রহস্য ঘেরাটোপ
তাহমিনা কোরাইশী
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বামুন হয়ে না কি চাঁদে হাত বাড়িয়েছিলাম! কী আমার চাঁদরে! তনিমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টায় কথাটি বলে ওঠে জিসান।
তনিমা মনোযোগ দিয়ে একটা গল্পের বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল, পড়া প্রায় শেষের দিকে। এমন একটা কথা কানে যেতেই ৪০ বছর আগের পৃষ্ঠায় ঠাঁয় এসে দাঁড়িয়ে যায় তনিমা। জিসানের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করে। এমন এক একটা সময় সামনে এসে যায়, যা নিয়ে তর্ক করাটাই বৃথা। আলোচনা সমঝোতা কোনো কিছুই আজকাল কাজে আসে না। দ্রুতই পরিস্থিতির মারাত্মক রূপ বদলায়। যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রাখাই শ্রেয়। কথার উত্তর না দিলেও মনটা ভার হয়ে যায়। কেন যেন কান্না পায় তনিমার। টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে দুই চোখের জল। বোবা মূর্তির চোখে জল!
তনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিসান ফিক করে হেসে ওঠে। আর বলে- কাঁদো আরো বেশি করে কাঁদো। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কিছু বললেই খালি কান্না। কান্না ছাড়া কী পারো আর?
তবু কোনো কথা বলে না তনিমা। দুই চোখের জল মুছে নেয় শাড়ির আঁচলে। এ বিদ্যাটা রপ্ত করতে হয়েছে এই পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার জন্য। তবু মনে একটা ভয় জমাট বাঁধতে থাকে।
বিছানায় গিয়ে শুতে চেষ্টা করে জিসান। হঠাৎই সচেতন হয়ে ওঠে তার চোখের তারা। মুখে মুচকি হাসির রেখা আবার ফুটে ওঠে। ‘কাহার সনে কি কথা কহিতে যে চাও!’ মনে মনে ভাবে স্ত্রী তনিমা। বিছানার পাশে গিয়ে বসে। বরাবরই তার দৃষ্টি স্বামীর দিকে যেন পান থেকে চুন না খসে। দায়িত্ববোধে একেবারে টনটনা। কখন কী প্রয়োজন হয় জিসানের সবই তার নখদর্পণে। এমনিভাবে বেশ কয়েকটা বছর সেবা দিয়ে চলেছে তনিমা।
হঠাৎ করেই যেমন বিশ্বে ছোবল দিয়ে গেল করোনা। তেমনি ভাবেই ‘মাইস্থেনিয়া গ্রাভিস’ তার জীবনকে তছনছ করে চলেছে। নতুন নামটি জানা হলো অসুখের। আর এই পাঁচ বছরে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারল না তনিমা। চিকিৎসার কোনো ত্রæটিও রাখেনি। তার ভালোবাসার মানুষটির জন্য। সেই ছোটবেলার সঙ্গী তাকে হারানোর ভয়ে-প্রাণ মন কুঁকড়ে থাকে। আতঙ্কে দিশেহারা। দু’দণ্ড শান্তি পায় না। যে অসুখটি তার হয়েছে সে তো রেয়ার। লক্ষ-কোটিতে কয়েকজনই পাওয়া যায়। প্রথম যখন ধরা পড়ে ভয়ে একেবারে গায়ের রক্ত হীম শীতল বরফ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার সাহেব তনিমাদের অবস্থা দেখে বললেন, আরে ভাই এত চিন্তা করছেন কেন? রোগ যেমন আছে তার ওষুধও তেমন আছে। আরো মজার ব্যাপার আমাদের পছন্দের বিশিষ্ট নায়কেরও হয়েছিল। দেখেন দিব্বি বলিউডের হিট ছবিগুলো করে যাচ্ছেন। ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে ওদের মুখের রঙ বদলে গেল। অনেক রসিকতা হলো। আরো বললেন, তার সঙ্গে কিন্তু জিসান সাহেবের চেহারার মিল আছে।
