×

মুক্তচিন্তা

রওশন আরা : মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ছবি

Icon

মুক্তচিন্তা কলাম লেখক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৬:৫০ পিএম

ঢাকার কলেজ পড়ুয়া এক ছাত্রীর বুকে মাইন বেঁধে এই আত্মত্যাগ একাত্তরে একদিকে সৃষ্টি করেছিল ব্যাপক উদ্দীপনার। রওশন আরা যেন চিরায়ত বাংলার বিদ্রোহী নারীর প্রতিমূর্তি।

১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল আগরতলার দৈনিক সংবাদের প্রথম পাতায় দুই কলামে ছোট একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘ঢাকার রওশন আরা তার অমূল্য জীবনকে অর্ঘ্য দিয়ে মানুষের ইতিহাসে চিরস্থায়ী অধ্যায় রচনা করেছে। রওশন আরা ঢাকা মহিলা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পাক বাহিনীর ট্যাঙ্কের আক্রমণে যখন ঢাকার নাগরিক জীবন বিধ্বস্ত তবু মানুষের মনে স্বাধীনতার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস থাকেনি। তখন এই তরুণী তার বুকে মাইন বেঁধে নিয়ে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্যাঙ্কের নিচে। গোলাবোঝাই এই ট্যাঙ্ক তীব্র গর্জনে মুখ থুবড়ে পড়ে। রওশন আরা তার জীবনকে সার্থক করে তুলেছে মহৎ আত্মদানের মধ্য দিয়ে।’

আগরতলার দৈনিক সংবাদ তখন বেশ জনপ্রিয় পত্রিকা। সর্বভারতীয় পত্রিকা তো বটেই, বিশ্বের বেশ কিছু নামি দামি গণমাধ্যমের বাংলাদেশ বিষয়ক সংবাদের প্রধান তথ্যসূত্র তখন দৈনিক সংবাদ। আগরতলায় তখন বিপুল সংখ্যক বিদেশি সাংবাদিকের আনাগোনা। তাদের কল্যাণে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। রওশন আরা হয়ে পড়ে বিশ্ব গণমাধ্যমের মূল আলোচ্য বিষয়। রওশন আরা পরিণত হয় অকুতোভয় বাঙালি নারীদের আদর্শ হিসেবে। দেশে-বিদেশে গড়ে ওঠে অসংখ্য রওশন আরা বিগ্রেড। রওশন আরার এই জীবন উৎসর্গ, জ¦লন্ত আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম হয়ে পড়ে পুরো ভারতের আলোচনার বিষয়বস্তু। আগরতলার স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা পালন করে রওশন আরা দিবস। একই দিবস ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পালন করা হয় পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে। ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, দিল্লি, বিহারসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে গড়ে ওঠে রওশন আরা বিগ্রেড, রওশন আরার নামেই সংগৃহীত হতে থাকে চাঁদা।

রওশন আরার পাশাপাশি সংবাদ পত্রিকার যে সাংবাদিক এই সংবাদ করেন তিনিও বিখ্যাত হয়ে পড়েন বিশ্বগণমাধ্যমে। সর্বভারতীয় পত্রিকাগুলোতে সংবাদের বিকচ চৌধুরীর নাম ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশের অনেক নামি দামি সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যম বিকচ চৌধুরীর সঙ্গে নিত্য-নতুন সংবাদের জন্য যোগাযোগ শুরু করেন।

