ভূমি ও ভূমিকা
রুদ্র শাহীন
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গাড়িটা এসে একটি হোটেলের সামনে থেমেছে। দ্রুত পায়ে নামছে যাত্রীগণ। জুতার শব্দ হচ্ছে। টুক-টাক-টুক।
সবার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে নাদিরা। নিশাত আগেভাগে নেমেছিল। সে একটি দোকানের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দোকানটি হোটেলের বাঁ পাশে। অডিও-ভিডিও ক্যাসেটের দোকান।
যাত্রীগণ সবাই হোটেলের ভেতরে প্রবেশ করছে। মন্টু এসে দাঁড়ায় নিশাতের পাশে। গ্রীবায় হাত রেখে ডাকে। -নিশাত, এভাবে বেহুঁশ হয়ে দেখছিস কী?
ভ্রæ-কুঁচকে নিশাত কহিল- দাদা, কি এক অদ্ভুত নাম!
-কোথায়?
হোটেলের বিশাল এক সাইনবোর্ড। তার লগে আংশিক ছোট্ট অক্ষরে রং তুলিতে আঁকা অন্য একটা বোর্ড। পাশের দোকানের। দোকানের মালামাল দেখার আগে সাইনবোর্ড দেখে পড়া শুরু করলেন দোকানে নাম।
নাদিরা বারবার মন্টুর মুখের পানে তাকালেন। মন্টু খিল খিল করে হেসে উঠলেন।
নিশাত বলল- এটা আবার কেমন নাম?
মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে দিলু। তার ঠাণ্ডা লেগেছে। গাড়িটা যাত্রা শুরু থেকে জানালা খোলা ছিল। যথেষ্ট লেগেছে বাতাস। এখন তার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। তারপরও মন্টুকে এভাবে হাসতে দেখে ভারাক্রান্ত মনে জিজ্ঞেস করল- কী হলো রে?
নিশাত বলল- এ দ্যাখ, অদ্ভুত দোকানের নাম।
দিলু দৃষ্টি রাখল সাইনবোর্ডে।
মন্টু একটু উত্তেজিত হইয়া উঠে। বলে- এটা আবার কেমন নাম? ‘টিকে না টিকে’
দোকানি ভেতরে আছে। তবে খুব ব্যস্ত। বয়স খুব বেশি নয়। সাতাশ আটাশ বছরের এক যুবক। সারা দোকানের ভেতরে এলোমেলো হয়ে আছে অনেক অডিও ভিডিও ক্যাসেট।
মন্টু এগিয়ে গেল। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল- ভাই, আপনার নাম কী?
দোকানি আগের মতো আছে। তবে উত্তর ঠিকভাবে দিয়ে গেল। -দেলোয়ার।
-তো এটা কি নাম দিলেন ভাই? অদ্ভুত এক নাম- টিকে না টিকে!
বাক্যটা শুনে নিজের মতো করে মুচকি হাসলেন দেলোয়ার। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং গ্রীবাটা একটু বাঁকা করে বললেন- সবাই বাঁধা সৃষ্টি করেছে। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন হতে বন্ধুরা পর্যন্ত। সবাই একই কথা প্রকাশ করেছে। ব্যবসাটা ভালো নয়, বেশি দিন টিকবে না দোকানটা। তারপরও আমার একটা শখ ছিল ক্যাসেটের ব্যবসার প্রতি।
-এমন নাম দিলেন কেন?
-সবাই বলছে- টিকবে না, টিকবে না। তাই আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম- নাম হবে ‘টিকে না টিকে।’
-তো এখন কতদিন হইল?
দীর্ঘ হাই তুলিয়া, নাক-চোখ টানটান করিয়া দেলোয়ার কহিল- ‘টিকে না টিকে’ ভাবতে ভাবতে এক যুগের মাত্র আর দু’মাস বাকি আছে।
-মানে বার বছর?
-হ।
কথাটা শুনে উচ্চস্বরে হাসলেন সবাই। পাশাপাশি হাসলেন দেলোয়ার। তিনি এভাবে হাসার কথা নয়। কারণ- প্রতিদিন এমন রসিক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। ফলে তার স্বাভাবিক থাকার কথা। তবুও তিনি প্রতিদিনের মতো দু-একবার হাসেন।
নিশীতা বলল- আপনি কেন হাসেন ভাই?
-আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। কারণ- প্রতিনিয়ত যাত্রীরা এমন ধরনের বাক্য ব্যবহার করে এবং সবার সঙ্গে আমিও দুয়েকবার হাসি।
মন্টু বলল- ভালো অভ্যাস।
সূর্য মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এমন অবস্থা নিজের ছায়া নিজে গ্রাস করেছে। তাজিন চেঁচিয়ে উঠে কহিল- গাড়ি ছাড়তে আর কত সময় লাগবে?
ড্রাইভার গাঁজায় সুখটান দিচ্ছিল।
ভূমিকা এতক্ষণ চুপচাপ হাঁটাহাঁটি করছিল। খুব গভীর ধ্যানে ছিল। মনে ছিল না তারা শুটিং করতে যাচ্ছিল। তাজিনের চেঁচামেচিতে তার ধ্যান ভেঙেছে। মনে মনে বলল- যাক ভালো হইছে।
নিজের মতো করে গাড়িতে উঠে বসেছে মন্টু। ঘষা-মাজা করছে ক্যামেরা। চোখে প্রচণ্ড ঘুমের নেশা। তাই চাপ পড়েছে বাটনে। চোখে প্রচণ্ড ঘুমের নেশা। তাই চাপ পড়েছে বাটনে। চালু হয়ে গেছে ক্যামেরাটা। পরক্ষণে ক্যামেরার ভেতরে বন্দি হচ্ছে হিজিবিজ ছবি।
গাড়ির সহকারী নোমান বারবার চেঁচাচ্ছে। উচ্চস্বরে ডাকছে- সময় হয়ে গেছে। এক্ষুনি গাড়ি ছেড়ে যাবে। যাত্রীগণ উঠে পড়–ন।
সাংবাদিক আকাশ আহমদের বুকে ঝুলছে ছোট্ট একটি ক্যামেরা। তিনি দৈনিক পত্রিকার চিত্র সাংবাদিক। যখন-তখন ছবি তোলা তার কাজ এবং মুহূর্তে পত্রিকা অফিসে পৌঁছে দেয়াও তাকে মানায়।
নিশাত বারবার তাকালো। বলল- আকাশ ভাই, আপনি কোন দৈনিকে ছবি পাঠান?
মন্টু ভ্রæ-কুচকে তাকালো।
-বলুন ভাই?
আকাশ অনেকটা অনিচ্ছা প্রকাশ করে গেল। নিচুস্বরে বলল- ছোট্টখাটো একটি পত্রিকায় কাজ করি। আর কিছু বলবে?
-না।
-তাহলে কি জানতে চাইলে?
ভূমিকা মøান চোখে তাকালো। বললো- আমি অভিনয় করি, ক্যামেরায় ভিডিও চিত্র হয়। কিন্তু ভালো লাগে প্রিন্ট মিডিয়াতে উপস্থিত হতে।
আকাশ ঠোঁটের আড়াল করে বলে গেল- বলেন কি? মানুষ উপড়ে যেতে চায়, উপড়ের দিকে তাকায় আর আপনি নিচের দিকে তাকাচ্ছেন। ব্যাপার কী?
মন্টু বলল- কারণ তো একটা আছেই।
কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি ভূমিকা।
আকাশ মøান চোখে তাকালো ভূমিকার দিকে। ততক্ষণে গাড়ি চলতে থাকল। একটু একটু বাতাস বইতে শুরু করেছে। প্রবেশ করছে খোলা জানালার মাঝখান দিয়ে বাতাস। সেই বাতাসে এলোমেলো করে যাচ্ছিল ভূমিকার চুল।
দুই.
অভিনয় খুব বিরক্তকর!
ভূমিকার কথার উত্তরে নিশাত জিজ্ঞেস করল-
-কেন রে?
-একটা বাজে পেশা।
-যেমন?