তনিমা বলল, ঠিক বলেছেন ভাই। আমার প্রিয় নায়ক। আমার স্বামী যখন ট্যুরে যায় আমি তো দিনরাত ডুবে থাকি সেই নায়কের প্রেমে। কী আর ছবি দেখে।
নিউরোলজিস্ট সে ডাক্তার সাহেব তনিমার বান্ধবীর বড় ভাই। তাই বেশ সময় নিয়ে তনিমাদের বুঝিয়ে বললেন। অনেক টেস্ট করতে হবে। কিছু টেস্ট কালচার করতে হবে, যা আমাদের দেশে হয় না, ইন্ডিয়াতে পাঠাতে হবে ব্লাড। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় এমনই এক সমস্যার নাম মাইস্থেনিয়া গ্রাভিজ। স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধে কাজ হয়। সার্বক্ষণিক ডাক্তারের পরামর্শে থাকতে হবে। তনিমা বিভ্রান্তের মতো রাতদিন ২৪ ঘণ্টা জিসানের সঙ্গে সঙ্গেই। যদিও ডাক্তার সাহেব সান্ত¡না দিয়েছেন। সেই নায়রের গলার কাছে ছোট্ট একটা অপারেশন করে গেøন্ড ফেলে দিয়েছে। তার শরীরে ছড়াতে পারেনি অসুখ। কিন্তু সবার বেলা এক রকম হয় না। প্রথমত চোখের পাতা পড়ে যেত। মুখমণ্ডলের নার্ভগুলোকে নিস্তেজ করতে শুরু করেছে। ওষুধ খেয়ে একটি স্থানে স্থির রাখা যায়। কিন্তু এই সব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রচুর। কোনোটাতে লিভার নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে। কোনোটাতে হার্টের সমস্যা। স্নায়ু দুর্বল হয়ে যায়। আবার কিছু ওষুধ স্নায়ুকে সতেজ রাখার কাজ করে। বিপরীতমুখী কাজগুলো করতে হয় বিভিন্ন ওষুধকে। যার ফলে জটিলতা বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস, হাইপ্রেসার কিছুই ছিল না যে মানুষটির। আস্তে আস্তে সবাই দলবদ্ধ হয়ে ঢুকে যায় শরীরে। পাঁচটি বছর মাইস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আজ ক্লান্ত তনিম-জিসান। অসুস্থতা যদি অনেক সময় ধরে শরীরের দখলদারিত্ব নিয়ে নেয়। তখন কিন্তু মানুষ মানসিকভাবে তার ভারসাম্যতা হারিয়ে ফেলে। ভালো হওয়ার আশা হতাশায় রূপান্তরিত হয়ে। কারো ভালো কথা কারো উপদেশ তখন তেতো লাগে। সিগারেট খেতে বারণ করেছেন ডাক্তার। তার উত্তরে তনিমাকে বুঝিয়েছে জিসান- আমাকে গ্যারান্টি দাও আমি অসুখ থেকে ভালো হয়ে যাব, আমি অনেক দিন বাঁচব, তবেই আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেব। কোথায় কোন কিতাবে লেখা আছে সিগারেট খেলে অসুখ হয়? ক্যান্সারও হয়! তোমাদের সাজানো বুলি।
তনিমার আর কিছু বলার থাকে না। তবু চেষ্টা করে বলার। -সিগারেট থেকে যে অসুখ হয়, না তা নয়। কিন্তু সিগারেট অসুখকে আরো উসকে দিতে সাহায্য করে। ডাক্তার তাই বলেছেন।
- শোন তনিমা যদি আরো দুবছর বেশি বাঁচি সিগারেট না খেয়ে। তবে আর ছমাস কম বাঁচলাম। তাতে কি লাভ বলো! আমার এই আনন্দটুকু কেড়ে নিও না, প্লিজ। যে ক’দিন বাঁচি রাজার হালেই বাঁচতে চাই। কেচ্ছা সাধন আমাকে দিয়ে হবে না, বুঝেছো?
