তিতাস গ্যাস কর্মচারী ইউনিয়ন : পূর্ণ প্যানেলে জয়ী কাজিম-আয়েজ পরিষদ

আগের সংবাদ

যুদ্ধাপরাধ বিচারে স্থবিরতা ; বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নিতে সরকারের আগ্রহ নিয়ে সংশয়! ট্রাইব্যুনালেও জনবল সংকট

পরের সংবাদ

রবীন্দ্রনাথের ধর্মচেতনা ও পূজা উৎসব

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২১ , ১:০১ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের এক-চতুর্থাংশের বেশি পূজা পর্যায়ের হলেও আচার-সর্বস্ব ধর্ম পালনের বেড়াজালে তিনি আটকে ছিলেন না। ধর্ম বিশ্বাসের এক গভীর সংকটকালে তার আবির্ভাব হলেও ধর্মের আক্ষরিক অনুসরণ অনুকরণ কবিগুরুর স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল। একদিকে ভারতবর্ষের নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি, অপরদিকে বাইরে থেকে আসা ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘাত শুরু থেকেই তার পরিবারের ওপর আছড়ে পড়েছিল। যার ফলাফল ভালো কিংবা মন্দ যাই হোক না কেন, সেই ভবিতব্য ঠাকুর পরিবারের সঙ্গী হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও সেই অভিঘাতের বাইরে ছিলেন না। বলা হয়ে থাকে, ‘যশোহর জেলায় চেঙ্গুটিয়া পরগনার জমিদার গুড়-বংশীয় দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর চার পুত্র- কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেবের মধ্যে প্রথম দুজন মামুদ তাহির বা পীর আলী নামক এক স্থানীয় শাসকের চক্রান্তে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন ও তাদের সংস্পর্শে অপর দুই ভাই সমাজচ্যুত হয়ে পিরালী থাকের অন্তর্ভুক্ত হন।’ অর্থাৎ মুসলমানরা এদেশে শাসন পাকাপোক্ত করার পর থেকে রবীন্দ্রনাথের আদি পরিবারের একটি অংশ মুসলমান হয়ে যান, বাকিরা তারই ফলশ্রæতিতে পিরালী ব্রাহ্মণ রূপে পরিগণিত হন। যদিও প্রশান্ত পাল ও ব্যোমকেশ মুস্তফী এটিকে চক্রান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবু বলতে হয়- মানুষের ধর্ম পরিবর্তনের প্রেরণা আসে মূলত ইহলৌকিক ও পারলৌকিক লাভালাভের হিসাব থেকে। কারণ আমরা পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আগমনের পরও লক্ষ্য করেছি, রবীন্দ্রনাথের পরিবার রামমোহন প্রবর্তিত ‘ব্রহ্মধর্মে’র প্রধান প্রচারকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
নিজ পরিবারের ‘পিরালী’ পরিচয় এবং ‘ব্রহ্মধর্ম’ই রবীন্দ্রনাথের পরিবারের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণের অংশ হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও সারাজীবন এ থেকে দূরে যাওয়া খুব সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে ঠাকুর পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে সর্বদা এই পতিত ব্রাহ্মণ সমাজ থেকে পাত্রপাত্রী সংগ্রহ করতে হতো তাদের। তরুণ রবীন্দ্রনাথের বিয়ের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। অন্যত্র পাত্রীর অভাব হওয়ায় তাকে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের নায়েব বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর পাণি গ্রহণ করতে হয়। সেদিক থেকে ঠাকুর পরিবার ছিল তৎকালীন বৃহত্তর হিন্দু ধর্মীয় সমাজের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সংখ্যালঘুত্বের এই মনোবেদনা ও সামাজিক বৈষম্য রবীন্দ্রনাথকেও সারাজীবন কষ্ট দিয়েছে। বিশেষ করে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বাত্মকভাবে ব্রহ্মধর্মের প্রধান পুরোহিত ব্রত গ্রহণ করার পরে শিশু রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু উৎসব পার্বণ থেকে অনেকখানি দূরে থাকতে হয়। সেই বেদনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমাদের পরিবার আমার জন্মের পূর্বেই সমাজের নোঙর তুলে দূরে বাঁধা ঘাটের বাইরে এসে ভিড়েছিল।’ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের পরে সেই সংখ্যালঘুত্ব ষোলকলা পূর্ণ করে সে কথাও তিনি বলেছিলেন। এই ঘটনায় তার পরিবার সংখ্যালঘু পিরালী ব্রাহ্মণদের মধ্যেও সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছিলেন। ‘এরপর অনাত্মীয় ব্রহ্মবন্ধুরাই তাদের আত্মীয় স্থান গ্রহণ করলেন।’
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সাকার পূজাপার্বণের বিরুদ্ধে হলেও বৃহত্তর ঠাকুর পরিবারের অনেকে পূজাপার্বণকে উৎসাহিত করতেন। কবির কনিষ্ঠ পিতৃব্য নগেন্দ্রনাথ দুর্গা উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এমনকি তিনি এই উৎসবকে বিতর্কিত না করার জন্য সতর্কও করে দিয়েছিলেন। ফলে দেবেন্দ্রনাথের শতচেষ্টা সত্ত্বেও ঠাকুর পরিবারকে দুর্গাপূজার উৎসব থেকে দূরে রাখা যায়নি। কিন্তু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পূজামৌসুম আসন্ন হলে বাড়ি ছেড়ে অনেক দূর নির্জন সাধনায় চলে যেতেন। এই ঘটনাও তরুণ রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের ওপর মিশ্র প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। কারণ দেবেন্দ্রনাথ বাড়ি ছেড়ে গেলে কবিমাতা সারদা দেবীর পক্ষে পূজায় উপস্থিত থাকা আর সম্ভব হতো না।
ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে মহর্ষির মনে এই মূর্তিপূজা পালনের সংকট উপস্থিত হয়েছিল। এমনকি রবীন্দ্রনাথের জন্মের প্রায় বার বছর আগে লন্ডনে কবির ঠাকুরদা দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রয়াণের পরে পরিবারে বেশ গোল বেঁধেছিল তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার তর্পণাদি কীভাবে সম্পন্ন হবে- তাই নিয়ে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কিছুতেই রাজি ছিলেন না, সনাতন হিন্দুরীতিতে তার পিতার স্মৃতিতর্পণ হোক। দ্বারকানাথ নিজে একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু হয়েও একেশ্বর ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছিলেন- বন্ধু রামমোহন রায়কে। কেবল অর্থ ও মনো-সমর্থন নয়, তিনি নিয়মিত ব্রাহ্মধর্মের উপাসনাতেও উপস্থিত থাকতেন। রামমোহনের মৃত্যুর পর বেশ কয়েক বছর তার অর্থ সাহায্যের ওপর নির্ভর করে ব্রাহ্মসমাজ বেঁচে ছিল।
ধর্মীয় বিশ্বাসে ঠাকুর পরিবারের উত্থান পতন যাই হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথ বলা চলে দুর্গা উৎসবের পক্ষে ছিলেন। তার মতে যে কোনো উৎসব বিচ্ছিন্ন মানবসমাজকে একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করে; পাশাপাশি প্রাত্যহিক ক্লেদ দূর করে নতুন বছরের জন্য মুক্ত বাতাবরণ খুলে দেয়। মানুষ নতুন করে তার কর্মের জগতে প্রবেশ করতে পারে। তবে যেভাবেই আমরা দেখি না কেন, রবীন্দ্রনাথের সমগ্রজীবন কেটেছিল গভীর আধ্যাত্মিক ধর্মীয় পরিবেশে। পিতা ও পারিবারিক ব্রাহ্মধর্ম তার মনোজগতে গভীর ঈশ্বর চেতনার জন্ম দিয়েছিল। পারিবারিক কারণে নিজেও তিনি ব্রহ্মধর্মের প্রচারণাকর্মে যুক্ত ছিলেন। নিযুক্ত হয়েছিলেন, আদিব্রহ্ম সমাজের সম্পাদক। কিন্তু ধর্মীয় আচার সর্বস্ব সীমাবদ্ধতা তার কর্মের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ইংরেজ শাসন সুবাদে খ্রিস্টধর্মের অভিঘাতে সৃষ্ট ব্রাহ্মণের মূল শিক্ষাই ছিল আধ্যাত্মিকতা, নারী শিক্ষা, স্বাধীনতা, যুক্তিবাদিতা ও আধুনিক ইংরেজ শাসনের সুবিধাদির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। তাই রবীন্দ্রনাথের ধর্মচর্চা কখনো সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হয়নি, বরং বৈচিত্র্যানুসন্ধানী মানবসমাজের বন্ধনমুক্তিতে কাজ করেছে।