কয়েক মাস পরেই কলকাতায় রওশন আরা বিপ্লব ঘটে যায়। আনন্দবাজার হেডলাইন করলে যুগান্তর ছাপায় জীবন বৃত্তান্ত। অমৃতবাজার উপসম্পাদকীয়, তো স্টেটসম্যান শ্রদ্ধার্ঘ্য! সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হয় রওশন আরার জীবন বৃত্তান্ত। ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী রওশন। বাবা পুলিশ কর্মকর্তা। সম্পর্কে শেখ মুজিবের আত্মীয়া। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে রাজশাহীর নাটোরে নিজ বাড়িতে ছিল রওশন। উত্তরবঙ্গে প্রতিরোধ শুরু হলে মহিলাদের নিয়ে গড়ে তোলেন বিগ্রেড। এক রাতে সংবাদ পায় বগুড়া সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি আর্মি রাজশাহীর দিকে রওনা দিয়েছে। প্রতিরোধ করতে হবে সেনাবাহিনীকে। সিদ্ধান্ত নিলেন বুকে মাইন বেঁধে প্রতিরোধ করবেন পাকিস্তানি আর্মির। পরলেন প্রিয় সবুজ শাড়ি, বুকে তিনটি মাইন, উড়িয়ে দিলেন পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক। উড়ে গেল উনিশ পাকিস্তানি সৈন্য। সংবাদের পর রওশন আরাকে নিয়ে রচিত হলো সাহিত্য। কেউ কবিতা লিখলেন, তো কেউ গান, কেউ নাটক। এগিয়ে এলো পলিটিকাল পার্টিজ। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া করে রোশেনারা দিবস, তো কংগ্রেস করে রোশেনারা রজনী! সে এক এলাহী কাণ্ড! এছাড়া ১৯৭১-এ যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর প্রথম দুটি গোলন্দাজ ইউনিটের একটির নাম রাখা হয়েছিল মুজিব ব্যাটারি, আর আরেকটির রওশন আরা ব্যাটারি। কর্নেল সাজ্জাদ জহির বলছিলেন একাত্তর সালে তার ওপর চাপ আসছিল তার সামরিক ইউনিটের নাম রওশন আরার নামে করার জন্য। তিনি রাজি হননি, কারণ ঘটনাটি তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি।

প্রকৃত অর্থে রওশন আরা নামের কোনো কলেজছাত্রীর ট্যাঙ্কের নিচে মাইন বেঁধে মারা যাওয়ার কাহিনীর সত্যতা পরবর্তী সময়ে পাওয়া যায়নি। রওশন আরা ছিলেন সাংবাদিক বিকচ চৌধুরীর কাল্পনিক সৃষ্টি। সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ করে মহিলাদের সাহস জোগাতে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। আর এক অর্থে রওশন আরা ছিলেন একটি প্রতীক। বাংলার লাখ লাখ সাহসী নারীর একজন। যারা সশরীরে যুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ পাননি তারাও রওশন আরার কাহিনীতে উজ্জীবিত হয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যে রওশন আরাকে নিয়ে এত আলোচনা, এত আগ্রহ সেই রওশন আরা কিংবা এর জনক বিকচ চৌধুরী পরবর্তী সময়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখোমুখি হয় এই ঘটনার জন্য। বিকচ চৌধুরী তার ‘লক্ষ মুঠিতে ঝড়ের ঠিকানা’ গ্রন্থে এই ঘটনার অবতারণা করে বলছেন, মূলত রণাঙ্গনের শৌর্যবীর্যের গৌরবগাথা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এই কাল্পনিক ঘটনার অবতারণা। আমি প্রথমেই এই কাল্পনিক মেয়ের নাম দিয়েছিলাম ফাতেমা। কিন্তু ছফা ভাই (আহমদ ছফা) কলম হাতে নিয়ে বলে উঠলেন কলেজপড়ুয়া মেয়ের আধুনিক নাম হওয়া উচিত। তিনি নামটি শুদ্ধ করে দিয়েছিলেন রওশন আরা। আর আহমদ ছফা তার অলাতচক্র উপন্যাসে বলছেন, বিকচ নাম দিয়েছিল ফুলজান। আমি সংশোধন করে দেই রওশন আরা দিয়ে। বিকচ চৌধুরী সম্পর্কে এখানে তিনি বলছেন, ‘বিকচ নিউজপ্রিন্টের প্যাড নিয়ে বসলেই গানবোট ডুবত, কনভয়ের পর কনভয় সৈন্য ধ্বংস হয়ে যেত; ট্রেনলাইন উড়ে যেত। তথাপি বিকচ সাইকেলটাতে প্যাডেল ঘুরিয়ে সীমান্ত অবধি যেত, কারণ প্রতিদিন যেতে যেতে ওটা তার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বিকচ তার ছোট্ট পত্রিকার পাতায় এত সৈন্য মেরেছে, এত ট্যাঙ্ক ছারখার করেছে, এত কর্নেল বিগ্রেডিয়ার বন্দি করেছে, আগরতলার মানুষ তার মারণ ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে পাকিস্তানি সৈন্যের যম টাইটেল দিয়েছে।’ আহমদ ছফা বলছেন পরবর্তী সময়ে ভারতের জনমানসে রওশন আরা এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে, কখনো সাহস হয়নি বলার, বিকচের এই গল্পটি মিথ্যা।

