×

সাময়িকী

গোলাম কিবরিয়া পিনু

শামসুর রাহমানের কবিতায় আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সময়ের অভিঘাত

Icon

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শামসুর রাহমানের কবিতায় আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সময়ের অভিঘাত

শামসুর রাহমানকে চেনা যায়- তার কবিতায়, কিন্তু কীভাবে? এ ভাবনাটুকু নিয়ে নিজে নিজে আমি অনুরণিত হই; কিন্তু উত্তর পাওয়া কঠিন না হলেও তা অনেকটা ব্যাখ্যা দাবি করে। বিস্তৃত রেখা টেনে টেনে তার অবয়ব তৈরি করতে গিয়ে দেখি- তা অনেক সূ² মনোযোগের বিষয়, আরো গোপন এলাকা উন্মোচন করার স্পর্ধা নিয়ে অনেক সময় ধীরে ধীরে তুলে ধরতে হবে, তা অল্প সময় কিংবা হালকা মেজাজে সম্ভব নয়। শামসুর রাহমানের কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক আমরা হয়তো অনেকে, তার কবিতা পড়ে অনেকে আমাদের সময়কালের কাব্য-পাঠস্পৃহা মিটিয়েছি, ধারাবাহিকভাবে অনেক দিন। ব্যক্তি শামসুর রাহমান এখন আমাদের সম্মুখে শারীরিকভাবে নেই- কিন্তু তার কাব্য-কীর্তি রয়েছে।

শামসুর রাহমান যে সময়ে কবিতা লিখেছেন, সেই সময়ের অভিঘাত, রূপ-রস-গন্ধ কি তার কবিতায় পাওয়া যায় না? যায়! ভালোমতোই পাওয়া যায়। কবি-তো আর দূরালোকের অস্পষ্ট ছায়ার বাসিন্দা নন, তিনি তো তার সময়কাল ও সমাজেরই একজন বাসিন্দা। কবি তার সচেতনতা ও সূ² বুদ্ধির মাধ্যমেই এক ধরনের বোধ সঞ্চারিত করেন- কবিতায়, কবিতার পাঠক সেই বোধে অভিষিক্ত হন। শামসুর রাহমানের দৃষ্টিভঙ্গির যে মূলভূমি- তা আধুনিক মানুষের মনন ও চেতনারই বহু বিস্তৃত এলাকা নিয়ে উচ্চকিত, সেখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা বিশেষ মূল্য নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। শামসুর রাহমানের দায়বদ্ধ কবিতার উচ্চারণ শুধু তার কবিতাকে নয়- বাংলা কবিতাকে দিয়েছে এক নতুন-মাত্রা। বাংলা কবিতার মূলধারাকে করেছে আরো সংহত, গতিশীল ও কাব্য-স্পর্ধায় দিগন্ত-প্রসারী।

শামসুর রাহমান লিখেছেন-

‘‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা,

এবার আমি গোলাপ নেবো।

গুলবাগিচা বিরান ব’লে,

হরহামেশা ফিরে যাবো,

তা’ হবে না দিচ্ছি বলে।

ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা,

এবার আমি গোলাপ নেবো।’’

(ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা)।

এই কবিতাটি বেশ বড়, উল্লিখিত ক’টি পঙ্ক্তি কি নন্দনভাষায় সম্পর্কিত কবিতার পঙ্ক্তি নয়। মনে মনে ভাবি। তবে নিশ্চিত- আধিভৌতিক অনুভূতি-নির্ভর পঙ্ক্তি এগুলো নয়, এগুলো একজন আধুনিক কবির সূ²-অনুভব।

রাজনৈতিক কবিতা লেখার স্পর্ধা সংহত করেছেন শামসুর রাহমান দিনে দিনে। আবেগসর্বস্ব অবস্থান থেকে নয়- কবিতায় পুরোপুরি নিবেদিত থেকে সময়কালের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে তিনি রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন এবং সেই ধারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জোরালোভাবে বজায় রেখেছেন। শামসুর রাহমান তার নিজের ভাষ্যে বলেছেন-

