ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়েছেন যেসব রাষ্ট্র নেতারা
কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:৪৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
দেশে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে পদত্যাগ করেছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার (৫ আগস্ট) পদত্যাগের পর তিনি ভারতে আশ্রয় নেন। এর পরপরই দেশে হিংসাত্মক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গুঞ্জন উঠেছে তার যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেয়া নিয়ে। শোনা গেছে তিনি যুক্তরাজ্যে রাজনৈতকি আশ্রয় চেয়েছেন।
শেখ হাসিনাসহ ইতিহাসে অনেক রাষ্ট্রপ্রধানই আছেন যারা রাজনৈতিক ও নাগরিক অভ্যুত্থানের কারণে নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। শেখ হাসিনা থেকে পারভেজ মোশাররফ অনেকেই পালিয়েছেন নিজ দেশ থেকে। খবর ফাস্ট পোস্টের।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, অন্যান্য পদচ্যুত বিশ্ব নেতাদের মত সোমবার, বাংলাদেশে একই ঘটনা ঘটে, যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর পরপরই তার ছোট বোনকে নিয়ে ভারতে আগরতলা হয়ে দিল্লিতে চলে যান। তবে ভারত তার চূড়ান্ত গন্তব্য নয়। প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনা অনুমতি পেলে যুক্তরাজ্য চলে যেতে পারেন। তবে জানা গেছে যুক্তরাজ্যে তার রাজনৈতিক আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তাই জল্পনা উঠেছে তিনি ফিনল্যান্ড বা বেলারুশকেও বেছে নিতে পারেন তার আশ্রয়স্থল হিসেবে।
এর আগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিলো বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি বিক্ষোভের উপর মারাত্মক ক্র্যাকডাউন পরিচালনা করেন। এর পরপরই চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির দাবিতে দানা বাধতে শুরু করে। ওই আন্দোলন দমনের চেষ্টা করা হলে শতাধিক শিক্ষার্থী নিহত হয়, আহত হয়ে অনেকেই।
হাসিনা পদত্যাগ এবং নির্বাসনে যাওয়ার আগে প্রায় ১৫ বছর রাষ্ট্রের ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি গত ৩০ বছরের মধ্যে ২০ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছেন। শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকেই তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেয়েছিলেন। রাজনীতিতে আসার আগে ১৯৭৫ সালের একটি অভ্যুত্থানে তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ নিহত হন।
ওই ট্র্যাজেডির পর, শেখ হাসিনা নয়াদিল্লীতে আশ্রয় নেন, যেখানে তিনি ৬ বছর ধরে তার সন্তানদের সাথে বসবাস করেন। ১৯৮১ সালে তার বাবার দল আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এর আগ পর্যন্ত তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সরকারের অতিথি হিসেবে ভারতে বসবাস করছিলেন। চলুন জেনে নেয় যাক বিশ্বের সেসব নেতাদের সম্পর্কে যারা অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়ে তাদের নিজ দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন।
গোটাবায়া রাজাপাকসে (শ্রীলঙ্কা)
২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি ছিলেন গোটাবায়া রাজাপাকসে। প্রশাসনের তীব্র প্রতিবাদ এবং জনসাধারণের আন্দোলনে মুখে একটি গুরুতর অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দেশের অর্থনীতি তলানিতে চলে আসে। বিবিসির তথ্যানুসারে, দেশটি প্রতিদিনের বিদ্যুৎ উৎপাদ হ্রাস এবং এমনকি জ্বালানী, খাদ্য এবং ওষুধের মতো মৌলিক জিনিসগুলির ঘাটতির মুখোমুখি হয়।
প্রাথমিকভাবে, রাষ্ট্রপতি রাজাপাকসে, প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেসহ, সংকট নিরসনের চেষ্টা করেন। ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ ও সহিংসতায় গোটাবায়া তার সরকারী বাসভবন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রথমে মালদ্বীপে এবং তারপর সিঙ্গাপুরে যান তিনি। যেখানে থেকেই শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে, রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কায় ফিরে আসেন এবং বর্তমানে আসন্ন নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের দিকে নজর দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
আশরাফ ঘানি (আফগানিস্তান)
আশরাফ ঘানি ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২১ সালের গ্রীষ্মে, তালেবানরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ঘানি সরকার ক্রমবর্ধমান চাপ এবং হুমকির সম্মুখীন হন।
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুলে প্রবেশ করায় বিশৃঙ্খলা ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ঘানি আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যান। বিবিসির সাথে একটি সাক্ষাৎকারে, সাবেক আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি বলেন, রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে মাত্র ২ মিনিট সময় দেয়া হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে আবুধাবিতে যাওয়ার আগে তিনি প্রথমে তাজিকিস্তানে পালিয়ে যান, যেখানে তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল।
