×

সাময়িকী

কিছু বৃক্ষ রেখে দাও

মাহবুবা ফারুক

Icon

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কিছু বৃক্ষ রেখে দাও

মালী একা একাই পা ছড়িয়ে বসে গাছের কাছে। মাটি ছানে। দেখে। পানি দেয়। গাছের সঙ্গে কথা বলে। কখনো একটু বিশ্রাম নেয়। নতুন কোনো গাছের কথা শুনে সেখানে যায় গাছ আনতে এই বাগানের জন্য। গাছই ধ্যান-জ্ঞান।

বাগানটা আগে থেকেই সাজানো-গোছানো ছিল। সেখানে মালীর দায়িত্ব পেয়ে মোহনবাঁশি গর্বিত। নিজের কাজ দেখানোর একটা সুযোগও এটা। বাগানের মালিক তাহলে খুশি হয়ে আরো বড় কোনো কাজে তাকে পাঠাবে। সে কাজ ভালো না বুঝলেও নিজের উন্নতির সিঁড়ি বোঝে। এ পর্যন্ত এভাবেই এসেছে। আগে রাস্তায় বাদাম বিক্রি করত। বাদাম বিক্রেতা বলে লোকের অবহেলার ছিল। কিন্তু সে শুনেছে বাদামের ব্যবসায়ী কেউ পৃথিবীর অনেক বড় দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। একদিন মন খারাপ থাকায় তাকে কে যেন এটা বলেছিল। তখন থেকে মনে মনে সে প্রেসিডেন্টের স্বপ্ন দেখে। মাঝে মাঝে বাদামের গাড়ি ফেলে রেখে মিছিলে যায়। সেøাগান দেয়- অমুক ভাইয়ের সঙ্গে আছি। সুখ-দুঃখে কাছাকাছি। একদিন এসে দেখে বাদামের গাড়ি উল্টে সব পড়ে আছে, মিছিলের লোকজন পায়ে পায়ে সব গুঁড়া করে রেখে গেছে। মাথায় হাত দিয়ে অনেকক্ষণ বসে থেকে ঠিক করল এই কাজ ছেড়ে দেবে। তারপর থেকে নার্সারির ব্যবসা ধরেছে। সেখান থেকে এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে এই বিশাল বাগানের মালী। মেশার মতো কাউকে পায় না বলে একটু মন খারাপ লাগে। তখন গাছের পাশে বসে বিশ্রাম নেয়। মূলত সে বেশি কথা বলা মানুষ। সেখানে কথা বলার কেউ নেই। আর তার সঙ্গীভাগ্য ভালো না। কী সব প্যাঁচ লেগে যায়। টিকে না। গ্রামে এক ভাবির সঙ্গে একটু ইটিশ-পিটিশ হয়েছিল। ভাইয়ের হাতে ধরা পড়ে গ্রামছাড়া হতে হয়েছে। তবুও মেয়েদের দেখলে তার ভালো লাগে। বুকের ভেতর মোচড় মারে। সে সব ভুলে যায়। মেয়েদের যেন স্রষ্টা কী একটা শক্তি দিয়েছে আলাদা। সেখানে সে হেরে যায়।

বাগানের গাছে পানি দেয়ার কাজটা আলোমতির। সেও নতুন। কাজের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। মালী মোহনের কাছে জেনে নিয়ে কাজ করে। মালীর এই মুরুব্বিয়ানা ভালো লাগে। শ্যামলা রঙের আলোমতির টসটসে হাসিটা তার খুব পছন্দ। দেশি টানে কথা বলে হেসে হেসে। হাসিটা আখের গুড়ের মতো স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কথা বলার সময় আখের রস যেন চুয়ে চুয়ে পড়ে। মোহনের জন্ডিস দিনে খুব দরকার।

কাজে-অকাজে ডেকে কথা বলে। অন্য কর্মচারীরা একটু আড়চোখে দেখে আর বাড়াবাড়ি মনে করে। কানাঘুষা করে। তা করুক। হিংসা করে। আলোমতি তাদের কাছে গেলে সবাই তার আখের রস নেয়ার জন্য গøাস বাড়িয়ে দেয়। সবাই নিজের চিন্তা করে। মোহনবাঁশিও আলোমতিকে নিজের দিকে টানায় মনোযোগ দিল। বাগানের গাছের চেয়ে গাছে যে পানি দেয় তার দিকে মনোযোগ বেশি ঢালে।

আলোমতি নিজের ক্ষমতা জানে। বাগানের ফুল নিয়ে নিজের পাতলা চুলগুলোর চিপ্টু খোঁপাটায় দেয়। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। যেন দেখাচ্ছে না। দেখছে- এমন ভাব করে। বড় বড় ছাপাওয়ালা কটকেটে রঙের শাড়িটা নানা ঢঙে পরে হাঁটে।

মোহনবাঁশি দেখছিল গাছের ফাঁকে ফাঁকে ওর শাড়ির আঁচল। পায়ে আজকাল মেয়েটা নূপুর পরে। ঝপাস করে এসে মোহনের সামনে বসে পা মেলে দেয়। কাঁটা ফুটেছে।

কতদিন কইলাম তুমি খালি পায়ে যাইও না। ইস! দেখি দেখি। পা দুটো টেনে কোলে তুলে কাঁটা ছাড়িয়ে দিল। পানি দিয়ে ধুয়ে কাঁধের গামছা দিয়ে মুছে দিল।

এইভাবে আর যাইবা না। আমারে বলবা।

আদুরে ভঙ্গিতে পা নামায়, আলোমতি। প্রতিটা মুহূর্ত সে ভাঁজ খুলে খুলে উপভোগ করে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। নাকি সুরে বলে, কঁাঁওয়ালা গাছ ফালাইয়া দেও। এই মালী।

: তুমি বলছ যখন ফালামুই। আখের গুড়ের হাসিটা দিয়ে আলোমতি চলে যায়। মোহনের মনে আগুনের জেল্লা বাড়ে। অন্যরা তার পিতলার ঢং দেখে মুখ বাঁকায়। সেদিকে তার খেয়াল নেই। মনে মনে আলোর তাপে সে পুড়তে থাকে।

আলোমতি রোজ এসে তার আধা ক্ষয়ে যাওয়া স্পঞ্জের নোংরা স্যান্ডেলগুলো মোহনের কাছ জমা রেখে যায়। মোহনবাঁশি আজকাল বাগানের মালীর কাজের চেয়ে স্যান্ডেলের জিম্মাদার। অনেকদিন ডেকে বলে, নতুন একজোড়া স্যান্ডেল কিনো। এমুন সুন্দর পায়ে এইডি মানায় না। আলোমতি একদিন বলল, যে কয় সে দিলেই পারে। আমার পায়ে না মানাইলে তার কি?

নতুন একজোড়া স্যান্ডেল মোহনবাঁশি ঠিকই কিনে এনে দিয়েছে। তা নিয়ে বাগানে সবার মধ্যে কত কিছু কাহিনি রটে গেছে। খাবারে যেমন কাপড়ের রং দিয়ে চটকদার করে- তেমন। দুপুরে গাছের নিচে একসঙ্গে বাড়ি থেকে আনা খাবার খেতে বসে। আলোমতি নানা রকম শাক পাতার ভর্তা-ভাজি নিয়ে আসে, মোহনের পাতে উঠিয়ে দেয়। কত জোড়া চোখে তখন আগুন জ¦লে। খেতে খেতে শাড়ির আঁচল দেখে মোহন, এই, ছিঁড়লো কেমনে আমার মুখ মোছার আঁচল?

আলোমতি যেন ধান ক্ষেতের রৌদ্র ছায়ার ঢেউয়ের মতো হয়ে যায়। জ্যোৎস্নার মতো গলে পড়ে। তারপর সেই হাসি দিয়ে মোহনের দিকে তাকায়। তাকায় না-তীর ছোড়ে বিষ মেখে।

: নতুন কথা-শাড়ির আঁচল না মুখ মুছার আচল। ঢঙ। তোমার পিরিতের গাছের ডালে লাইগা ছিঁড়ছে।

পরের দিন নতুন শাড়ি কিনে নিয়ে এলো মোহনবাঁশি। বাগানে বুঝি মজাদার গল্পের রসদ এলো। গাছের কথা কেউ কোনো কিছু বলে না। বলে মোহনবাঁশি আর আলোমতির বেহায়াপনার কথা। কেউ বলে, মোহন কি আমাদের চউখে দেখে না? কেউ বলে, আলোমতির চউখে কি আমাগোরে দেহা যায় না?। কী সব পিরিতালি ঢঙের নমুনা! নিজেদের কপাল চাপড়ায়, কয় দিনে আলোমতির গায়ের রং খুলে গেছে। স্বাস্থ্যও ঢলঢল। হাসির রোশনাই বাড়ছে। আর কমে গেছে অনেক গাছ। যেগুলোতে আলোমতির আঁচল ছিঁড়ে। পায়ে লাগে। হাতে লাগে। গায়ে লাগে- তাতে মোহনের দিলে খোঁচা লাগে। রক্ত ঝরে।