“যখন প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করি, তখন চতুর্দিকে কড়া পাহারা বসিয়ে দিয়েছিলাম যাতে আমার কাব্যক্ষেত্রে রাজনীতির অনুপ্রবেশ না ঘটে। সেকালে, বলা যায় আমার ধারণা ছিল যে, কবিতা ও রাজনীতির মধ্যে অহিনকুলের সম্পর্ক বিদ্যমান। কলাকৈবল্যবাদের প্ররোচনায় আমি সেই ধারণায় বশীভূত হয়েছিলাম এবং এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। অনেকটা বুদ্ধদেব বসুর প্রভাবে রাজনীতিকে অস্পৃশ্য-জ্ঞান করতাম। অর্থাৎ সারাক্ষণ বিশুদ্ধ কবিতা রচনার তাগিদে মশগুল হয়ে থাকতাম এবং রাজনীতি-ঘেঁষা পদ্যকে কখনো কবিতা পদবাচ্য মনে হতো না। ফলে যারা এক নিঃশ্বাসে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের নাম উচ্চারণ করতেন তাদের কাব্যবোধ সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহপ্রবণ ছিলাম। এখন অবশ্য মনে হয়, অতীতে নজরুল ও সুকান্তের ওপর অবিচার করেছি, যদিও আজো এ বিশ্বাসে আমি অটল যে, উল্লেখিত তিনজন কবির প্রতিভার তারতম্য যাদের কাছে স্পষ্ট নয়, তারা আর যা-ই হোন কাব্যরসিক হিসেবে প্রথম পঙ্ক্তিতে বসার যোগ্য নন। যা হোক, আমার কবিজীবনের গোড়ার দিকে রাজনীতি-প্রতিরোধকারী যে দুর্গটি গড়ে তুলেছিলাম তাতে প্রথম চিড় ধরে ১৯৫২ সালে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কালে। তখন থেকেই আমার পদ্যে রাজনীতি উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে। কিন্তু সেই উঁকিঝুঁকি ছিল ক্ষণস্থায়ী; ফলত, আমার প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’তে একটিও রাজনীতিভিত্তিক কবিতা ঠাঁই পায়নি। এক ধরনের শুচিবাই আমাকে উক্ত কাব্যগ্রন্থ থেকে বহু রাজনৈতিক পদ্য ছাঁটাই করতে বাধ্য করে। সেসব পদ্য আমার অন্য কোনো গ্রন্থেও জায়গা খুঁজে পায়নি। বেরহমের মতো সেগুলো বর্জন করেছি। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে আমার কাব্যপ্রয়াস একটা নতুন বাঁক নেয় বলে মনে করি। যে-আমি ছিলাম পুরোপুরি বিবরবাসী, অন্তর্জীবনে সমর্পিত, সে আমি ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠল বহির্জীবনের প্রতি মনোযোগী এবং রাজনীতি-মনস্ক। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুগত না হয়েই আমি রাজনীতি থেকে, গণসংগ্রাম থেকে শোষণ করে নিলাম আমার কবিতার নানা উপাদান। এরপর থেকে আমার প্রতিটি পদ্য রাজনৈতিক আঁচে তৈরি হয়েছে এ কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে।’ শামসুর রাহমানের উল্লিখিত উচ্চারণ কবিদের শুধু পথ দেখায় না, নিজেদের সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। কী স্বচ্ছ ধারণা। কী ঋজু বক্তব্য।

শামসুর রাহমান- সময় ও সমাজকে কবির দৃষ্টিতে অবলোকন করেই কবিতা লিখেছেন এবং তাই তো ভেবেছেন- দেশব্যাপী যখন সর্বগ্রাসী অন্ধকার- তখন অন্যান্য ব্যক্তির মতোই ব্যক্তি-কবিও সংকটাপন্ন হোন, তাই এই অবস্থা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে অন্য কোনো ভূ-ভাগে অবস্থান করা সমীচীন নয়- যা কবির নৈতিকতা-বিরুদ্ধ বলেই তিনি মনে করেছেন। সেই নৈতিক-অবস্থান কবির জন্য বড় অহংকার। এই অহংকার থেকে শামসুর রাহমান বহু কবিতা লিখেছেন, যা পাঠক হিসেবে আমাদের আন্দোলিত করেছে।

‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিম্বা সূর্যাস্তের

জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট

উড়ছে হাওয়ায়, নীলিমায়।

বোন তার ভায়ের অমøান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে

নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো

হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূ²তায়;

বর্ষিয়সী জননী সে-শার্ট

উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।

ডালিম গাছের মৃদুছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত

মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট

শহরের প্রধান সড়কে

কারখানার চিমনি-চূড়োয়

গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে

উড়ছে, উড়ছে অবিরাম

আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,

চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।

আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কুলষ আর লজ্জা

সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;

আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’’

(আসাদের শার্ট) এবং

‘‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?

তেমন যোগ্য সমাধি কই?

মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো

অথবা সুনীল সাগর জল-

সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই।

তাইতো রাখি না এ লাশ আজ

মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,

হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই!’’

(এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?)

এসব কবিতা আমাদের গণআন্দোনের পটভূমিতে লেখা হয়েছে, তারপর সেই কবিতা গণআন্দোলনের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা এক জনগোষ্ঠীর গণমুখী রুচিও তৈরি করেছে কবিতার দিক থেকে, অন্যদিকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক বোধকে জাগ্রত রাখার দায় কবি বহন করেছেন।

আনিসুজ্জামান যথার্থ বলেছেন- ‘‘১৯৫৯ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থে শামসুর রাহমান দেখা দিয়েছিলেন নিভৃতিপ্রিয় আত্মমগ্ন মৃদুকণ্ঠ স্বপ্নচারী কবি হিসেবে। এদেশে তখন সবে সামরিক শাসনের সূচনা হয়েছে। সেই কঠোর যাঁতাকলে আমাদের প্রিয় মূল্যবোধগুলো যখন একের পর এক গুঁড়িয়ে যেতে লাগল, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে তার কাছ থেকে পাওয়া গেল এমন সব কবিতা, যাকে রাজনৈতিক বললে দোষ হবে না। এ রাজনীতি দলের নয়; এ কবিতা সেøাগানের নয়, মর্মঘাতী ব্যঙ্গের, অব্যক্ত যন্ত্রণার, তীব্র ভালোবাসার। সেই থেকে শামসুর রাহমান আর ফিরে তাকাননি। যেখানেই স্বৈরশাসন, সেখানেই তিনি প্রতিবাদী; যেখানেই মানুষের সংগ্রাম, সেখানেই তিনি সঙ্গী। সমাজ ও পরিবেশের প্রতি কোনো সৎ ও বিবেকবান লেখক উদাসীন থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন না। শামসুর রাহমান সেই অঙ্গীকার করেছেন দীর্ঘদিন আগে। তাই গণ-অভ্যুত্থানে ও মুক্তিযুদ্ধে তিনি যেমন শরিক হন কবিতা নিয়ে, তেমনি স্বাক্ষর দেন রাজনৈতিক বিবৃতিতে, স্বৈরাচারের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন সরকার-নিয়ন্ত্রিত দৈনিকের প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে। জীবন, মনুষ্যত্ব ও শ্রেয়োবোধের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে যে-বাণী তিনি উচ্চারণ করেন, তাতে ধ্বনিত হয় বিবেকের কণ্ঠস্বর।’’

জনগণের কাছে যা অকল্যাণকর, যা জনগণের নিয়ত বিরোধী ছিল তার সময়কালে- তারই বিপক্ষে তিনি কবি হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মানসিক ও অন্যান্য যোগাযোগ সঙ্কুচিত করে জনগণ ও সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘেরাটোপে কখনো আটকে রাখেননি। আর সেজন্য তিনি ধর্মান্ধগোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়েছেন। শামসুর রাহমান নিছক স্বভাব কবির মতো কবিতা লেখেননি, সমাজ ও কাল সচেতন আধুনিক কবি হিসেবে তিনি ছিলেন শিক্ষা ও কাব্য-অভিজ্ঞতায় পরিশীলিত। তার কবিতায় ধরা দিয়েছে সেই ব্যঞ্জনা, যা একজন সার্থক কবির শব্দ ও শৈলীর পরিচয় মেলে ধরে। রাজনীতির ক্ষেত্রে কবির কাজ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মতো নয়; কিন্তু কবি রাজনীতিকে সূ²ভাবেই অনুভবের শৈলিতে পরিণত করতে পারেন। কবিতার ভেতর সেই জোর অনুভব করা যায়। শামসুর রাহমান সততায়-আন্তরিকতায় কবি হিসেবে রাজনীতি ও সমাজের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। তার কবিতায় তাকে যেমন চেনা যায়, তেমনি তার কবিতায় আমাদের গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সংগ্রাম ও ইতিহাসের কণ্ঠলগ্ন সময়কে চিনতে পারি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

১৩ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

১৩ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

ডোনাল্ড লু’র নেতৃত্বে আজ ঢাকায় আসছে মার্কিন প্রতিনিধিদল

ডোনাল্ড লু’র নেতৃত্বে আজ ঢাকায় আসছে মার্কিন প্রতিনিধিদল

রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশকে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাত

রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশকে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাত

বিএনপি নেতা আশফাকের নেতৃত্বে বায়রার ইসি বৈঠকে হামলা-ভাঙচুর

বিএনপি নেতা আশফাকের নেতৃত্বে বায়রার ইসি বৈঠকে হামলা-ভাঙচুর

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App