সরকার পতনের ২ দিন আগে সেনাবাহিনীর বৈঠকে কী আলাপ হয়েছিল?
কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪, ০৪:৫৮ পিএম
সময়টা ৩ আগস্ট। স্লোগান আর বিক্ষোভে উত্তাল সারাদেশ। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্র-জনতা আন্দোলনকে মোকাবেলা করতে দিশেহারা। ঘড়ির কাটায় দুপুর ১ টা ৩০ মিনিটে শুরু হয় সেনাপ্রধানের সাথে তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। এক পর্যায়ে, সেনাপ্রধান দুটি গান গাইলেন।
গুরুত্বপূর্ণ সেই বৈঠকে একটি গান ছিল, প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার ওপরে পড়েছে। আরেকটি গান ছিল "আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে"। কিন্তু জাতির এমন ক্রান্তিকালে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কেন গাইলেন এমন গান।
তিনি কি কোন বার্তা বা মেসেজ দিতে চেয়েছিলেন এই গানের মাধ্যমে। এই নিয়ে নানা প্রশ্ন আসতে পারে। অনেকে বলছেন তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি কোনো ঝামেলা ডাকেননি বরং ঝামেলা নিজেই তাঁর এবং সেনাবাহিনীর সামনে এসেছে। তবে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ যা হোক না কেন? যা দিয়ে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বুঝতে পেরেছিলেন তিনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন।
রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে তৈরি করা একটি বিশেষ সংস্থা, যেটি পূর্ববর্তী সরকারের আমলে একটি দমনমূলক যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। সেই সংস্থাটি থেকে শুধু আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ছাড়া গত ৩ আগস্টের বৈঠক নিয়ে কিছু লিখতে বা প্রতিবেদন তৈরি করতে নিষেধ করা হয়েছিল।
গত ৩ আগস্ট সেনাপ্রধানের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তরুণ সেনা কর্মকর্তারা নিজেদের জনগণের ওপর গুলি নয়— এই মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আরও স্পষ্ট করে বলেছিলেন, এখন থেকে আর কোনো গুলি নয়।
এই মনোভাব এবং সিদ্ধান্তের ফলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার কর্মকর্তাদের বৈঠক নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেও প্রতিরক্ষা বিষয়ক অনেক বছরের পুরনো চর্চার কারণে আইএসপিআর থেকে তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিবেদন করেনি।
পরে সংবাদ করলেও বৈঠকের ফলাফল খুব একটা প্রকাশ করতে পারেনি। তবে, দেশের অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেই আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সেনাবাহিনীর অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছিল। সেখানে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদা জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনের পাশে দাঁড়াবে।
ওই গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সন্তোষজনক না হওয়ায় সংস্থাটি গণমাধ্যমকে, বিশেষত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে বিজ্ঞপ্তির "জনগণের পাশে দাঁড়ানো" অংশটি ব্যবহার করতে নিষেধ করে।
সকল গণমাধ্যম না হলেও বেশ কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়া এই নির্দেশ পালন করে "জনগণের পাশে দাঁড়ানো" শব্দগুলো তাদের ব্রেকিং নিউজ টিকার থেকে মুছে দেয়। আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেনাপ্রধানের বক্তৃতার কয়েকটি বাক্য উল্লেখ করা হয়েছিল, কিন্তু কিছু গণমাধ্যম সেই সময় আরও অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ করে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রায় আধা ঘণ্টার একটি উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, সরকার যদি সেনাবাহিনীকে সংকট মোকাবেলায় নিয়োজিত করে তাহলে তারা সেই আদেশ মানতে বাধ্য। তবে তিনি যোগ করেন, তার সেনারা কাউকে হত্যা করেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কতগুলো গুলি এবং ফাঁকা গুলি চালানো হয়েছে তার পরিসংখ্যানও তিনি বৈঠকে তুলে ধরেন।
বক্তব্য শেষে সেনাপ্রধান বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা শোনানোর জন্য আমন্ত্রণ জানান। ব্রিগেডিয়ান জেনারেল এবং এর চেয়ে ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা হাত তুললেও সেনাপ্রধান তাদের নিরুৎসাহিত করেন এবং তরুণ কর্মকর্তাদের কথা শোনার প্রতি জোর দেন।
রাজশাহীর একজন নারী সেনা কর্মকর্তা বাংলায় একটি আবেগপূর্ণ বক্তৃতা পাঠ করে বলেন, দেশের সব মাকে মৃত্যু স্পর্শ করেছে এবং সব মা কাঁদছেন। তিনি মীর মুগ্ধর প্রতিবেশী ছিলেন, যে মুগ্ধ ঢাকার উত্তরায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানি বিতরণ করার সময় নিহত হন।