×

শিক্ষা

ফলাফলে ধস নামিয়ে দেয়ার অভিযোগ ঢাবি অধ্যাপকের বিরুদ্ধে

Icon

ঢাবি প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:৫৩ পিএম

ফলাফলে ধস নামিয়ে দেয়ার অভিযোগ ঢাবি অধ্যাপকের বিরুদ্ধে

ছবি: সংগৃহীত

ঐচ্ছিক কোর্সে শিক্ষার্থীরা তালিকাভুক্ত না হওয়া, ফেসবুকের কার্যকলাপসহ বিভিন্ন কারণে ব্যক্তিগত আক্রোশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একটি সেশনের শিক্ষার্থীদের ফলাফলে ধস নামিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে। ২০২২ সালের স্নাতকোত্তর শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর এমন অভিযোগ করেছেন বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।  

এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই ফলাফল নিয়ে অন্যান্য সেশনের শিক্ষার্থীদের কাছে মন্তব্য করেছেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টারে ওই শিক্ষকের দুটি ঐচ্ছিক কোর্স ছিল। সে কোর্সগুলো কেউ না নেয়ায় ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে তিনি ফলাফলে ধস নামিয়ে দিয়েছেন।  

ভাইভাতে প্রশ্ন ‘কুকুরের পাঁচটি জাতের নাম বল’

সংশ্লিষ্ট ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাস্টার্স দ্বিতীয় সেমিস্টারের কোর্সের সমন্বয়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ। ফলে তিনি মাস্টার্সের পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও সমন্বিত কোর্সের পরীক্ষক ছিলেন। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই কোর্সটিতে ৫৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ জনই চার পয়েন্টের স্কেলে ৩ এর নিচে পেয়েছেন।

আরো পড়ুন: জাবিতে দলবদ্ধ ধর্ষণ, মূল পরিকল্পনাকারী মামুন গ্রেপ্তার

এর মধ্যে ২.৫০ পেয়েছেন ১৪ জন, ২.২৫ পেয়েছেন ১২ জন, ২.০০ পেয়েছেন পাঁচজন। এর মধ্যে, স্নাতক পর্যায়ে ফলাফলে প্রথম দশজনের মধ্যে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া ৬ জনের মধ্যে একজনই ২.৭৫ পেয়েছেন। অন্যরা ২.২৫ এর নিচে পেয়েছেন। এ ধরনের গ্রেডস-কে ‘নজিরবিহীন’ বলছেন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

ভাইভাতে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ভাইভাতে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে পরীক্ষার্থীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে ফেলতেন অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে জানা প্রশ্নের উত্তরও ভুল হয়েছে তাদের। ব্যাচের শিক্ষার্থী শাফাত রহমান ফেসবুকে লেখেন, ‘তিনি ভাইভাতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ইন্দিরা গান্ধীর সন্তান কতজন?’ আরেক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কয়েকটি কুকুরের জাতের নাম বল’। আরেক শিক্ষার্থী বলেন, তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, কপিল দেব ১৯৮৩ বিশ্বকাপে যার রেকর্ড ছিল, সেই খেলোয়াড়ের দেশের সাথে পরের বিশ্বকাপে দুইটা রেকর্ড করে। রেকর্ডগুলো কি কি?’ -এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে তিনি অন্য পরীক্ষকদের সামনেও শিক্ষার্থীর ‘ইম্প্রেশন’ খারাপ করে দেন। এরই প্রতিফলন ঘটেছে কম্প্রিহেনসিভ কোর্সের নাম্বারে।

বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমি ভাইভাতে ‘ইয়েস’ বলে তার একটা প্রশ্নের সাড়া দিয়েছিলাম। কেন তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করিনি- এ নিয়ে অন্তত দশ মিনিট ধরে আমাকে বকাঝকা করেন। ফলে ভাইভার শুরুতেই আমি নার্ভাস হয়ে যাই। সব সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর শেষে তিনি আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। তিনি আমাকে এতো প্রশ্ন করেন যে, অন্য একজন শিক্ষক তাকে শেষ করার অনুরোধ করেন। এরপরও অন্তত ৫-৭টি প্রশ্ন করেন। স্বাভাবিকভাবে সে সময় তিনি এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন যে, আমি জানা প্রশ্নের উত্তরও ভুল করছিলাম।  

