×

সারাদেশ

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি বিভাগ

জিম্মি দশ বছর, কোটি কোটি টাকা হরিলুট

Icon

মসিউর ফিরোজ, সাতক্ষীরা থেকে

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৪, ১০:৩৫ পিএম

জিম্মি দশ বছর, কোটি কোটি টাকা হরিলুট

ছবি: সংগৃহীত

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (সামেক) প্যাথলজি বিভাগকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হরিলুট করে সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছে প্যাথলজিষ্ট সুব্রত। মাত্র এক বছরে সামেকের সামনে প্রায় দেড় কোটি টাকার জমি, এ্যালিয়ন লেটেষ্ট মডেলের গাড়ী, চড়া বেতনে নিজস্ব ড্রাইভার, প্রতিদিন ৪০-৫০ হাজার টাকা আয়, আলিশ্বান বাড়িতে ভাড়া থাকা সবমিলে রাজকীয় প্রত্যাবর্তন তার। স্বপ্নের রূপ কথা, বাস্তবে রূপ দিয়েছে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারি প্যাথলজিস্ট অর্থলোভী সুব্রত কুমার।

২০১৪ সালে সামেক হাসপাতালে যোগদান করে সুব্রত। দীর্ঘ দশ বছর একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুবাদে দিনের পর দিন নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বেশির ভাগ সময় হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের স্বীয় কলে জিম্মি করে প্যাথলজী বিভাগে ক্যাশ কাউন্টারের রশিদ ছাড়া প্রতিদিন তিন থেকে চার শতাধিক রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছে। রশিদ ছাড়া এসব অবৈধ্য অর্থ ভাইপো অনিমেষের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে ইনর্চাজ সুব্রতর পকেটে। তারপর যথারিতি পরিচালক, উপ-পরিচালক ও প্যাথলজিষ্টের মধ্যে ভাগাভাগি।

এছাড়া রি-এজেন্ট (মালামাল ক্রয়) ঠিকাদারের যোগসাজসে মোটা অংকের কমিশনসহ আউট সোসিং জনপ্রতি তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয় সুব্রত। সেখানে দায়িত্বরত প্যাথলজী বিভাগের ইনর্চাজ সুব্রতর নির্দেশে প্রকাশ্যে এই অনিয়ম করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সরেজমিনে জানা গেছে, ২০২৩ সালের প্রথম দিকে পরিচালক শীতল চৌধুরীর যোগদানের পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি সুব্রতর। দুর্নীতিবাজ পরিচালকের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা তিন সদস্যের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বিশেষ দায়িত্বে, তৎকালিন শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্বে থাকাকালিন সময়ে উক্ত কমপ্লেক্সে হরিলুট করে আসা, বর্তমান সামেক হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক দুর্নীতির শিরোমনি ডা. অজয় কুমার। আরেক সদস্য মুখ্য দায়িত্ব পালন করা প্যাথলজিষ্ট অবৈধ্য অর্থলোপাটের নায়ক মাষ্টার মাইন্ড সুব্রত কুমার।

আরো পড়ুন: সাতক্ষীরায় আত্মহত্যার চেষ্টাকারী স্ত্রীকে বাঁচিয়ে স্বামীর আত্মহত্যা

ত্রয়ের সমন্বয়ে সামেক হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজী ৩১৪ ও ৩১৫ নাম্বার রুমের সামনে চেয়ার টেবিল বসিয়ে সুব্রতর একান্ত সহযোগী (আউট সোসিং) ভাইপো অনিমেষের তত্ত্বাবধানে নিজস্ব ক্যাশ কাউন্টার তৈরি করে রেখেছে। সেখানে তাদের নিজস্ব তৈরি রশিদ (টু-কপি) ব্যবহার করে টাকা নিচ্ছে। বেশির ভাগ সময় হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের স্বীয় কলে জিম্মি করে প্যাথলজী বিভাগে ক্যাশ কাউন্টারের রশিদ ছাড়া প্রতিদিন তিন থেকে চার শতাধিক রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছে। যার পরিমান প্রায় দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা।

এছাড়া রি-এজেন্ট (মালামাল ক্রয়) ঠিকাদারের যোগসাজশে মোটা অংকের কমিশনসহ আউট সোসিং জনপ্রতি তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয় সুব্রত। সেখানে দায়িত্বরত প্যাথলজী বিভাগের ইনর্চাজ সুব্রতর নির্দেশে প্রকাশ্যে এই অনিয়ম করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

আরো জানা গেছে, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্যাথলজী বিভাগের ইনর্চাজ সুব্রত দীর্ঘদিন কিছু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, প্যাথলজী বিভাগের ইনর্চাজ সুব্রত মাদকাসক্ত। তার রুমের মধ্যে রাত ১০ টার পর মদ ও নারী নিয়ে রঙ্গমঞ্চও হয়। এছাড়া সুব্রত মাদক সেবন করে রুগী ও রুগীর আত্নীয় স্বজনদের সঙ্গে খারাপ আচারণ করে এমন একাধিক অভিযোগ আছে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি কিভাবে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো জায়গায় ১০ বছর প্যাথলজী বিভাগে ইনর্চাজ হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে জানতে চাই সচেতন মহল।

