শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে যা লিখেছে গার্ডিয়ান
কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৯ এএম
ছবি: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের অন্যতম মিত্র ছিলেন। তবে চলতি বছর আগস্টে হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ প্রেক্ষাপটে ভারত এখন একটি কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। হাসিনার দীর্ঘকালীন সমর্থক হিসেবে পরিচিত দিল্লি, এখন নতুন বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানোর চাপে পড়েছে।
আগস্টের শুরুতে, যখন বাংলাদেশজুড়ে বিক্ষোভ তীব্র হয়ে ওঠে এবং প্রতিটি রাস্তায় মৃতুর মিছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত একটি হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। তার সাথে কোনো রাজনৈতিক সহযোগী বা সিনিয়র মন্ত্রী ছিলেন না। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি ভারতে পৌঁছে যান এবং সেই থেকে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ছাত্র বিক্ষোভ থেকে শুরু হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন হাসিনার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন চালায়, ফলে শত শত মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়। এই পরিস্থিতিতে, ৫ আগস্ট হাসিনা যখন তার বাসভবন ত্যাগ করেন, তখন বাংলাদেশজুড়ে সাধারণ মানুষ উদযাপনে মেতে ওঠে। তবে দিল্লিতে, হাসিনার পতনকে দেখা হয় বিপর্যয় হিসেবে।
ভারত বহুদিন ধরেই শেখ হাসিনার অন্যতম প্রধান সমর্থক ছিল। ১৯৭৫ সালে তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর তাকে ভারতে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। সেখানে তিনি ৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিবারের সাথে নির্বাসিত ছিলেন। দিল্লির সাথে হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতার মাধ্যমেই বাংলাদেশকে ভারতের প্রধান আঞ্চলিক মিত্রে পরিণত করেছিলেন হাসিনা।
তবে, ভারতীয় কর্মকর্তাদের উপর বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ উঠেছে, যা হাসিনার শাসনকালকে আরো কঠোর ও স্বৈরাচারী করে তুলেছিল। বিরোধীরা অভিযোগ করেছে, দিল্লি হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে এবং নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে বিদেশি শক্তিগুলিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর, হাসিনা প্রথমেই তাকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, ভারতকে তাদের নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করছে। তারা এই মুহুর্তে হাসিনা সরকারের কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চায়। নতুন সরকার দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে।
ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎ নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন । তার বিরুদ্ধে হত্যা ও অপহরণের অভিযোগে শতাধিক মামলা দায়ের হয়েছে এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাম্প্রতিক বিক্ষোভের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। বাংলাদেশের সরকার তার কূটনৈতিক পাসপোর্টও বাতিল করেছে, যার মাধ্যমে তিনি ভারতে প্রবেশ করেছিলেন।
বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারতকে আহ্বান জানিয়েছেন শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর জন্য। তিনি অভিযোগ করেছেন, শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এখন তাদের নিজেদের জন্য সংকটময় হয়ে উঠেছে। ভারত এখন একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে এবং বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।
ভারতের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, তা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি। বরং দিল্লি স্থিতিশীলতা এবং আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের কথা বলেছে, যা বাংলাদেশের নতুন সরকারের লক্ষ্যগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞানী আলী রিয়াজ বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকারের আকস্মিক পতনে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চরম ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছে। এই পতন ভারতকে হতবাক করেছে এবং প্রস্তুতিহীন অবস্থার মধ্যে ফেলেছে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে ভারতের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ভারতে-বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ভারতের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়।
রিয়াজ বলেন, ভারত বাংলাদেশ নিয়ে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে, যেখানে তারা শুধুমাত্র শেখ হাসিনা এবং তার দলের ওপর নির্ভরশীল ছিল, রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্র সম্পর্কের পরিবর্তে। এর ফলে, ভারত এখন একটি সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে যা তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেছে।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরের কয়েক সপ্তাহে মোদি সরকারের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের নতুন সরকারের গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রচেষ্টার প্রতি খুব কম মনোযোগ দিয়েছে। বরং ভারতের পক্ষ থেকে দেশের স্থিতিশীলতা এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের প্রতি হুমকির ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
এই সপ্তাহেও, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে মোদির ফোনালাপের পর ভারতের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে এই উদ্বেগ পুনরায় তুলে ধরা হয়। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বিবৃতিতে বাংলাদেশের উল্লেখ ছিল না, ভারতীয় পক্ষ থেকে জানানো হয়, দুই নেতাই ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ এবং আইন-শৃঙ্খলা দ্রুত পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
আরো পড়ুন: ভারতের কূটনৈতিক মাথাব্যথার কারণ শেখ হাসিনা!
ভারতের এ ধরনের মন্তব্য বাংলাদেশে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এক বাংলাদেশি বিশ্লেষক বলেন, আমরা স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছি না, আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছি।
অনুবাদ: দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে