রামগড়ের পাতাছড়া গণহত্যার ৩৮ বছর, আজও মেলেনি স্বীকৃতি
রামগড় প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪, ১১:৩৭ এএম
ছবি: ভোরের কাগজ
১৯৮৬ সালের ১৩ জুলাই খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড়ে পাহাড়ের তৎকালীন সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল শান্তিবাহিনীর হাতে গণহত্যার শিকার পাতাছড়ার ডাকবাংলা এলাকার নিরীহ ৭ বাঙ্গালীর গণকবরের সামনে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া-মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার (১৩ জুলাই) সকালে পাতাছড়ায় গণকবরের সামনে গণহত্যার ৩৮ বছর উপলক্ষে দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করে নিহতদের স্বজনসহ এলাকাবাসী।
পাতাছড়া জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মো. আবু হানিফে নেতৃত্বে দোয়া মোনাজাতে অংশ নেন- গণহত্যায় নিহত আদম ছফি উল্লাহর ছেলে মো. ইয়াছিন ও আবু ইউসুফ, ছবুরী খাতুনের ছেলে নজরুল ইসলাম, হালিমা বেগমের ছেলে মো. নাছিরসহ সমাজ কমিটির সভাপতি মো. মন্তাজ মিয়া, মো. ইব্রাহিম খলির, মো. সেলিম মিয়া, আল-আমিন, শিমুল, সাইফুল ইসলামসহ প্রমুখ।
কান্না আর আহাজারিতে মূহূর্তেই ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। কারো বাবা, কারো মা, কারো ভাই কিংবা বোন চোখের সামনে নির্মমভাবে হত্যার স্বীকার হয়েছিলো সেদিন, তাইতো আজ ৩৮ বছর পরেও কলিজার টুকরা স্বজনের কবরের পাশে উপস্থিত প্রিয়জনরা।
এ সময় গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী, নিহতদের স্বজন ও স্থানীয়রা, নিহতদের গণকবর সংরক্ষণের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে তিন পার্বত্য জেলায় সংগঠিত বিভিন্ন গণহত্যার নথিপত্রে রামগড়ের পাতাছড়া গণহত্যার ঘটনা প্রকাশ করার দাবি জানান সরকারের কাছে। এছাড়া বাস্তুভিটাহীন পরিবারগুলোকে নিজ ভূমিতে ফেরত পাঠানো ও প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার দাবি তাদের।
আরো পড়ুন: প্রশ্নফাঁসে কোটিপতি নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদত
জানা যায়, গণহত্যা দিবসের প্রতি বছরই গণকবরের পাশে দোয়া ও মোনাজাতের এ আয়োজন করে নিহতের স্বজন ও স্থানীয় যুবকরা।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৬ সালের আজকের এইদিনে (১৩ জুলাই) খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড়ে পাহাড়ের তৎকালীন সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল শান্তিবাহিনীর হাতে গণহত্যার স্বীকার হন পাতাছড়ার ডাকবাংলা এলাকার বেশ কয়েকজন নিরীহ বাঙ্গালী মুসলিম জনতা। ঘটনাচক্রের ৩৮ বছর আজ। সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেনি ডাকবাংলা পাড়ার বাসিন্দারা। তৎকালীন শান্তিবাহিনীর একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসীর এলোপাতাড়ি গুলি ও অগ্নিসংযোগে সেদিন নিহত হয়েছিল ৫ শিশুসহ ৭ জন। কয়েকদিন পর ঘটনাস্থলের খুব কাছ থেকে আরো একজনের মরদেহ উদ্ধার করেছিল স্থানীয়রা। একই বছরের ১৩ আগস্ট বাড়ির পাশের টিলায় গরু চরাতে গেলে স্বজনদের সামনে থেকে মো. আদম ছফি উল্লাহ নামে একজনকে ধরে ফেনী নদীর পিলাক ঘাটের ওপারে নিয়ে যায় শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। পরবর্তীতে তার লাশ না পাওয়া গেলেও সন্ত্রাসীরা তাকে কেটে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলো বলে জানায় ভারত ফেরত উপজাতি শরণার্থীরা।
