×

সাময়িকী

তাপস চক্রবর্তীর উপন্যাস

‘শেষ পথের রেখা’

Icon

অরূপ পালিত

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘শেষ পথের রেখা’
তাপস চক্রবর্তী কবিতার মানুষ! নাকি নাটকের মানুষ! নাকি ঔপন্যাসিক! তাই আজ আমার ভাববার প্রয়োজন আছে। যদিও আমি এও জানি তিনি একজন সফল নাট্যকার। যার প্রশংসিত নাটক ‘ঝাড়বাতি’ ‘নায়ক’ কিংবা ‘প্রীতিলতা’। তাপস চক্রবর্তীর ৮টি কবিতার বই এবং ৩টি নাটকের বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে তার নাটক সমগ্র ১। এবং উপন্যাস লিখেছেন একটি, যার নাম, ‘শেষ পথের রেখা’। বইটি ২০২২ সালে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি মোটামুটি সাহিত্য মহলে সমাদৃত হয়েছে। উপন্যাসটির শুরুটা ছিল ডিসেম্বর শীতের সকালের দিন দিয়ে, মিষ্টি ঘুমে আচ্ছন্ন গল্পের নায়ক তুষণ। তুষণের স্ত্রী নবনীতার চিৎকারে তুষণের ঘুম ভাঙে। ঘুম ঘুম চোখে তুষণ দেখে নবনীতাকে। তার শিয়রে দাঁড়িয়ে। নতুন সাজে। আজ নবনীতার দৃষ্টিতে আনন্দের বন্যা। নবনীতার রেশমী চুলে লাল গোলাপ। আমার কাছে এই বর্ণনা, যেন আমাদের সময়কার নায়িকা সুচিত্রা সেন। আর তুষণকে মনে হলো উত্তম কুমার। উপন্যাসের বর্ণনায় তুষণ ফিরে যায়, ঠিক এগারো বছর আগের স্মৃতিময়তায়। ভেসে আসে স্মৃতিপটে তাদের বিয়ের লগ্ন! শ্রাবণ মাসের কোনো এক তুমুল রাতে। যেমন উপন্যাসে আমরা দেখি, তুষণ আধভেজা শরীরে আর নবনীতা ছাদনাতলায়। ঝুমঝুম বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা। হাতে হাত রাখা। তুষণ বুঝতে পারে সে আমার হলো। চন্দনের মায়াবী মোহে তুষণকে জড়ালো এক নিবিড় বন্ধনে। তুষণ নবনীতাকে বলে ব্যাপার কী! আজ কি আমাদের বিয়েবার্ষিকী? দৃষ্টিভরা অভিমানী চোখ। এগারো বছরের হিসাব চায় নবনীতা। এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয়, তুষণের ছেলেবেলা। ছেলেবেলা থেকেই নাটক লেখেন তুষণ। এখানেই আমরা তাপস চক্রবর্তীকে খুঁজে পাই। উপন্যাসের শুরুটা চমৎকার। অনায়াসে একটা ঘোরে আচ্ছন্ন করে ফেলে, মনে হচ্ছিল ঔপন্যাসিক প্রতিটি অক্ষরে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে মোহের দ্বারপ্রান্তে। মানে বারবার আমার মনে হচ্ছিল, তিনি আমার জীবনের কথা বলছেন। আমার আশপাশের কথা বলছেন, এইখানেই সার্থকতা। তিনি কীভাবে যে, তুষণ আর নবনীতার রোমান্টিকতায় উপন্যাস শুরু করেছেন। তা ভাবতেই যে কেউ রোমান্টিক হতে বাধ্য। গল্পের নায়ক তুষণ। ঔপন্যাসিক নিজেই প্রতিটি চরিত্র হয়ে কথা বলেছেন নিজের সঙ্গে। এবং পরিভ্রমণ করেছেন উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রে। একটা জায়গায় ঔপন্যাসিক এমন করে বলেছেন, তুষণের মাথাটা প্রায় সময় ভনভন ঘোরে। মনে হয় মাথার ভেতর অজস্র পোকার কিলবিল করছে। মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠে। পাঠক হিসেবে আমিও মাঝে মাঝে চিৎকার করি, শোষণে বঞ্চনায়। ঔপন্যাসিক যে ঘরানার হোক, তিনি কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি। আর উপন্যাসের ভেতরে আরো একটি