তনিমা বুঝেছে সবই। এ অসুখ থেকে রেহাই নেই। তনিমা পাগল হয়ে যায়। কখনো দেশে কখনো বিদেশের হাসপাতালগুলোতে দৌড়ঝাঁপ দিতে দিতে আশাপিদীমের আলো ক্ষীণ হয়ে আসে। নিজের জন্য, সংসারের জন্য, ছেলেমেয়েদের জন্য চিন্তা করার অবকাশটুকু থাকে না। একটি মানুষকে ঘিরে স্বপ্নরা অশ্বত্থ বৃক্ষ হয়। আশা নামের মেয়েটি পরমায়ু নিয়ে এসেছে, ওর ক্ষয় নেই। তাই আশার হাতে হাত রেখে গন্তব্যের দিকে ধাবমান এ জীবন।
তবু জীবনের প্রতি ভালোবাসায় কখনই অনীহা ছিল না। প্রচুর প্রাণশক্তিতে বহতা নদী। প্রচণ্ড প্রেমিক পুরুষ। তাই তো তনিমা আর জিসানের কিশোর প্রেম কাহিনি স্বর্গীয় মধুচন্দ্রিমা আজো মুখে মুখে।
হঠাৎ এক দিন কী এক বীভৎস রূপে ধরা দেয় মাইস্থেনিয়া গ্র্যাভিস। শ্বাস নিতে পারছে না। গলা দিয়ে এক ফোঁটা জল নামছে না। মানুষটা তৃষ্ণায় আতর্নাদ করছে। ঘরশত্রæ বিভীষণ। শরীরের স্নায়ু তার শরীরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে। কী এক করুণ যাত্রা। দ্রুতই ডাক্তারের পরামর্শে। শ্বাসের এই খেলা চলবে কতটা সময় কে জানে! তবু শেষ চেষ্টা করতে কারো আপত্তি নেই। ইমিউনিটি সিস্টেম বাড়ানোর জন্য বিদেশি ওষুধ আনা হলো।
আশায় আশায় প্রার্থনার ঝুলি ভরে ওঠে। আকাশ-বাতাস মেঘ-রোদ বৃষ্টি মাটি একাকার করে প্রার্থনায়। ফিরে আসুক এই সংসারে আবার আনন্দ বেদনার নক্সিকাঁথার জীবন। এতটা সময়ের নিপুণ বুননে বাবুই বাসাটি আর হবে কী প্রাণ উচ্ছ¡াসে পূর্ণ!
এরই মধ্যে ডাক্তার সাহেব তনিমার বড় ছেলের কানের কাছে আস্তে করে কিছু একটা কথা বলে গেলেন। ছেলের কাছে তনিমা জানতে চাইল কী বললেন ডাক্তার তোমাকে। অতনু মাকে সান্ত¡না দিয়ে বলল- না, তেমন কিছু না।
বোবা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল তনিমা।
ঘটনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে পরে তনিমা। উ™£ান্ত যাত্রায় কোন এক নিরুদ্দেশে। একলা পথে চলছে তনিমা। ওই দূরের কোনো একটি বড়িতে। তার চারিদিকে ফুলের বাগান। নানান ফুল লতা গুল্মে ছেয়ে আছে বাড়িটা। কি যে একটা ঘোরের মধ্যে তনিমা। ঘরটির দরজায় তনিমা। ওমা! এ কি জিসান এখানে? হাসিমুখে তার অভ্যর্থনায়...। মাথা চক্কর খাচ্ছে পড়ে যাওয়ার উপক্রম তনিমার। এগিয়ে এসে জিসান তনিমাকে জড়িয়ে ধরে। সারা গায়ে মাথায় ফুল পাতায় ছেয়ে যায়। ফুলের ঘ্রাণে তনিমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
আচমকা ছেলে অতনুর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়। তনিমা চোখ মেলে তাকায়- বলে এখানে কেন আমি? হাসপাতালের বেডে? কী হয়েছে আমার? ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। তনিমার চোখে জল নেই মুখে ভাষা নেই কেবল বোবা দৃষ্টি। শুকনো পতার মর্মর ধ্বনি প্রতিধ্বনি চৌহদ্দী জুড়ে।