এসব বেয়াদব গাছ বাগানে থাকার দরকার নেই। যদি আলোমতি বলে, আইজ দেখ কেমুন আঁচুড় লাগছে।

: কই? কই? কোনখানের গাছে? কও শুনি? পাগলপারা মোহন। বলার সঙ্গে সঙ্গে কর্তন। কয়েকজন বলল, মোহন, এসব করিস না। চাকরি থাকবে না। মোহন খুব দেমাগি জবাব দেয়।

: এমুন চাকরি গেলে যাউগগা।

: তোর কি হয়েছে রে মোহন? এমন তো ছিলি না।

: নেশা করছি। বিষ খাইছি। আগুন জ¦ালাইছি। হইছে? আমার প্রেমের চেয়ে বড় কিছু নেই। আলোমতির জন্য আমার মাথা আউলাইয়া গেছে। তোমরা নিজের নিজের কাজ কর। আমারে লাইয়া অত চিন্তা করলে কাজ করবা কখন? যা আলোমতির কাম তোরা সবে ভাগ কইরা কর। না করলে বাগানে থাকতে পারবি না। যা ওরে নিয়া কুনো কথা কইবি না।

: আরে কাজ আর করা যাইব না বেশি দিন। গাছ তো মইরা অর্ধেক শেষ। আর কাইট্টা তুই আরো শেষ করলি। যেগুলো আছে এইগুলোও বাঁচব না। বাগান মরুভূমি হইয়া গেছে।

: বেশি কথা কইও না। মালিকের কাছে কইয়া তুমারে গিরিঙ্গি খাওয়ামু।

এসব শুনে আলোমতি কি যেন ইঙ্গিত করে খিলখিল হাসে। গড়িয়ে পড়ে। তার সঙ্গে অনেক চামচা জুটে গেছে। ওরাও হাসে। যদিও জোর করে হাসা। কেউ কেউ তার চুলে ফুল গুঁজে দেয়। গায়ে ফুলের রেণুু মেখে দেয়। আবার আড়ালে গিয়ে মুখ বাঁকায়।

মুরুব্বি উদাহরণ আলি বলে, এত বছর এই খানে চাকরি করলাম। কিন্তু এমন দেখি নাই আগে। নিজেগো মদ্দে মিল নাই। খালি আড়ালে এর বিরুদ্ধে সে। বড় কষ্ট লাগে। আমি চাকরি ছাইরা দিমু ভাবছি। কাজের জায়গায় শান্তি না থাকলে কাজ করা যায় না। আজেবাজে কথাও ভালা লাগে না। ইজ্জত গেল বেকের, কত কথা লোকের।

অনেকের চাকরি চলে গেল। অনেকে নিজেই চলে গেল। বাগানে গাছ বলতে দু-চারটা নিরীহ দেবদারু। রোদে পুড়তে হয় সবার। একটু ছায়া নেই। দাঁড়াবার জায়গা নেই। চারদিকে শূন্যতা।

একদিন কালবৈশাখী উঠলো আকাশে। গাছপালা, বাড়িঘর ভেঙে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে। সবাই নিরাপদ জায়গায় দৌড়ে চলে যাচ্ছে। মোহনবাঁশিও আলোমতির হাত ধরে আশ্রয়ের আশায় ছুটছে। এত ঝড় আগে দেখেনি কখনো। এর চেয়ে খাঁ খাঁ রোদে পোড়াও অনেক ভালো ছিল। ঝড়ে যেন দুজন উল্টে পড়ে। খুব প্রাণপণ দৌড়ায়। কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই। দুজন দুদিকে ছিটকে পড়ে। দৌড়ায়। দৌড়াতে থাকে যে যার মতো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

১৫ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

১৫ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর গ্রেপ্তার

সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর গ্রেপ্তার

ভারতে পাচারের সময় ৮৫০ কেজি ইলিশ জব্দ

ভারতে পাচারের সময় ৮৫০ কেজি ইলিশ জব্দ

মেট্রোরেল মেরামতে ব্যয় কমলো যেভাবে

মেট্রোরেল মেরামতে ব্যয় কমলো যেভাবে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App