উপন্যাস লিখিয়ে নিয়েছেন তুষণকে দিয়ে, এটাও একটা চমক বলব নিঃসন্দেহে। যেমন তুষণের উপন্যাস ঔপন্যাসিক বলেছেন, তুষণ আবার লেখতে শুরু করল। নীল আকাশ আজ বিষণ্ন। মেঘবালিকার আনাগোনা। মেঘবালিকার খেয়াল-খুশিতে কখনো বা নেমে আসবে এক পশলা বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে উজ্জীবিত মাধবীলতা, অপরাজিতা, আর বৃষ্টির জলে স্নাত হয়ে লজ্জায় নুয়ে পড়েছে হাসনাহেনা। তুষণের আজ বারবার মনে পড়ছে কোনো এক বর্ষণমুখর দিনের কথা। সেদিন তুলতুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তুষণের কাছে এসেছিল। একটা নীল শাড়িতে রঙিন হয়েছিল তুলতুল। একদম মেঘলা দিনের নীলপরি। কেনো জানি না বারবার নীলরঙের দিকেই হাতটা এগিয়ে যায়। তুষণ হেসে উঠতেই তুলতুল বলে উঠল, জানো বৃষ্টি দেখলেই বড্ড ইচ্ছে হয়, নীলে নীলে নিজের আপন শরীরটা জড়িয়ে নিতে। তারপর তুমুল বৃষ্টির ঝাপটায় সিক্ত হতে। ভেজা শরীরের ভাঁজগুলোকে নিয়ে বৃষ্টির জল খেলুক আদিমতায়। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে উপন্যাসের মূল চরিত্র ঔপন্যাসিক নিজেই। আর নিজেই হওয়াতে তুষণের চরিত্রটি বেশ অন্য রকম এঁকেছেন। উপন্যাসের আরো একটি চরিত্র বন্ধু অনিমেষ। এক কথায় বলতে পারি অসাধারণ। এবং সেই চরিত্রের কথায় উঠে আসে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অন্যতম নায়ক সূর্য সেন। যা অনায়াসে রক্তের ওঠানামা করা স্বপ্ন। বিপ্লবীদের কথা। উপন্যাসে চট্টগ্রামের ধলঘাটের শ্যামল ছায়া। অনিমেষের রক্তে বিপ্লবের ছোঁয়া। ব্রিটিশ খেদানোর আন্দোলনে সূর্য সন্তানদের যেই উজ্জ্বল চিত্র এঁকেছেন, এক কথায় অসাধারণ! অনায়াসে উঠে আসে, শিল্পীর অস্তিত্বময় জীবনে মা ও মাটির সংগ্রামের কথা। আত্মত্যাগের কথা ভুলতে না পারাটাই দুর্দান্ত সফলতা। লেখক অনিমেষের চরিত্রটি নাট্যকর্মী দিয়ে শুরু করলেও লেখক হিসেবে অনিমেষ একজন অসাধারণ। উপন্যাসে নাটকের কথা বেশি উঠে এসেছে। একজন নাটকের মানুষ বলেই এমন হয়েছে। যা দোষের কিছু বলে আমি মনে করি না। উপন্যাসে অনিমেষ চোখ বন্ধ করে সক্রেটিস, সফোক্লিস কিংবা বিশ্বসাহিত্যেরও কথা বলতে পারে। যা একজন লেখক যদি বিশ্বসাহিত্য না জানে তাহলে অনেক কিছু জেনে নিতে পারবে অনিমেষ চরিত্রের সান্নিধ্যে। নির্মম আত্মাহুতি প্রচ্ছদ এঁকে দেয় আমাদের যন্ত্রণার গোপন রং। শেষ পথের রেখা উঁকি দেয় বিস্তর সমকোণে। উপন্যাসের আরো একটি চরিত্র জয়িতা ইসলাম। তুষণদের একসঙ্গে একসময় থিয়েটার করত। সংসারের সবকিছু সামলে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। উঠে আসে জয়িতার স্বামীর কথা। এবং খুব ভালো বলে, তুষণদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠত। এসব বিষয়গুলো বারবার আমাকে ভাবিয়েছে। যেমন লেখক নিজে ও একজন থিয়েটারের মানুষ। নাটকের পরিবারের সদস্যদের আর্থিক টানাপড়েন। লেখকের হৃদয়ের গহিনে লুকিয়ে থাকা কষ্ট সবকিছু এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন। লেখক এই সমাজের কিছু মানুষের মুখোশ খুলে দিয়েছে। মাঝপথে