×

সারাদেশ

‘ঝিনুকে’র বুকে থামবে ট্রেন, সম্ভাবনার সুবাতাস পর্যটনে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৩, ০৮:২০ এএম

‘ঝিনুকে’র বুকে থামবে ট্রেন, সম্ভাবনার সুবাতাস পর্যটনে

ছবি: ভোরের কাগজ

একসঙ্গে লাগোয়া ঝিনুকের দুটি খোলস আকৃতির বিশাল নান্দনিক স্থাপনা। একটি খোলসের বুকে মুক্তা বসানোর কার্যক্রম চলছে। আরেকটির বুকের উপরে বসানো হয়েছে রেলের পাত। আইকনিক এই রেলস্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। বন জঙ্গল পাহাড় পেরিয়ে ঢাকা থেকে স্বপ্নের ট্রেন এসে থামবে এই নান্দনিক ঝিনুকের বুকে। সেইসঙ্গে কক্সবাজারবাসীর শত বছরেরও বেশি সময় ধরে ট্রেনে ওঠার স্বপ্ন পূরণ হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ৮৬ শতাংশ শেষ হয়েছে।

কক্সবাজারের স্টেশনটির কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাঁচ তলা বিশিষ্ট এই স্টেশনে থাকবে শপিং মল, ফুড কর্নার, লকার, কনভেনশন হলসহ ১৭টি বাণিজ্যিক কার্যক্রম। সমুদ্র দর্শনে এসে প্রথম দর্শনেই সামুদ্রিক একটা আবহ পাওয়া যাবে গোটা স্টেশনে। সেপ্টেম্বর মাসে এই রেলপথে ট্রেনের প্রথম ট্রায়াল রান হবে। আর বাণিজ্যিকভাবে আগামী বছরের জুনে ট্রেনের হুইসেল বাজবে কক্সবাজারে। এতে কম সময়ে, কম খরচে আরামদায়কভাবে যাতায়াত করতে পারবেন এই অঞ্চলের মানুষ। ফলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে বইছে সম্ভাবনার সুবাতাস। দেশের অর্থনীতির গতি বাড়বে বহুগুণ। হবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।

দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের অদূরে গুমদুম র্পযন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ২০১০ সালে হাতে নেয় সরকার। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। দুই পর্যায়ে এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে। আর এই অংশেরই ৮৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রামু থেকে মিয়ানমারের অদূরে গুমদুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৫২ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে। পরবর্তীতে এটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে। পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওর্য়াকের আওতায় আনতে, পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহনে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

জানতে চাইলে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, এ প্রকল্পের ৮৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, সামান্য কিছু কাজ বাকি আছে। আশা করছি, সেপ্টেম্বরের ১৫ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে চট্টগ্রাম তথা ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি ট্রায়াল রান করা হবে। বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চালু হতে কয়েক মাস সময় লাগবে। প্রাথমিকভাবে দুই জোড়া ট্রেন চলবে। পরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হবে। ঢাকা থেকে যেসব ট্রেন চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসে, সেসব ট্রেনের শেষ গন্তব্য হবে কক্সবাজার। এছাড়া সম্পূর্ণ নতুন একটি ট্রেন চালু হবে। কুয়েত থেকে নতুন কোচ আনা হয়েছে। তবে এখনো ট্রেনের নাম নির্ধারণ করা হয়নি। তিনি বলেন, ট্রেন চালু হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসতে সাড়ে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা লাগবে। এসি সিটের ভাড়া ১২০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। আর নন এসি হতে পারে ৭০০ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্প নির্মাণে হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর নির্বিঘ্নে চলাচল করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। বর্তমানে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন আছে। এ কারণে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে বন-পাহাড় নদী পাড়ি দিয়ে রেলপথটি যাচ্ছে কক্সবাজারে। নয়টি স্টেশন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। এর মধ্যে আছে দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার। এসব স্টেশনে থাকবে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম। দোহাজারী থেকে চকরিয়া এবং চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথে ৩৯টি ব্রিজ ও আন্ডারপাস সহ ২৫১টি কালভার্ট নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮১ কিলোমিটার অংশে রেলওয়ে ট্র্যাক বসানো হয়েছে।

শনিবার আইকনিক এই রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, নান্দনিক ডিজাইন আর নির্মাণশৈলীতে গড়ে উঠছে স্টেশনটি। চারদিকে গ্লাস বসানো হয়েছে। ছাউনিটা পুরো কাঠামোকে ঢেকে রেখেছে। ওপরের ছাদ খোলা থাকায় থাকবে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। দিনের বেলা বাড়তি আলো ব্যবহার করতে হবে না এই রেলস্টেশনে। ফলে সবসময় ভবনটি সহনীয় তাপমাত্রায় থাকবে। স্টেশনটির ছাদ ঝিনুক আকৃতির। সামনে ফোয়ারা বসানোর কাজ চলছে, সেখানো মুক্তা বসানো হবে। ৬টি লিফট ও ২টি চলন্ত সিঁড়ি স্থাপনের কাজ করছেন শ্রমিকরা।

সুবিশাল এই চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলা থেকে নামতে হবে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। আর আসার যাত্রীরা বের হবেন নিচ থেকে। স্টেশনের ভেতরেই থাকবে কেনাকাটার ব্যবস্থা। থাকবে হলরুম। আবার চাইলেই নির্দিষ্ট লকারে ব্যাগ রেখে পর্যটকরা ঘুরে আসতে পারবেন পুরো শহর। এমন ৫০০টি লকার থাকবে। থাকবে হোটেল ও গোসলখানা।

তবে চালু হওয়ার আগেই নান্দনিক এই স্টেশনটি দেখতে আসছেন পর্যটকরা। তারা বলছেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালু হলে গতি বাড়বে দেশের অর্থনীতির চাকার। সেই সঙ্গে তুলনামূলক চাপ কমবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ওপর। কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের আমূল পরিবর্তন ঘটবে। কারণ তখন সহজেই কক্সবাজারে পর্যটকের আগমন বাড়বে। চাঙা থাকবে পর্যটন ব্যবসা। নতুন করে বাড়বে স্থানীয় কর্মসংস্থান।

কথা হয় কক্সবাজারের ঈদগায়ের উত্তর কাহাতিয়া পাড়ার বাসিন্দা সুমন পাটোয়ারির সঙ্গে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালু হলে কী উপকার হবে জানতে চাইলে হাসিমুখে তিনি বলেন, রেললাইন হবে, এটা এতদিন ধরে শুনে আসছিলাম। এখন সত্যি সত্যিই তা চোখে দেখছি। ট্রেন চালু হলে খুব খুশি হব। ট্রেনে করে রামুতে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাব।

এই অংশে ইতোমধ্যে রেললাইন বসানো হয়েছে। রেললাইনের পাশে এলাকার শিশু-কিশোরেরা খেলায় মেতেছিল। একই এলাকায় কথা হয় বৃদ্ধ সোলায়মানের সঙ্গে। একসময়ের প্রবাসী সোলায়মান এখন কৃষিকাজে যুক্ত। তিনি বলেন, জীবনে তিনি বেশ কয়েকবার বিমানে করে বিদেশে গেছেন। কিন্তু কখনো ট্রেনে চড়েননি। এই রেল লাইন চালু হলে ট্রেনে ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণ হবে। ট্রেনে ঢাকা ও চট্টগ্রাম যেতে পারবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App