×

সারাদেশ

৪৭ বছরের অপেক্ষার অবসান ১০ বীরাঙ্গনার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০২:০৭ পিএম

৪৭ বছরের অপেক্ষার অবসান ১০ বীরাঙ্গনার
মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেলেন নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনা। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় এক গেজেটের মাধ্যমে তাদের নাম প্রকাশ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সমান সকল সুযোগ-সুবিধা পেতে যাচ্ছে স্বামী, সন্তান ও সম্ভ্রম হারানো এই বীরাঙ্গনারা। কিন্তু এই মর্যাদা পেতে তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ৪৭ বছর। ১০ জনের মধ্যে ইতিমধ্যেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ৪ বীরাঙ্গনা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়ে বেঁচে আছেন বাকি ৬ জন। বীরাঙ্গনা বানী রানী পাল, ক্ষান্ত রানী পাল, রেনু বালা ও সুষমা সূত্রধর রোগে আক্রান্ত হয়ে অভাব-অনটনের সংসারে উন্নত চিকিৎসার অভাবে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আর বয়সের ভারে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নানা কষ্টে বেঁচে আছেন মায়া রানী সূত্রধর, রাশমনি সূত্রধর, সন্ধ্যা রানী পাল, কালীদাসী পাল, সন্ধ্যা রানী ও গীতা রানী পাল। একাত্তরের সেই দুর্বিসহ যন্ত্রনা ও সামাজিক বঞ্চনার পাশাপাশি অনেকটা দুঃখ-দুর্দশার অভাব-অনটন আর অসুস্থ্যতার মধ্যেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম। রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর তীরে ছায়ায় ঘেরা শান্ত আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাক-হানদার বাহিনীর স্থানীয় দোসর রাজাকার ও আলবদরদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত নির্যাতন চালায় এই পালপাড়া গ্রামের সনাতন ধর্মের মানুষদের ওপর। এই সময় গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাক হানাদার ও তাদের দোসররা। সংখ্যালঘু পরিবারের কিশোর, যুবক, মাঝ বয়সী, ও বিভিন্ন বয়সী নারীদেরকে ধরে ওই গ্রামের সুরেস্বর পালের বাড়ির বারান্দায় একত্রিত করে “জয়বাংলা বলতে হ্যায় নৌকামে ভোট দিতে হ্যায়” বলে পাক সেনারা ব্রাশ ফায়ার করে গবীন্দ চরণ পাল, সুরেশ্বর পাল, বিক্ষয় সূত্রধর, নিবারন পালসহ ৫২ জন মুক্তিকামী জনতাকে নির্বিচারে হত্যা করে। এ সময় পাক হানদার বাহিনী গণহত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের মতো ধ্বংস লীলা থেকে বিশেষ করে নারীরা স্বামী সন্তানদেরকে প্রাণে বাঁচানোর শেষ আকুতিটুকু করলেও পাক হায়নাদের মন তা গলাতে পারেনি। উল্টো পাক-জান্তারা সুযোগ বুঝে নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে নওগাঁ জেলা শহরের উদ্দেশে চলে যায়। নির্যাতিত নারী ও স্বজনদের হৃদয় বিদারক আর্তনাদ ও কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। বীরাঙ্গনা কালী দাসী পাল (৭৫) বলেন, ওই দিন সকালে যখন আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবী আসে তখন আমরা স্বামীসহ বাড়ির দরজা লাগিয়ে আত্নগোপনের চেষ্টা করি। কিন্তু স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগীতায় গেটের দরজা ভেঙ্গে আমার স্বামীকে টেনে হিঁচড়ে পাঞ্জাবীরা রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় ফেলে রাখে। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়ে আমার কথা না শুনে চোখের সামনে আমার স্বামীসহ ৫২ জনকে হত্যা করে উল্টো আমার ওপরও তারা নানা কায়দায় নির্যাতন চালায়। তিনি আরও বলেন অভাবের সংসারে এক ছেলে দিন মজুরের কাজ করে। আমি ও পেটের তাগিদে কখনও ধান কুড়িয়ে, বয়লারের চাতালে কাজ করে, কিংবা অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে দু’মুঠো ডাল ভাত খেয়ে কোনো মতো বেঁচে আছি। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকতে আর মনে হয় স্বীকৃতি পাবো না। তবে অবশেষে এই স্বীকৃতি পেয়ে আমি অনেক খুশি। এই সরকারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। বীরাঙ্গনা সন্ধ্যা রাণী পাল (৭০) বলেন, ওই দিন সকাল নয়টার দিকে পাঞ্জাবীরা আমার স্বামী বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় সুরেশ্বর পালের বাড়িতে ধরে নিয়ে লাইন করে রাখে এই দিকে পাঞ্জাবীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লুটপাট ভাংচুড় ও অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরণের নির্যাতন চালায়। আমি ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়ির এক বড় মাটির ডাবরের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করি। বাচ্চার কান্না পাঞ্জাবীরা শুনতে পেয়ে আমাকে সেখান থেকে বের হওয়ার কথা বলে। তখন আমি পালিয়ে মাঠের মধ্যে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক-বাহিনীরা এই গ্রামের মেয়েদের সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছে। আমাদেরকে অবশেষে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক ধন্যবাদ। স্বামী হারানোর পর থেকে ৪৭টি বছর অভাব-অনটনের মধ্যে জীবন কাটালাম। তাই স্বীকৃতির পাশাপাশি সকল সুযোগ-সুবিধা যদি দ্রুত আমাদেরকে দেওয়া হতো তাহলে যে কদিন বাঁচি তা ভোগ করে যেতে পারতাম। রাণীনগর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইসমাইল হোসেন বলেন, অনেক চেষ্টার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার অবশেষে আতাইকুলা গ্রামের ১০ বীরঙ্গনাকে স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে নাম গেজেটভুক্ত করেছেন। এই স্বীকৃতি প্রাপ্তির সকল প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করা হয়েছে। বরাদ্দ এলেই আগামী বিজয় দিবসে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হবে বলে আমি আশা করছি। নওগাঁ-৬ (রাণীনগর-আত্রাই) আসনের সংসদ সদস্য মো: ইসরাফিল আলম বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। অবশেষে আমাদের সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আতাইকুলা পাল পাড়া গ্রামের এই বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেয়েছে। এটি আমাদের অনেক বড় একটি সফলতা। আমার খুবই ভালো লাগছে। অবশেষে যে কজন বীরাঙ্গনারা এখনোও বেঁচে আছেন তারা অনন্ত তাদের নায্য প্রাপ্যটুকু একটু হলেও ভোগ করে ও স্বীকৃতির মুকুট মাথায় নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকতে পারবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App