এ অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক নাদীর জুনাইদ বলেন, কুকুরের জাতের নাম? ভাইভাতে এই প্রশ্ন করা হয়েছে? আমার তো মনে পড়ছে না কুকুরের জাতের নাম জিজ্ঞেস করা হয়েছে।  

প্রকাশিত হওয়ার আগে ফলাফল নিয়ে মন্তব্য

ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের পরিপন্থী। তবে, সাংবাদিকতা বিভাগের ১২তম ব্যাচের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগে তা নিয়ে ১৩তম ব্যাচের একটি ক্লাসে মন্তব্য করেন অভিযুক্ত শিক্ষক। ওই ব্যাচের এক শিক্ষার্থী জানান, কয়েকদিন আগে তিনি আমাদের ক্লাসে ১২তম ব্যাচের ফলাফল নিয়ে কথা বলেন। অথচ সেসময় ফলাফল প্রকাশিতই হয়নি। তিনি (অভিযুক্ত শিক্ষক) বলেন, ‘১২তম ব্যাচের রেজাল্টটা দেখবা কী অবস্থা। আমি ওদের রেজাল্টে ধস নামিয়ে দিয়েছি। কয়েকজন ফেল করতে করতে পাস করে গেছে।’ পরীক্ষার ফলাফলে প্রভাব পড়তে পারে- এমন আশঙ্কায় ওই শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ করেননি।  

আরো পড়ুন: জাবিতে রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট সিনেটরদের মানববন্ধন

মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) একইভাবে ১৬তম ব্যাচের (দ্বিতীয় বর্ষ) ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি ওই ব্যাচের এক শিক্ষার্থীকে তার রেজাল্ট বলে দেন। একই ব্যাচের অন্য একজন শিক্ষার্থী জানান, মঙ্গলবার বিকেল চারটা নাগাদ আমাদের ব্যাচের ফলাফল নোটিশ বোর্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে টাঙানো হয়। তবে, দুপুর দুইটার দিকেই ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীকে অধ্যাপক নাদির জুনাইদ বলে দেন। পরে ওই শিক্ষার্থী তার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেন।  

শিক্ষার্থীকে রেজাল্ট জানিয়ে দেয়ার বিষয়ে অধ্যাপক নাদির জুনাইদ বলেন, তখন রেজাল্ট হয়ে গিয়েছিল। রেজাল্ট শিট আমার হাতে ছিল। তখন ওদের সিআরকে আমি বললাম যে রেজাল্ট হয়েছে, তোমরা থেকো। রেজাল্ট হয়ে গেছে। তখন আমি হয়তো কে কত পেয়েছে সেটা বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু তখনই তো রেজাল্ট হয়ে গিয়েছিল।  

শিক্ষার্থীদের ফেসবুক অ্যাক্টিভিটি নজরদারি

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অধ্যাপক নাদির জুনাইদ শিক্ষার্থীদের ফেসবুক কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এর ভিত্তিতে তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে কেমন আচরণ করবেন, তা নির্ধারণ করেন। এমনকি, ফেসবুক কার্যক্রম দেখে পরীক্ষায় নম্বর দেয়ার হুমকিও দেন তিনি। সম্প্রতি দ্বিতীয় বর্ষের (১৬তম) শিক্ষার্থীদের এমন হুমকি দেন তিনি। তার কার্যক্রমে বিরক্ত হয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাকে নিয়ে পোস্ট করেন। এ নিয়ে সম্প্রতি ১৩ ব্যাচের এক শিক্ষার্থীকে কক্ষে ডেকে নিয়ে বকাঝকা করেন তিনি। বর্তমান শিক্ষার্থী হওয়ায় তিনিও নাম প্রকাশ করতে চাননি। ১২তম ব্যাচের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ভাইভা বোর্ডে তিনি আমার ফেসবুক কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমি বিভিন্ন সময় মজা করে অনেক পোস্ট করি। এ নিয়ে তিনি আমাকে বিব্রতকর কথা বলতে শুরু করেন। আমি ভাইভাতে কেঁদেও দিয়েছিলাম।  