একবার উড়িষ্যার কটকের ব্রাহ্মমন্দিরের এক রবিবাসরীয় উপাসনা সভায় রবীন্দ্রনাথের ওপর সঙ্গীত পরিবেশনের ভার পড়েছিল। সেই সময়ে ইন্দিরা দেবীকে লিখিত এক পত্রের ভাষ্যে জানা যায়, সেখানে মধুসূদন রাও নামে এক ব্রাহ্মপণ্ডিতের বক্তৃতায় তিনি উ™£ান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, এ ধরনের ধর্মীয় শিক্ষা বিরূপ ফল বয়ে আনতে পারে। তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ব্রাহ্মসমাজের সাপ্তাহিক উপাসনায় এই জন্যই যেতে ইচ্ছে করে না।… আমি নিজেও বেদিতে উঠতে চাই নে, জানি সে বিষয়ে আমার স্বাভাবিক ক্ষমতা নেই, মনের মধ্যে একটা অনিবার্য আহ্বান নেই- এবং প্রতি বুধবারে চিন্তামণির বক্তৃতা শুনে আসাও আমার কর্তব্য জ্ঞান করি নে- বড়দাদা যখন একটা কিছু বলেন তখন আমার সমস্ত চিত্ত আকৃষ্ট হয় এবং উপকার হয়।’ পারিবারিক কারণে আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সংশ্রব থাকলেও তিনি স্বাধীন চিন্তার অনুগামী ছিলেন। তবে যে উদ্দেশ্যেই ব্রাহ্মধর্ম আবিভূত হোক না কেন, কালে কালে এই সমাজেও ধর্মীয় সংকীর্ণতা বাসা বেঁধেছিল। রামমোহন থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে কেশবচন্দ্র সেন পর্যন্ত এই ধর্মের বহু বাদানুবাদ এবং শাখা-উপশাখার জন্ম হয়েছিল। এই ভাঙনের রেখা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টির বাইরে ছিল না। তার মতে, ‘ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে আজকাল যে অপরিতৃপ্তি, যে অসন্তোষের ভাব সুস্পষ্ট দেখা যাইতেছে, তাহার প্রধান কারণ, ব্রাহ্মসমাজ দীর্ঘকাল ভাঙনের কাজেই বিশেষ লক্ষ্য করিয়াছে, গড়নের কাজে মন দিতে পারে নাই। লড়াইয়ের দিনে বিচ্ছেদবিরোধ, আঘাত-প্রতিঘাতই সর্ব্বপ্রধান হইয়া ওঠে- রক্ষণ ও গঠনের জন্য শান্তি ও প্রীতির প্রয়োজন।’ শান্তি ও প্রীতিই ছিল রবীন্দ্রচেতনায় ধর্মীয় উপস্থিতি।
তবে বৃহত্তর অর্থে ব্রহ্মধর্মও ভারতীয় সনাতন ধর্মের অংশ ছিল। তার প্রমাণ প্রধানত হিন্দু সমাজেরই একটি অংশ ব্রহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিল। এমনকি এই ধর্মটির অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যে প্রচারের আগ্রহও লক্ষ্য করা যায় না। বরং এটিকে হিন্দু ধর্মের একটি সংস্কার আন্দোলন হিসেবে মনে করা যায়। ঠাকুর পরিবারও ব্রাহ্মধর্মের পাশাপাশি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অংশ হিসেবে হিন্দুমেলার প্রবর্তন ও শিবাজি উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। বালক রবীন্দ্রনাথও হিন্দুমেলা ও শিবাজি উৎসবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিশোর রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর, তখন তিনি প্রথম হিন্দুমেলায় কবিতা পাঠ করেন। তৎকালীন সোমপ্রকাশ পত্রিকার এক খবরে ছাপা হয়, ‘শুক্রবার সারকিউলার রোড পারসী বাগানে মহা সমারোহে হিন্দুমেলা হইয়া গিয়াছে। প্রায় ৩০০ হিন্দু ভদ্রলোক মেলায় উপস্থিত হন। বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র একটি উৎকৃষ্ট বাঙ্গালা কবিতা রচনা করিয়া উহা মুখস্থ পাঠ করিয়া সকলের চিত্তরঞ্জন করেন।’ কবিতাটি ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ নাম স্বাক্ষরিত হয়ে ‘হিন্দুমেলার উপহার’ নামে প্রকাশিত হয়। বাইশ স্তবকের আটাশি পঙ্ক্তির এই কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ অতীতকালের ভারতের জয়গাঁথা তুলে ধরেন। রামায়ণ-মহাভারত কালে ভারতের যে-সব স্বাধীন নৃপতি এই দেশ নির্মাণে কাজ করেছিলেন তাদের স্মৃতি স্মরণ করেন। বর্তমান পরাধীন ভারতের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। যেমন, ‘রাজা যুধিষ্ঠির (দেখিছি নয়নে)/ স্বাধীন নৃপতি আর্য সিংহাসনে,/ কবিতার শ্লোকে বীণার তারেতে/ সে-সব কেবল রয়েছে গাঁথা।’
এ তো গেল রবীন্দ্রনাথের সামাজিক পারিবারিক ধর্মীয় চেতনা নির্মাণের কথা। কিন্তু একজন কালের শক্তিমান কবি ও গদ্যশিল্পী হিসেবে তার সাহিত্যে কীভাবে পূজা ও দুর্গা উৎসবের চিত্র ফুটে উঠেছে- তার কিছুটা আলোকপাত করা যাক। পূজা ধর্মীয় চেতনা থেকে উৎসারিত হলেও এটি সামাজিক উৎসবের অংশ। বিশেষ করে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম পর্বে সার্বজনীন দুর্গাপূজা উৎসবের পুনঃপ্রবর্তন হওয়ার পর থেকে এটি বাংলায় সর্বজনীন পূজা হিসেবে স্বীকৃত হয়। লোকজন মহাসমারোহে এই পূজা উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকে। পূজাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায় বাণিজ্য, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, বিয়ে উপাসনা, লোক গমনাগমনের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের উৎসবের অনুপস্থিতি একজন শক্তিমান লেখকের লেখায় থাকা সম্ভব নয়। তাই রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, সঙ্গীতে, প্রবন্ধে বিশেষ করে গল্প কথাসাহিত্যে পরিবেশ বর্ণনা ও চরিত্র নির্মাণে ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের গান কবিতায় একই সঙ্গে নারী ও দেবী প্রায় একই মাত্রায় একাকার হয়ে মিলেমিশে আছে। ‘দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই/ প্রিয়জনে-প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই/ তাই দিই দেবতারে; আর পাব কোথা!/ দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়রে দেবতা।’ ঠিক ‘জীবন দেবতা’ কবিতাতেও তিনি পৃথিবীতে জীবনের বারংবার আবির্ভাব টিকে থাকা- একই সঙ্গে মানুষের প্রাত্যহিক এবং ঈশ্বরের চিরন্তন কর্ম হিসেবে বিবেচনা করেছেন, ‘নূতন করিয়া লহ আবার/ চির-পুরাতন মোরে।/ নূতন বিবাহে বাঁধিবে আমায়/ নবীন জীবন ভোরে।’ রবীন্দ্রনাথের কাছে পূজা ও প্রেম প্রায় সমার্থক হয়ে দেখা দিয়েছিল। তিনি মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যেই ঈশ্বরের সাধনা করেছেন। মানুষের প্রতি ভালোবাসা তার কাছে ধর্মের আক্ষরিক বাণীর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কবির ‘বিসর্জন’ নাটকে আমরা লক্ষ্য করি- রাজপুরোহিত রঘুপতি, রাজা গোবিন্দমাণিক্য, রাজসিংহ ও রাজভ্রাতার মধ্যে ক্ষমতার যে সংঘাত উপস্থিত হয়, সেখানে পুরোহিত তন্ত্র ধর্মকে কীভাবে রাজনীতির হাতিয়ার করে তোলে সংস্কারের কু-যুক্তি দ্বারা। তবু রবীন্দ্রনাথ নিজের হৃদয়ের আলো ফেলে সেই অন্ধকারকে দূর করতে চেয়েছেন। একইভাবে মায়ামৃগয়া, বাল্মীকিপ্রতিভা, মায়ার খেলা, চিত্রঙ্গদা, চণ্ডালিকা, শ্যামা, প্রতিশোধ- প্রায় প্রতিটি নাটক ও কাব্যনাটকে তিনি মানবধর্মের জয়ধ্বজা উড়াতে চেষ্টা করেছেন।
‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থের ‘কাঙালিনী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ সরাসরি দুর্গার আগমন নিয়েই কবিতা লিখেছেন। কিন্তু এখানেও তার মূল বক্তব্য পূজাউৎসব যদি গরিব-দুখীর মুখে হাসি না ফোটাতে পারে, মাতৃহারাকে যদি মায়ের স্পর্শ দিতে না পারে- তাহলে দুর্গা মায়ের আগমনে কোনো লাভ নেই। ‘আনন্দময়ীর আগমনে,/ আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে।’ ধনির দুয়ারে পূজার আবাহন শুনে কাঙালিনী এসেছে ছুটে। ‘অনাথ ছেলেরে কোলে নিবি জননীরা আয় তোরা সব, / মাতৃহারা মা যদি না পায় তবে আজ কিসের উৎসব!’ এই হলো রবীন্দ্রনাথের মূল উৎসব চেতনা। তিনি শারদীয় পূজা উৎসবের গুরুত্ব অনুভব করেছেন- মানুষের পারস্পরিক বন্ধনের নিমিত্তে।
রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য ছোটগল্পে পূজা ও শারদোৎসবের চিত্র নিখুঁতভাবে অঙ্কিত হয়েছে। দুর্গাপূজার সময়ে উমা বাপের বাড়ি যাবে, ফটিক মায়ের কাছে যাবে, তারাপদ ঘর ছাড়বে- এ ধরনের অনেক অনুষঙ্গের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ছুটি, স্বর্ণমৃগ, দেনা-পাওনা, অতিথি, রাসমনির ছেলে প্রভৃতি গল্পে পূজা উৎসবের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ‘স্বর্ণমৃগ’ ছোটগল্পে আদ্যনাথ ও বৈদ্যনাথ দুই শরিককে নিয়ে গল্প হলেও শারদোৎসবের বর্ণনা ধরা পড়েছে। ‘আশ্বিন মাসে দুর্গোৎসব নিকটবর্তী হইল। চতুর্থীর দিন হইতে ঘাটে নৌকা আসিয়া লাগিতে লাগিল। প্রবাসীরা দেশে ফিরিয়া আসিতেছে। ঝুড়িতে মানকচু, কুমড়া, শুষ্ক নারিকেল, টিনের বাক্সের মধ্যে ছেলেদের জন্য জুতা ছাতা কাপড় এবং প্রেয়সীর জন্য সুগন্ধী সাবান, নতুন গল্পের বই এবং সুবাসিত নারিকেল তৈল। মেঘমুক্ত আকাশে শরতের সূর্যকিরণ উৎসবের হাস্যের মতো ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, পক্বপ্রায় ধান্যক্ষেত্র থর থর করিয়া কাঁপিতেছে, বর্ষাধৌত সতেজ তরুপল্লব নব শীতার্থ বায়ুতে সির সির করিয়া উঠিতেছে এবং তসরের চায়না কোট পরিয়া কাঁধে একটি পাকানো চাদর ঝুলাইয়া ছাতি মাথায় প্রত্যাগত পথিকরা মাঠের পথ দিয়া ঘরের মুখে চলিয়াছে। বৈদ্যনাথ বসিয়া বসিয়া তাই দেখেন এবং তাহার হৃদয় হইতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস উচ্ছ¡সিত হইয়া উঠে। নিজের নিরানন্দ গৃহের সহিত বাংলাদেশের সহস্র গৃহের মিলনোৎসবের তুলনা করেন এবং মনে মনে বলেন বিধাতা কেন আমাকে এমন অকর্মণ্য করিয়া সৃজন করিয়াছেন।.. বৈদ্যনাথ বসিয়া বসিয়া কতকগুলো কাষ্ঠখণ্ড কাটিয়া কুঁদিয়া জোড়া দিয়া দুই খানি খেলনার নৌকা তৈরি করিলেন। ছেলেদের আনন্দ কলরবে আকৃষ্ট হইয়া মোক্ষদা আসিয়া দরিদ্র পিতার পূজার উপহার দেখিলেন। দেখিয়া, রাগিয়া কাঁদিয়া কপালে করাঘাত করিয়া খেলনা দুটো কাড়িয়া জানলার বাহিরে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলেন। সোনার হার গেল, মাটিনের জামা গেল, জরির টুপি গেল, শেষে কিনা হতভাগ্য মানুষ্য দুই খান খেলনা দিয়া নিজের ছেলেকে প্রতারণা করিতে আসিয়াছে। তাও আবার দুই পয়সা ব্যয় নাই, নিজে হাতে নির্মাণ।’ এই গল্পটিও ঠিক ‘কড়ি ও কোমলের’ ‘কাঙালিনী’ কবিতাটির মতো। কবির হৃদয় পূজা উৎসবে সংযুক্ত হতে চেয়েছে, কিন্তু গরিব-দুখীরা যদি এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়, স্পর্শের বাইরে থাকে- তাহলে এই উৎসব মানুষের কাছে একটা প্রহসন হিসেবে উপস্থিত হয়। তাই রবীন্দ্রনাথের পূজা প্রেম প্রকৃতি ও ঈশ্বর চেতনা- সব মানবকেন্দ্রে মিলিত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়