প্রথমদিনের ঘটনায় নিহতদের গণকবরে ঠাঁই হলেও পরবর্তীতে নিহতদের কপালে তাও জুটেনি। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর পরপর এমন হামলায় ভয়ে পালিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল ২ শতাধিক পরিবার। কয়েক বছর পর নিজেদের বাস্তুভিটায় ফেরার চেষ্টা করলেও তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশাসন ফিরতে দেয়নি। ফেরা হয়নি গত ৩৮ বছরেও।
কয়েক বছর আগে শান্তিবাহিনীর হাতে সেদিন নির্মমভাবে নিহতদের স্বজন ও এলাকাবাসী ডাক বাংলা এলাকায় গণকবরটি সংস্কার করে গণকবর ও গণহত্যার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে টানিয়েছেন একটি সাইনবোর্ড। সরকারী ভাবে গণকবরটিতে স্বীকৃতিসহ গণহত্যায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, দোষীদের বিচার ও নিজ ভূমিতে ফেরার ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
আরো পড়ুন: শ্রীমঙ্গলে জমিসংক্রান্ত বিরোধে শিক্ষানবিশ আইনজীবী নিহত
মো. নাসির উদ্দিন নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ঘটনার দিন মাগরিবের কিছু সময় আগে হঠাৎ করে একদল অস্ত্রধারী শান্তিবাহিনীর সদস্য বাড়িতে ঢুকে পড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগে এলোপাঁতাড়ি গুলি ছুঁড়ে। এ সময় গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় কেউ কাউকে উদ্ধারে এগিয়ে আসতে পারেনি। সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। আমার (নাসির) ছোট ভাই আবুল কাশেমকে আগুনে নিক্ষেপ করে। এ সময় আমাকে নিয়ে মা বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করে। মায়ের কোলে একবছর বয়সী ছোট বোন আনোয়ারা থাকলেও ভুলে আরেক বোন মনোয়ারাকে বাড়ির ভেতর রেখে আসেন। মনোয়ারাকে আনতে মা বাড়ির ভেতর গেলে সন্ত্রাসীরা মাকে গুলি করে এবং ছোট বোন আনোয়ারাকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে আগুনে নিক্ষেপ করে। আর মনোয়ারাকে মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে খুন করে। পরেরদিন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সহ গিয়ে মরদেহগুলো উদ্ধার করে রাস্তার পাশে গণকবরে দাফন করি।
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নজরুল ইসলাম জানান, ১৩ জুলাই সকালে পাতাছড়ার ডাকবাংলা গ্রামে বাইরে থেকে কিছু অপরিচিত লোকজন আসে। স্থানীয় এক পাহাড়ীর বাড়িতে তারা কাজে এসেছেন বলে জানান। আসরের পরপর যখন হামলা শুরু হয় তখন তাদেরকেও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে দেখার কথা জানান নজরুল। বাড়িতে ঢুকে মা ছবুরী খাতুনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে এবং বোন রেহানা আক্তারকে আগুনে নিক্ষেপ করে হত্যার কথা ভুলতে পারেনি এখনো।
পাতাছড়ার বাসিন্দা ও তৎকালীন আনসার সদস্য মো. মমতাজ মিয়া জানান, ৩৪ বছর অতিবাহিত হলেও নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত গণহত্যার কোনো নথিতে উল্লেখ নেই। স্বজন হারানোর কষ্ট বুকে চেপে জীবন রক্ষায় সেদিন কোনো মতে একটি কবরে স্বজনদের রেখে চলে যেতে হয়েছিল নিরহ গ্রামবাসীদের।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে সেদিন পাতাছড়া ডাকবাংলা পাড়া গণহত্যায় নিহত হয়েছিলেন, আবুল খায়েরের স্ত্রী হালিমা বেগম (৫৫), মেয়ে মনোয়ারা বেগম (৬), ছেলে আবুল কাশেম (৫), আনোয়ারা বেগম (১), ছায়েদুল হকের স্ত্রী ছবুরী খাতুন ও মেয়ে রেহানা রেহানা আক্তার। লাল মিয়ার মেয়ে মফিজা খাতুন। ১৯৮৬ সালের ১৩ জুলাই নিহতদের সবাইকে পাতাছড়া এলাকায় গণকবর দেয়া হয়। পরেরদিন ১৪ জুলাই মো. সাত্তার নামে একজনের গলাকেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।