ব্যক্তিগত আক্রোশ ও ক্ষোভ থেকে উচিৎ শিক্ষা দেয়ার জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজস্ব লোক দিয়ে জামালপুরে সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমকে নৃশংসভাবে প্রহার করে হত্যা করা হয়। প্রাথমিকভাবে সিসিটিভি ফুটেজে ১০-১২ জনকে দেখা গেছে। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম ওরফে বাবু (৫০) ছাড়াও জড়িত তিনজনকে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও বগুড়ার দুপচাঁচিয়া থেকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হই আমরা।

বহুল আলোচিত জামালপুরে সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমকে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারীসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‌্যাব লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। শনিবার (১৭ জুন) সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

র‌্যাব মুখপাত্র বলেন, গত ১৪ জুন সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিম পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফেরার পথে বকশীগঞ্জ উপজেলার পাটহাটি এলাকায় সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলার শিকার হয়ে অচেতন হয়ে পড়লে হামলাকারীরা তাকে রাস্তার পাশে ফেলে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে স্থানীয় সাংবাদিক ও পথচারীরা তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে প্রাথমিকভাবে বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে রাতেই জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। ভুক্তভোগী নাদিমের অবস্থার অবনতি হলে পরের দিন বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) সকালে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ওইদিনই বিকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাদিম মারা যান। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্ত্রী বাদী হয়ে মাহমুদুল আলম বাবুকে প্রধান অভিযুক্ত করে বকশীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

তিনি আরো বলেন, মামলা হওয়ার পর চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা এ ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার (১৭ জুন) সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১৪ এর একটি আভিযানিক দল স্থানীয় র‌্যাবের সহযোগীতায় পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও বগুড়ার দুপচাঁচিয়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সাংবাদিক নাদিম হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু ছাড়াও এ ঘটনায় জড়িত তিনজন মো. মনিরুজ্জামান মনির ওরফে মনিরুল (৩৫), জাকিরুল ইসলাম (৩১) ও মো. রেজাউল করিমকে (২৬) গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর পরিকল্পনাতেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। সাংবাদিক নাদিম সাম্প্রতিক সময়ে বাবুর অপকর্ম নিয়ে অনলাইন পোর্টালে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাবু ক্ষিপ্ত হয়ে সাংবাদিক নাদিমকে বিভিন্নভাবে হুমকিসহ তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে। পরবর্তীতে ময়মনসিংহের সাইবার ট্রাইব্যুনাল মামলাটি খারিজ করে দেন। মামলা খারিজের বিষয়টি নিয়ে ভিকটিম নাদিম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ায় বাবু আরো ক্ষিপ্ত হয়ে সাংবাদিক নাদিমকে উচিত শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৪ জুন রাত আনুমানিক ১০টার দিকে ভিকটিম নাদিম বাড়ি ফেরার পথে বকশীগঞ্জ বাজারের পাটহাটি এলাকায় বাবু তার সন্ত্রাসীদের নিয়ে নির্জন স্থানে ওঁৎ পেতে থাকে। ভিকটিম নাদিম তার সহকর্মীসহ মোটরসাইকেল যোগে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে বাবুর সন্ত্রাসীরা তাকে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পরবর্তীতে পিছন থেকে দৌঁড় দিয়ে বাবুর আরো কয়েকজন লোক এসে তাকে মারতে মারতে পাশের একটি অন্ধকার গলিতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় ও এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে। এসময় প্রধান অভিযুক্ত বাবু ঘটনাস্থলের কাছ থেকেই থেকে পুরো ঘটনার নেতৃত্ব দেন। ভিকটিম নাদিমের সহকর্মী তাকে বাঁচাতে গেলে বাবুর সন্ত্রাসীরা তাকেও মারধর করে। একপর্যায়ে ভিকটিম নাদিমের চিৎকার শুনে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে বাবু ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তী দিন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাংবাদিক নাদিম মারা যান।

মুখপাত্র মঈন বলেন, গ্রেপ্তারকৃত মাহমুদুল আলম বাবু সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা ও ভিকটিম নাদিমের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে উচিত শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা করে। ঘটনার পর থেকে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার এড়াতে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ীতে আত্মগোপনে ছিলেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় র‌্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তার হন। ইতিপূর্বে তার বিরুদ্ধে জামালপুরের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়াও গ্রেপ্তারকৃত রেজাউল, মনির ও জাকির মাহমুদুল হাসান বাবুর সন্ত্রাসী গ্রুপের অন্যতম সহযোগী। গ্রেপ্তারকৃত রেজাউল দৌড়ে গিয়ে নিহত নাদিমকে ধাক্কা দিয়ে মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দেয়। পরবর্তীতে ঘটনাস্থলেই বাবুর নির্দেশে তারা নাদিমকে বেদম প্রহার করতে থাকে। একপর্যায়ে পাশের একটি অন্ধকার গলিতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় ও এলোপাতাড়ি আঘাত করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে জামালপুরের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।