কী যেন একটা বাক্য ব্যবহার করতে চেয়েছিল। উপস্থাপনা শুটিং স্পটের মতো। কিন্তু না। মুহূর্তটা স্বাভাবিক স্থানের নয়। তাই থেমে যায়। নিজে নিজেই অস্থির ভাব দেখিয়ে ভূমিকা বলল- না থাক। এটা এই মুহূর্তে বলব না। অন্য কোনো সময় বলব।
মন্টু হাসলো।
ভূমিকা বলল- যা কিছু করি সব নকল। পেশাটাও নকল। বোনের চরিত্রে কাজ করি- তাও নকল। প্রেমের চরিত্রে অভিনয় করি তাও নকল। এভাবে সবকিছু।
কথাগুলো শুনে খিল খিল করে হেসে উঠল নাদিরা। তবে খুব চেঁচানো স্বর। পরক্ষণে সেই স্বর মøান হয়ে গেল গাড়ির হরণের সঙ্গে।
মন্টু ঠোঁট কামড়ে ধরে কহিল- আর কত দিন চলবে এই নকল জীবনের?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভূমিকা। একবার হাই তুলিয়া হাত ঝাঁকানি দিয়ে কহিল- যতদিন ভাগ্যে লেখা আছে।
নিশাত সবসময় আসল কথায় বলে যায়। এর জন্য কে মনে কষ্ট নেবে কিংবা কারো আঘাত আসবে কিছুই ভাবে না। এটা তার দোষ। বারবার বাধা খায়। তবুও বলে। অভ্যাস মতো নিশাত বলে গেল- এটা কি আর ভেঙে বলতে হয়? ভেঙে বললে-তো পাগলও জানবে। যতদিন চামড়ার ওপর তেল চক চক করবে ততদিন আমাদের চাহিদা থাকবে। যখন পুরাবে বা ফোসকা বেগুনের মতো হবে মুখের চামড়া, তখন কোমরে মারবে জোরে লাথি।
ভূমিকা আরও মøান করল মুখ।
সহকারী চরিত্রের প্রধান আকর্ষণ মধু। সে ছিল সবার পেছনের বেঞ্চিতে। যদিও মুঠোফোনের বাটন চাপাচাপিতে ব্যস্ত তারপর নাক-কান খোলা। নিশাতের কথা তার কান ছুঁয়েছে। সেই কোথা থেকে হুট করে বলে উঠল- কথাটা চিরন্তন সত্য।
মন্টু- আর কিছুই বলল না। বসে বসে ঘুমাচ্ছে। কোলের ওপর নিথর হয়ে পড়ে আছে তার পেশার যন্ত্র। মাঝে মাঝে গাড়ির সঙ্গে দোলা খায়। কিন্তু সেই অনাদিকালের অভ্যাস নাক ডাকা ঠিক মতো রয়েছে। বরং প্রচণ্ড জোরে।
পাশের সিটে বসেছিল মনিরা। সেই খুব অনীহা ভাব প্রকাশ করলেও কিছু বলে উঠতে পারছিল না। কারণ মন্টু একজন সিনিয়র পারসন। মাঝে মাঝে তার মুখ দিয়ে শুধু বের হয়- ইস, কী অসহ্য!
চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনি। মন্টু নিজের মতো আরাম-আয়েসে নিদ্রা যাচ্ছিল। আর একনাগাড়ে টানছিল নাক।
-আর সহ্য হচ্ছে না!
মনিরা ফ্যান ফ্যান শব্দে জেগে উঠল মন্টু। ঘুম ঘুম চোখে জিজ্ঞেস করল- কী হয়েছে-রে?
মনিরা কিছু বলল না।
বাসের সহকারী পা চেপে চেপে কাছে আসল। নিচুস্বরে অনেকটা অস্পষ্টে ডাকল- স্যার, স্যার।
-জি! নেশায় বিভোর মন্টু।
-স্যার, আপনার নাক ডাকের শব্দটা খুব বড়। একটু আস্তে আস্তে ডাকবেন কি?
মন্টু ক্ষণিকের জন্য নাক ডাকা বন্ধ করলেন।
পাহাড়ের ঢালু ঘেঁষে ঝর্ণা ধারায় শুটিং হবে। তখন সূর্য অস্ত যাবে। পশ্চিমের আলো বয়ে যাবে তীর-ধনুকের মতো। তবে সেই আলো হবে খুবই মিষ্টি মিষ্টি। বাতাসের গতিবিধি দেখে সামিয়ানা টাঙ্গানো হবে। বাতাস যখন ধাক্কা খাবে একটা বিচিত্র শব্দ অমনি তৈরি হতে থাকবে। যদি বাতাস না থাকে জেনারেটর চালু করে চালাতে হবে ফ্যান।
এটা ছিল নাটকের ছোট্ট একটা স্কিপ।
মনিরা খালি পায়ে ঘাসের ওপর হাঁটছিল। বাতাস বইছে। তার পরনে ছিল নীল রঙের স্কাট। তাকে বেশ মানিয়েছে।
মন্টু ক্যামেরার মুখ বারবার নিচ্ছে মনিরার দিকে। পরিচালক চেঁচিয়ে উঠে। বলে- কী একটা বাজে অভ্যাস। তোমাকে বারবার বলছি ক্যামেরার মুখ মঞ্চের দিকে রাখতে, আর নিচ্ছ মনিরার দিকে। বোকা নাকি?
