতরে তখন বাইরের চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা। বাইরের ঠাণ্ডা তখন একেবারে জব্দ। কোনো শীতকেই তখন আর শীত মনে হয় না।
– ছোটমামা একটা কথা বলি।
– বলো ভাগ্নে। ছোটমামা মুচকি হাসছেন।
– আমার পকেটে কিন্তু আপনার মতো পাঁচশ টাকা নেই। এই শীতে তাই আমি একদম আইসক্রিম খেতে চাই না।
– ঠিক আছে, তুমি খেতে না চাইলে তো আমি আর জোর করতে পারি না। ছোটমামা উদাস গলায় বললেন। তারপর একটু থেমে যোগ করলেন- তাহলে চলো মাঠে যাই।
– চলেন। আমি সানন্দে রাজি হলাম।
মাঠে গিয়ে আমরা ঘণ্টাখানেক ক্রিকেট খেললাম। সন্ধ্যা নামায় ক্রিকেট বল আর দেখা যাচ্ছিল না। তাই সেদিনের মতো খেলা শেষ করতে হলো। ছোটমামার বন্ধুরা আমার খেলার খুব প্রশংসা করলেন। একজন তো ছোটমামাকে বলেই ফেললেন- তোর ভাগ্নে টিটো তো অনেক ভালো ক্রিকেট খেলে রে।
– আরে ভাগ্নে কার দেখতে হবে না। আর ওর মামা কী খারাপ খেলে নাকি।
ছোটমামার কথায় তার বন্ধুরা হো-হো করে হেসে উঠলেন।
মাঠের পাশে প্যাটিস বিক্রি করছিল এক লোক। টিনের একটা বাক্সতে করে। বাক্সের নিচের দিকটায় কয়লা জ্বলছে।
– গরমাগরম প্যাটিস খেতে আপত্তি নেই তো ভাগ্নে? রসিক ছোটমামা স্বভাবসুলভ ঢঙে জিগ্যেস করলেন।
আপত্তি নেই। মুখে না বলে আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম।
– মবিন চাচা, দুটো প্যাটিস দেন। ছোটমামা লোকটিকে বললেন।
তিনি ঝটপট দুটো প্যাটিস আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ছোটমামা দাম মিটিয়ে দিলেন।
সুস্বাদু আর গরম প্যাটিস খেতে খেতে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। একটু সামনে যেতেই চোখে পড়ল একটা ছেলে চায়ের ফ্ল্যাক্স হাতে আসছে।
বয়স আমার মতোই। পরনে মলিন একটা জামা। পুরনো আরেকটা কাপড় মাফলারের মতো করে মাথায় জড়ানো।
ছোটমামা বললেন- কেমন আছিস বলাই?
– ভালো।
– আমাদের দুই কাপ চা দে।
আমি ছোটমামাকে বারণ করলাম- বাড়িতে গিয়েই তো চা খাওয়া যাবে।
– ওর আদা চা খুব ভালো। একবার খেলে মুখে লেগে থাকে। ছোটমামা হেসে বললেন।
বলাই প্লাস্টিকের ছোট্ট কাপে চা এগিয়ে দিলো। ছোটমামা বললেন- আজ কত বিক্রি করেছিস?
– চল্লিশ টাকার মতো অইব। বলাই উত্তর দিলো।
প্রতি কাপ আদা চা দুই টাকা। ছোটমামা তাকে পাঁচ টাকা দিয়ে বললেন- পুরোটা রেখে দে। ফেরত দিতে হবে না।
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- দ্যাখো, বলাইয়ের পকেটেও টাকা আছে। তাই তারও কিন্তু শীত লাগছে না।
– তাই বুঝি। আমি হেসে ফেললাম।
একটু সামনে এগুতেই দেখা গেল অন্যরকম এক দৃশ্য। রাস্তার ধারে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে কিছু মানুষ।
ছোটমামা সেদিকে তাকিয়ে বললেন- বড় হয়ে একটা কাজ করতে হবে ভাগ্নে।
– কী কাজ ছোটমামা।
– এসব মানুষকে শীতের পোশাক আর কম্বল কিনে দিতে হবে। টাকা জমানো শুরু করেছি। পকেটের পাঁচশ টাকায় আবার হাত দিলেন ছোটমামা।
সন্ধ্যার আবছা আলোতেও ছোটমামার মুখটা আমার কাছে ভীষণ উজ্জ্বল মনে হলো।
মামাবাড়িতে আমরা ফিরতেই দিদা এগিয়ে এলেন। তার হাতে একটা চাদর। ছোটমামার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন- মৃদুল কবে ফিরবে?
– আজই তো গেল। দুই-তিন দিন তো বেড়াবে। ছোটমামা বললেন।
দিদা এ প্রসঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে বললেন- দুজনে হাত-মুখ ধুয়ে নাও। তাড়াতাড়ি নাস্তা খেতে আসো।
পরে জানা গেল আসল কথা।
মৃদুল মামা হলেন ছোটমামার সহপাঠী। খুবই কাছের বন্ধু। তার বড়বোনের বিয়ে হয়েছে কিছু দিন আগে। সেখানেই বেড়াতে গেছেন। যাওয়ার আগে ছোটমামার লাল রঙের জ্যাকেটটা ধার নিয়ে গেছেন মৃদুল মামা।
বন্ধুকে জ্যাকেট ধার দিয়ে শীতের মধ্যে নিজে হাফ শার্ট পরে ঘুরছেন। ছোটমামাকে এজন্যই আমার এত পছন্দ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়