×

অর্থনীতি

শুধু কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অর্থনীতিতে সুফল আনবে না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:১৬ পিএম

শুধু কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অর্থনীতিতে সুফল আনবে না
বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে প্রায় ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় প্রায় সাড়ে নয়শ কোটি টাকা কর দিয়ে বৈধ করেছেন সাত হাজার ৪৪৫ জন করদাতা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। চলতি বছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় সম্পর্কিত আইনে পরিবর্তন আসায় করদাতারা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে উৎসাহিত হয়েছেন বলে অনেকেই মনে করছে। কালো টাকা সাদা করার নৈতিকতা এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। অনেকদিন ধরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলেও চলতি বছরে এই সুবিধা গ্রহণের এই উল্লম্ফন নতুন করে অর্থনীতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে, কোভিড-১৯ অতিমারিতে সরকারের ব্যায় চাহিদা বেড়ে গেছে, এই কারণে রাজস্ব আহরণের বৃদ্ধিরও প্রয়োজন রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে কর আহরণ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সামাজিক আন্দোলন, তথ্যের স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। এ সকল মন্তব্য সহ অপ্রদর্শিত আয় বৈধ হবার ফলে দেশের অর্থনীতির কি প্রকৃতপক্ষে লাভ হচ্ছে, না লাভের চাইতে ক্ষতি বেশি হচ্ছে তা নিয়েও নানা দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর ভার্চুয়াল সংলাপ - "কালো টাকা সাদা হচ্ছে: অর্থনীতির লাভ, না ক্ষতি?" সংলাপটি আয়োজিত হয় মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি)। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন যে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া নিয়ে বিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সামাজিক অর্থনীতি তথা রাষ্ট্রের এখতিয়ার। কালো টাকাকে কর প্রদানের সময় ’অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞায়িত করে গুরুতর অপরাধটিকে হালকা করার অবস্থান নেয়াকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে সমালোচনা হচ্ছে। রাস্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘দুর্নীতিজাত অনুপার্জিত আয়’ এর উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা। দুর্নীতিজাত কালো টাকা লালন করার সংস্কৃতি থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মিলবে না। জনাব মোঃ ফরিদ উদ্দিন, সাবেক সদস্য (শুল্কনীতি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংলাপে বলেন যে, কালো টাকা আয়ের মূল কারণ হল সুশাসনের অভাব। তিনি মন্তব্য করেন যে কালো টাকা রোধে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। জনাব মোঃ আলমগীর হোসেন, সদস্য (আয়কর নীতি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মন্তব্য করেন যে অপ্রদর্শিত আয় মূল ধারায় নিয়ে আসার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন যে বিশেষ কর সুবিধার মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা দিলে সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নয়নে সাহায্য করবে। সিপিডি’র চেয়ারম্যান, অধ্যাপক রেহমান সোবহান বিশেষ মন্তব্যে বিশেষ কর সুবিধার সুফল নিয়ে প্রশ্ন করে বলেন যে, এ ধরণের সুবিধা সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে। তিনি বিশেষ কর সুবিধা সত্যিই অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক কিনা, এই বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে গবেষণা করার পরামর্শ দেন। জনাব রিজওয়ান রাহমান, সভাপতি, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং কোস্ট ট্রাস্ট-এর নির্বাহী পরিচালক, জনাব রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন যে, বর্তমান কালো টাকা সাদা করার সুযোগের থেকে সৎভাবে কর দেয়া বেশি ব্যয়বহুল। এই সুযোগের কারণে মানুষ সৎভাবে কর দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারে। কালো টাকা সাদা করার উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ বলে মত দেন মাল্টিমোড গ্রুপ-এর পরিচালক জনাব তাবিথ আউয়াল। দৌলত আকতার মালা, দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর বিশেষ প্রতিনিধি কর কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা ও সক্ষমতার গুরুত্ব তুলে ধরেন। জনাব সুশান্ত সিনহা, যমুনা টেলিভিশন লিমিটেড-এর বিশেষ প্রতিনিধি মনে করেন যে এই পরিস্থিতির সমাধান পেতে রাজস্ব বোর্ডের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরী। কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত আয়ের পার্থক্য স্পষ্টভাবে আলাদা করে দেখতে বলেন জনাব কামরান টি রহমান, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) প্রেসিডেন্ট। জনাব মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, হেড অফ প্রোগ্রাম ও কমিউনিকেশনস, এমআরডিআই মন্তব্য করেন যে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ একটি অর্থনীতিতে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ বৃদ্ধি সাহায্য করে না। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এবং সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। আলোচনার সারসংক্ষেপ করে তিনি বলেন, কালো টাকা সাদা করার এই সুযোগ অন্যায্যবোধকে প্রশ্রয় দেয়। সীমিত আকারে ও স্বল্প সময়ের জন্য এই সুযোগ অর্থনীতির জন্য সহয়ক হলেও, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে এর ক্ষতির কথা তিনি উল্লেখ করেন। জনাব মো. শফিউল ইসলাম, এমপি, সদস্য, শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সাংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। জনাব এম এস সিদ্দিকী, লিগ্যাল ইকোনোমিস্ট এবং আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব মো. মনিরুজ্জামান সংলাপে বক্তব্য রাখেন। নাগরিক প্লাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্যদের পক্ষ থেকে ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টি আই বি এবং সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, রাজস্ব ও কর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, বাবসায়ীদের প্রতিনিধি এবং অর্থনীতিবিদ সহ সংশ্লিষ্ট অংশীজন–এই ভার্চুয়াল সংলাপে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মতামত ও মন্তব্য তুলে ধরেন। এছাড়াও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ এনজিও প্রতিনিধি, সমাজকর্মী, পেশাজীবি এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App