-না।
-তাহলে?
-এই বিকালের সময় বেশ লাগছে মনিরাকে।
পর্দার আড়ালে বসে আছে ভূমিকা। মেকআপ নিচ্ছে। পরনে সাধারণ পোশাক থাকলেও এখন পরে নিচ্ছে শুটিংয়ের পোশাক। মেকআপম্যান ভেতরে আছে। দিচ্ছে গুছিয়ে।
বহু দূরে শূন্য একটা স্থান। চারিদিক বনানীতে ঘেরাও হলেও উপরে নীল আকাশ আর নিচে রয়েছে সবুজ মকমল ঘাস। পুরাটা একটা টিলা ভূমি। এরপরে শূন্য প্রান্তর।
মসুর ডালের মতো চেপ্টা হয়ে বসেছে আকাশ। রচনা করছে কবিতা। পেছনে পড়ে রয়েছে তার ক্যামেরা। গভীর ধ্যানে লিখছে।
কবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে একটু টের পায়নি আকাশ। রয়েছে খাতা-কলমের মাঝে। ভূমিকা মাঝে মাঝে রসিকতা করে বলত- কবি হলে গভীর ধ্যানি মানুষ হতে হবে। ব্যর্থ প্রেমিক হতে হবে। সুখ থেকে কাব্য আসে না। যত রচনা সৃষ্টি হয় দুঃখ থেকে।
ভাবছে আকাশ। ততক্ষণে ঘেরাও করে ফেলেছে অন্ধকার জগত।
তিন.
সামিয়ানার ফাঁকা অংশ দিয়ে ভোরের আলো প্রবেশ করেছে। তার সঙ্গে একটু একটু ঠাণ্ডা মিশ্রিত বাতাসেও। যা খুবই মজাদার।
হঠাৎ করে চেঁচিয়ে উঠল নিশাত। বলল- ভূমিকা কোথায়?
আতঙ্কের মাঝে সবাই উঠে দাঁড়ালো। শুরু করল খোঁজাখুঁজি। কিন্তু না। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ভূমিকাকে। কী অদ্ভুত কাণ্ড!
শুরু হলো ছোটাছুটি।
সামনে ধু-ধু মাঠ। কচি ধানে ভরা। দৃশ্যটা খুবই চমৎকার। সবুজ আর সবুজ। তার ওপর দিয়ে যখন মৃদু মৃদু বাতাস বইতে থাকে মনে হয় যেন অবলা নারীর চুল ঢেউ খেলছে।
ধান ক্ষেতে পড়ে আছে ভূমিকা। অনেকটা জ্ঞানহীন। দেখামাত্র চেঁচিয়ে উঠে আকাশ। পর মুহূর্তে তার ক্যামেরার বাটনে হাত রাখে।
জ্ঞানশূন্য অবস্থা ভূমিকার। পরনে ছিল হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি। নিচের ভূমিতে ছিল মকমল সবুজ ঘাস। সোনালি রোদ যখন তার ওপর পড়েছে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। এমন একটি সুন্দর দৃশ্যের জন্য একজন কবিকে বহুকাল অপেক্ষা করতে হয়। দৃশ্যটা কবি পেয়েছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল আকাশ। তাকিয়ে রইল জ্ঞানশূন্য ভূমিকার ওপর। মনে হচ্ছে কিছু প্রকাশ করছে। বলছে- আকাশ ভাই, ভূমি ও ভূমিকা মিশ্রিত ছবি একসঙ্গে তুলুন। এই ছবি হবে তোমার সেরা ছবি। যার জন্য তুমি দীর্ঘকাল অপেক্ষা করেছিলে। আজ সার্থক করে দিলাম। কারণ- আমার হিয়ার গহিনে তোমাকে ঠাঁই দিয়েছিলাম। সেই আশ্রয় ছিল অতি গভীর হতে।
ধান ক্ষেতে ছিল অনেক অনেক শঙ্ক-শালিক আর বকের সারি। মানুষের আগমন হতে দেখে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। পাকার শব্দ হচ্ছে- ঠা-ঠা-ঠা।