বিকচ চৌধুরীর এই কাল্পনিক সংবাদ পরিবেশন, কল্পিত চরিত্র যতই উদ্দীপনামূলক হোক না কেন এটা সংবাদপত্রের নীতি বিবর্জিত। এর ফলে একাত্তরে সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত অনেক সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অনেকেই এটাকে বিকচ চৌধুরীর সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের চেষ্টা বলে অভিহিত করেন। এই ধরনের সংবাদ কেন তিনি করতে গেলেন- এই প্রশ্নটি করেছিলাম বিকচ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একাত্তরে টাইমস অব ইন্ডিয়ার আগরতলা প্রতিনিধি জ্যোতিপ্রকাশ সইকিয়াকে। তিনি বললেন, মূলত বিকচ বিশ্বব্যাপী মানুষের হৃদয়ে সহমর্মিতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এটা করেছেন, তবে একজন সাংবাদিক হিসেবে এই ধরনের কাল্পনিক সংবাদ পরিবেশন করা বিকচের উচিত হয়নি।

মুখোমুখি হয়েছিলাম বিকচ চৌধুরীর। স্বভাবতই জানতে চেয়েছিলাম, কেন তিনি এ ধরনের কাল্পনিক গল্পের আশ্রয় নিলেন। বিকচ চৌধুরীর মতে, এটি তার ৪০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকতা, শ্রেষ্ঠ অর্জন। চরিত্রটি কল্পিত হলেও একাত্তরে আগরতলাসহ ভারতের নানা জায়গায় রওশন আরার নামে মিছিল বের হয়েছে। লোকজন সাহায্য সহযোগিতা করেছে। প্রকৃত অর্থে আমি রওশন আরা কল্পিত চরিত্রের মধ্য দিয়ে বীর বাঙালির অপরিসীম আত্মত্যাগকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। একজন সাংবাদিক হিসেবে এটা সাংবাদিকতার নীতি বিবর্জিত কিনা, প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, জনগণের আবেগে অভিঘাত হানার জন্য, শরণার্থীদের সহায়তা বৃদ্ধির জন্য এটা আমি করেছি। নীতি-নৈতিকতা ভেবে দেখিনি। তবে আমি গর্ব করি, রওশন আরা চরিত্রটি সৃষ্টির জন্য। রওশন আরা চরিত্রটি কাল্পনিক হলেও, একাত্তরে এই কাল্পনিক চরিত্রের প্রভাব ছিল অপরিসীম। একাত্তরে আগরতলা, শিলচর, গোয়াহাটি, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয় থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো দেখলেই রওশন আরা বিগ্রেডের নানা কর্মসূচি চোখে পড়ে। রওশন আরা উদ্দীপিত করেছিল হাজারো মুক্তিকামী তরুণকে, নারীকে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে রওশন আরার গল্প ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই শিবির ছেড়ে যোগ দেন মুক্তিফৌজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে।

ঢাকার কলেজ পড়ুয়া এক ছাত্রীর বুকে মাইন বেঁধে এই আত্মত্যাগ একাত্তরে একদিকে সৃষ্টি করেছিল ব্যাপক উদ্দীপনার। রওশন আরা যেন চিরায়ত বাংলার বিদ্রোহী নারীর প্রতিমূর্তি। অন্যদিকে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের কাল্পনিক সংবাদ সম্পূর্ণরূপে সাংবাদিকতার নীতি- নৈতিকতা বিবর্জিত।

চৌধুরী শহীদ কাদের : শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App