খাঁজকাটা কুমিরের গল্প

বিভাগের শিক্ষার্থীরা জানান, অধ্যাপক নাদির জুনাইদ যে কোনো কোর্সের ক্লাসেই চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট কোর্স নিয়ে দুই-এক মিনিট কথা বলেই চলচ্চিত্রের আলোচনা শুরু করেন। প্রায় প্রতিটি ক্লাসেই একই ধরনের কথা বলেন।

১৩ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের ব্যাচের সার্বিক ফলাফল ভালো। তিনি আমাদের ক্লাসে এসে বলেন, ‘আমি যদি তোমাদের আরো কয়েকটি কোর্স নিতাম, তাহলে দেখতে তোমাদের রেজাল্ট কী হতো! তোমরা নাকি অনেক মেধাবী। দেখি তোমাদের মেধা কেমন। এমন কথা বলে তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ও সংলাপের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবে অনেকেই উত্তর দিতে পারে না। এ নিয়ে তিরস্কারও করেন তিনি।  

আরো পড়ুন: শিক্ষায় পদ্মা সেতুর চেয়ে বড় প্রকল্প নেয়া হবে

সার্বিক বিষয়ে অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ বলেন, কম্প্রিহেনসিভ কোর্স আমি নিই না। তারা সারা বছর যা পড়ে সবগুলো কোর্সের ওপরে তাদের কম্প্রিহেনসিভ পরীক্ষা নেয়া হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে একটা কোর্সে একজন শিক্ষক কীভাবে কমিয়ে দিতে পারে শিক্ষার্থীরা কি এটা বোঝে? পরীক্ষার নাম্বার তো একজন শিক্ষক দেন না। আর ভাইভাতেও তো একজন শিক্ষক থাকেন না। ভাইভা বোর্ডে চারজন থাকেন। তাহলে সেখানে একজন শিক্ষক অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেন কীভাবে?

পরবর্তী সময়ে চেয়ারম্যান হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় বাকি শিক্ষকেরাও মুখ খুলতে রাজি হননা, শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি আরো বলেন, শিক্ষার্থীরা কীভাবে ধারণা করে এই কথা বলে! এটা কোনো অভিযোগ হলো! আমি নেক্সট চেয়ারম্যান হলে বাকি শিক্ষকেরা আমাকে তোয়াজ করে আমার উপরে কোনো কথা বলবে না, এটা কোনো তো কথা না।  

এই ব্যাচের রেজাল্ট প্রকাশ করার এক মাস আগে নিচের ব্যাচগুলোকে রেজাল্ট বলে দিয়েছেন এমন অভিযোগ তিনি অস্বীকার করে বলেন, ‘না এমনটা আমি করিনি। আমি প্রতি ব্যাচকেই বলি তোমাদের কিন্তু রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না। আমি প্রতি সপ্তাহেই প্রেজেন্টেশন নিই। প্রেজেন্টেশনের দিনই সন্ধ্যায় আমি রেজাল্ট দিয়ে দেই। আমি তখন বলি দেখো, রেজাল্ট কমে গেল। কত কমে গেল? এমন হলে তো ভালো রেজাল্ট হবে না। আমি এটাও বলি, দেখো তোমাদের সিনিয়রদের গত বছরও এই কোর্স পড়িয়েছি, তারা নিশ্চয়ই ভুলে গেছে। তারা কিন্তু খারাপ করছে। তোমরা কিন্তু এমন করো না। আসলে তারা বানিয়ে বানিয়ে এসব কথা বলছে। আমিতো বলিনি কে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছে। এটা দুঃখজনক ও লজ্জাজনক।

তিনি আরো বলেন, তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে কেন? আমি কড়াভাবে ক্লাস নিই, ওদেরকে অনেক কড়াকড়া কথা বলি, অন্যান্য শিক্ষকদের মতো ঢালাওভাবে নম্বর দিই না, এজন্য অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App