কবি বিশ্বের মহামারি করোনা কথা তুলে ধরেছেন। মহামারিতে অনেক পরিবার গ্রামে চলে যায়। তাই ঔপন্যাসিক এখানে বলেছেন, গরিবের আবার করোনা কিসের? কবি মূলত খেটেখাওয়া মানুষের দুর্ভোগসহ সবকিছু তুলে নিয়ে এসেছেন। পৃষ্ঠা নং ৬২-৬৩-তে একটি পুরনো চিঠি দিয়েছেন। চিঠি পড়ে হৃদয়ের গহিনে কোথায় যেন লেগেছে আমার। আমি পাঠকের মন্তব্যের জন্য চিঠিখানা বই খুলে পড়তে অনুরোধ রেখে ছেড়ে দিলাম। তবু বলি রাত গভীর। রাতের বিষণ্নতা ছুঁয়ে গেছে রুপোলি চাঁদ। দূরে ঝিঁঝিঁর কলতানে মুগ্ধ শটিবন। জানালার পাশের কামরাঙা বন। দূরে চায়না টর্চের আলো দেখা যায়। আস্তে আস্তে দুটো ছায়া দীর্ঘ হয়। এই যে বর্ণনার কাব্যিকতা কবিরাই দিতে পারে। এবং এই জন্যই আমাদের বারবার কবির শব্দের কাছে যেতে হবে। কারণ কবিরাই শব্দের আবিষ্কারক। যেমন ভালো চরিত্রে পাশাপাশি যে দুষ্টু চরিত্রের প্রয়োজন সেটা লেখক অনুভব করেছেন বলেই, তিনি সেটা উপন্যাসের ভেতর দিয়ে তুষণকে দিয়ে করিয়েছেন। এবং লিখিয়ে নিয়েছেন দুষ্টু চরিত্র। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের মতো শুধু অস্পষ্ট কয়েকটি শব্দ তুষণের কানে বাজল। অনিমেষ শুয়ে আছে শহীদ মিনারের সম্মুখে। ফুলে ফুলে সেজে গেছে কফিন। অনিমেষের সব ব্যস্ততা নিয়ে গেছে করোনা মহামারি। সাহিত্যসেবী-সংস্কৃতিসেবী সবাই এসেছে। অনিমেষকে একনজর দেখতে। অনিমেষের মেয়েটাকে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আর কেউ কেউ ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে। কেউ বলছে, বাবার মতো হও। এমন সময় উপন্যাসে আরো একটি চরিত্রের আবির্ভাব হয়। যার কথা গোটা উপন্যাসে কোথাও নেই। মহিলাটি অচেনা। মহিলাটা জাম গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ দেখছিল অচেনা মহিলাটি কাঁদছে। কখনো কখনো আঁচল দিয়ে ঢাকছে নিজের চোখের জল। একপর্যায়ে তুষণ অচেনা মহিলাটার কাছে গিয়ে বলল, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না? আমি আমি অনিন্দিতা... তুষণ অনেকটা পাথরের মতো হয়ে যায়। চোখ ভিজে আসে অনাকাক্সিক্ষত জলে। শব্দরা যায় হারিয়ে। মুখ হতে কথা নিঃসৃত হচ্ছিল না। আকাশের শরীরে কালো মেঘের আনাগোনা। আমিও ভাবতে বাধ্য হলাম, জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আজো কেউ এই পৃথিবীতে অপেক্ষায় থাকে। এমন করে যদি শেষ সময়ে ভালোবাসার মানুষটির কাছে আসে। হয়তো নীরবে দীর্ঘশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসায় হলো শেষ পথের রেখা। উপন্যাসটির চমৎকার ক্লাইম্যাক্স হৃদয়কে দারুণভাবে নাড়িয়ে দেয়। আসলেই ভাবতে হয় জীবন নামক পথের শেষ রেখা হলো মৃত্যু। মৃত্যুই হলো অনাধুনিক একটা বিষয়। যা পুরনো একটা নিয়ম। এর থেকে কারো কোনোভাবে মুক্তি নেই... মিলবেও না। ‘শেষ পথের রেখা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন থেকে। প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত। মূল্য ৩৬০ টাকা মাত্র।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App