হাসপাতাল সূত্র জানান, প্যাথলজী বিভাগের আর্থিক দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে ক্যাশ কাউন্টারের রশিদ টু-কপি (নিজস্ব তৈরি) ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। আমাদের জানা মতে হাসপাতালের রশিদ (সরকারি) ছাড়া কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়ার কথা না অথচ সেটা বাদ দিয়ে টু-কপি চলছে হরহামেশায়। ক্যাশ কাউন্টারের রশিদের অর্থ ছাড়া কোনো টাকা রাজস্ব খাতে জমা করা হয় না। প্যাথলজি বিভাগে সুব্রতর নিজস্ব ক্যাশ কাউন্টার তৈরি করেও প্রতিদিন দুই থেকে তিন লক্ষ টাকা নিজের পকেটে রাখছে। এতে করে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

সূত্র আরো জানান, সুব্রত ঠিকমতো ডিউটি করেন না। বেশির ভাগ সময় তিনি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বাইরে থাকে। সুব্রতর বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস পাইনা কিছু বলে মারধর খেতে হবে, তা নাহলে চাকরি হারাতে হবে। সুব্রতর অনুপস্থিতে তার এই অপকর্ম দুর্নীতি দেখভাল করেন সুব্রতর ভাইপো অনিমেষ। অনিমেষ মেডিকেলে কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ আচারণ করে এবং দাপট দেখায় বলে কোনো কিছু বললে চাকরি খেয়ে দেব। এছাড়া প্যাথলজী সুব্রতর বিরুদ্ধে বিগত দিনে চাকরি দেয়ার নামে নিরীহ মানুষের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে চাকুরী দিতে না পারায় থানা পুলিশ পর্যন্ত হয়েছে।

আরো পড়ুন: ইলেকট্রনিক দোকানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

ইতিমধ্যে পরিচালক ডা. শীতল চৌধুরী, অতিরিক্ত পরিচালক ডা. অজয় কুমার এবং ল্যাব ইনচার্জ সুব্রত কুমার দাস সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ঔষধ ক্রয়ের ৭ কোটি টাকা আত্মসাতসহ এসব অনিয়ম দুর্নীতির তদন্তের দাবিতে মানববন্ধনও হয়েছে।

পত্রিকার হকার আজানুর এই প্রতিবেদককে জানান, আমি প্রতিদিন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পত্রিকা দিতে গেলে হঠাৎ একদিন প্যাথলজি বিভাগের ইনর্চাজ সুব্রতর সাথে দেখা হয়। আমার নামে নিউজ আছে? নিউজ করে আমাকে কিছু করতে পেরেছে আমার উপর মহলে টাকা দিয়ে ম্যনেজ করি। স্যাররাও জানে। নিউজ করে কিছুই করতে পারবে না।

ক্যাশ কাউন্টার থাকতে প্যাথলজী বিভাগের নিজস্ব ক্যাশ কাউন্টার তৈরি সম্পর্কে অনিমেষ বলেন, যে পরীক্ষা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হয়না সেইগুলা আমরা বাইরে থেকে করে নিয়ে আসি, এটা কি আপনাদের বৈধতা আছে এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন এ বিষয় আপনি আমার চাচা সুব্রতর সঙ্গে কথা বলেন।

এই বিষয়ে প্যাথলজি বিভাগের ইনর্চাজ সুব্রত জানান, আমার জমি, গাড়ি, ড্রাইভার, বাড়ি সবি আছে। আপনার আর কিছু জানার আছে থাকলে বলেন। অর্থ লোপাট সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার স্যাররা সবই জানেন তাদের সঙ্গে কথা বলেন।

অতিরিক্ত পরিচালক ডা. অজয় কুমার (পরিচালক) স্যারের সঙ্গে কথা বলেন উনি সবকিছু জানেন বলে জানান তিনি।

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শীতল চৌধুরী ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেন না ভাব নিয়ে বলেন, আমি রশিদ ব্যবহার করতে বলেছি। আর রাতে মাদক সেবন রঙ্গমঞ্চ এসব আগে করতো এখন আর করেনা। ওষুধের ক্রয়ের ৭ কোটি টাকা আত্নসাৎ, সিন্ডিকেট এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসি দেন। হাসপাতাল করিডোরে জরুরি বিভাগের সামনে কফি হাউজ বসিয়ে বানিজ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, বসিয়েছি রোগীদের জন্য। আপনার আর কিছু জানতে হবেনা, বুঝতে হবেনা। আমার সঙ্গে দেখা করেন, আমার সঙ্গে দেখা করেন সব ঠিক হয়ে যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App