ঘানি পালানোর মাত্র কয়েক দিন আগেও, যুক্তরাষ্ট্রের এক সামরিক মূল্যায়ন ভবিষ্যদ্বাণী করে যে দেশের অন্য কোথাও তালেবানের অগ্রগতি হলেও কাবুল কয়েক সপ্তাহ বা এমনকি কয়েক মাস ধরে পতন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে। যদিও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তালেবানের দখলে যায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ। প্রায় ২ দশক ধরে বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মার্কিন এবং ন্যাটোর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
পারভেজ মোশাররফ (পাকিস্তান)
পাকিস্তানের জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনিও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
মোশাররফ ১৯৯৯ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন, পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পরে ২০০১ সালে মোশাররফ রাষ্ট্রপতি হিসাবে দেশ পরিচালনা শুরু করেন।
তার শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বিচার বিভাগের উপর ক্র্যাকডাউনসহ বিস্তর বিতর্ক ওঠে। ২০০৭ সালে তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সংবিধান স্থগিত করেন। প্রধান বিচারপতি এবং দেশের সুপ্রিম কোর্টকে বরখাস্ত করেন।
অভিশংসনের প্রক্রিয়া এড়াতে, মোশাররফ ২০০৮ সালে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং লন্ডনে স্ব-আরোপিত নির্বাসনে যান। পরে তিনি দুবাইতে চলে যান। পাকিস্তানে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর হত্যাসহ অসংখ্য আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। এর পরেও ২০১৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি পাকিস্তান ফিরে আসেন।
তবে পারভেজ মোশাররফের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ছিলো খুবই স্বল্পস্থায়ী, কারণ তাকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তীতে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। ২০২৩ সালে দুবাইয়ে মৃত্যু হয়ে মোশারফের। এর আগ পর্যন্ত তিনি আইনি লড়াইয়ে মধ্যে ছিলেন।
সোহার্তো (ইন্দোনেশিয়া)
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোহাম্মদ সোহার্তো ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। পরবর্তীতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
এর আগে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন সোহার্তে। তার শাসনামলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেলেও ব্যাপক দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মানুষকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার জনকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল।
১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে ইন্দোনেশিয়ায় অর্থনৈতিক সঙ্কট, এশিয়ার আর্থিক মন্দা তীব্র আকার হয়ে উঠলে দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ এবং অস্থিরতার দেখা দেয়। ১৯৯৮ সালের মে মাসে বিক্ষোভের তীব্রতা এবং পরিস্থিতি ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে, সোয়েহার্তো ৩১ বছর ক্ষমতায় থাকার পর প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তাকে জাকার্তায় নির্জন বাড়িতে নির্বাসিত করা হয়।
সাদিক আল-মাহদি (সুদান)
সাদিক আল-মাহদি, ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৭ এবং ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সুদানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধ এবং চলমান নাগরিক অস্থিরতাসহ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সঙ্গে লড়াই করে আসছিলেন। পরবর্তীতে দেশটিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
তার দ্বিতীয় মেয়াদে, তিনি উম্মা পার্টি এবং তার শ্যালক জাতীয় ইসলামিক ফ্রন্টের সমন্বয়ে একটি জোট সরকার গঠন করেন। এই জোটটি অস্থিতিশীল বলে প্রমাণিত হয়। ১৯৮৯ সালের জুনে ব্রিগেডিয়ার ওমর আল-বশিরের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে আল-মাহদিকে উৎখাত করা হয়।
অভ্যুত্থানের পর, আল-মাহদি বিভিন্ন দেশে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন এবং ২০১৮ সালে। দেশে ফিরে আসার আগে বিদেশ থেকে বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেন। পরে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় কিন্তু ২০১৯ সালে আবারো পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে কোভিড-১৯ মহামারী সংক্রমণে ২০২০ সালে তার মৃত্যু হয়।
অ্যারিস্টাইড (হাইতি)
হাইতির প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জিন-বার্ট্রান্ড অ্যারিস্টাইড তার উত্তাল রাজনৈতিক কর্মজীবনে নির্বাসনের সম্মুখীন হন। ১৯৯১ সালে প্রাথমিকভাবে তিনি নির্বাচিত হন। একই বছরের শেষের দিকে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে এরিস্টাইডকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। মার্কিন নেতৃত্বাধীন হস্তক্ষেপ তাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার পর ১৯৯৪ সালে তিনি আবারো দেশে ফিরে আসেন।
আরো পড়ুন: পুলিশকে কাজে ফেরাতে সহযোগিতা করছে ছাত্র-জনতা
এরিস্টাইড দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০১ সালে ক্ষমতায় ফেরেন। পরবর্তীতে দেশটি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয় এবং অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ৭ বছর নির্বাসনে থাকার পর, অ্যারিস্টাইড ২০১১ সালে হাইতিতে ফিরে আসেন।