×

সাময়িকী

জানালার ওপাশে বিকেল

Icon

সৈয়দ নূরুল আলম

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জানালার  ওপাশে  বিকেল
দিনের আলো মরে এসেছে। একটু পরে জানালার ওপাশে বিকেল নামবে। এইমাত্র রুবী রুম থেকে বের হয়ে গেল। ওকে হাসান আজ আপনি থেকে তুমি বলেছে। একত্রে বসে দুজনে ড্রিং করেছে। শূন্য দূরত্বে এসেছে কিনা হাসান তা মনে করতে পারছে না। প্রথম দিন, বে-হিসেবি হয়ে ও একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিল। ইদানীং মেয়েরা অফিসে নানা কিছু বিক্রয় করতে নিয়ে আসে। কখনো মোটা মোটা দেশি-বিদেশি বই, কখনো কসমেটিক্স। কখনো বা শাড়ি-থ্রি পিস। অফিসের মেয়ে কলিগরা বেশ উৎসাহ নিয়ে এসব কিনে থাকে। ভাসমান বেচাকেনা। শো-রুমের দরকার হয় না। কর্মচারী নেই। ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয় না। স্বাভাবিকভাবে এসব জিনিসের দাম কিছুটা কম থাকে। এতে করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের লাভ। বনানী পনের নম্বর রোডে টাচ অ্যান্ড ফেয়ারের অফিস। এরা বিভিন্ন ধরনের প্রশাধনীসামগ্রী তৈরি করে। বছর পাঁচেকের মধ্যে ভালো একটা মার্কেট পেয়েছে। প্রথমে একতলা-দোতলা মিলে অফিস ছিল। এখন তিন তলাটাও অফিস হিসেবে নিয়েছে। হাসান ভাবছে, আগামী দু’বছরের মধ্যে পাঁচতলা পুরো বাড়িটা-ই অফিস হিসেবে নিতে পারবে। হাসান এ অফিসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি। ডাইরেক্টর এডমিন ও ফাইন্যান্স। ওর ওপরে আছে মল্লিক সাহেব। এ কোম্পানির চেয়ারম্যান। এ দুজনই কোম্পানিকে টেনেটুনে, জল হাওয়া দিয়ে বড় করেছে। গুলশান, হাসানের রুমে এসে বলে, স্যার ইনি রুবী আপা। শাড়ি বিক্রি করেন। এ শাড়িটা ভাবির জন্য নিতে পারেন। মিতু ভাবি তো সুন্দর। মানাবে ভালো। হাসান শাড়ি চেনে না। না সুতো, না রঙ। কিনতে কিনতে মানুষ এসব চিনে ফেলে। কিন্তু হাসান বিয়ের আগে শাড়ির মার্কেটে কখনো যায়নি। এমনকি বিয়ের পরেও। যা কেনার মিতু নিজেই কেনে। মার্কেটে গিয়ে হাসান শুধু পাহারাদার হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। গুলশান শাড়িটা ভালো বলাতে হাসান আস্থা পায়। বলে, তুমি যখন বলছো, দিয়ে দাও। রুবী একটা প্যাকেটে শাড়িটা ভরে, হাসানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ধন্যবাদ স্যার। হাসান বাড়ি ফিরে মিতুকে শাড়িটা দেখালে মিতু খুব খুশি হয় এবং বলে, এক কাজ করলে কেমন হয়, আমি তো বাড়ি যাচ্ছি। যাওয়ার সময় মা-ভাবি-মিনু ওদের জন্য কয়েকটা শাড়ি নিয়ে যাই। তুমি এ শাড়িটা অনেক কমে পেয়েছ। এটা বসুন্ধরা মার্কেটে তিন হাজার-সাড়ে তিন হাজারের কমে পাবে না। ‘ঠিক আছে, গুলশানকে বলব।’ ‘খালি গুলশান-গুলশান করো কেন?’ ওকে কী দরকার। রুবী না কি যেন মেয়েটার নাম বললে, ওকে বাসায় আসতে বলো। দেখে শুনে পছন্দ করি।’ হাসানের প্রথম ইস্যু। প্রথমবার মেয়েরা মায়ের কাছে যায়। তাই মিতুও দিনাজপুর মায়ের কাছে যাবে। হাসান বলে, ঠিক আছে, মেয়েটাকে আগামী শুক্রবার আসতে বলব। ‘শুক্রবার কেন? তার আগে আসতে বলো। আমি তো শনিবার চলে যাব। আর শোন, অনেকগুলো শাড়ি আনতে বলবা। ওর মধ্য থেকে কয়েকটা বেছে নেব।’ ‘শুক্রবারই আসতে বলি। শুক্রবার ছাড়া তো আমি বাসায় থাকি না।’ পরের দিন হাসান অফিসে গিয়ে গুলশানকে শাড়ি নেয়ার কথা বললে, গুলশান রুবীকে ফোন করে বলে, শুক্রবার বেশ কিছু শাড়ি নিয়ে তোমাকে স্যারের বাসায় যেতে বলেছেন। ভাবি নিজে পছন্দ করবেন। স্যারের বাসার ঠিকানা আমি তোমাকে টেক্স করে দিচ্ছি। ‘ধন্যবাদ গুলশান আপা। আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করছেন। ওদিন স্যারের কাছে না নিয়ে গেলে, স্ট্রং রিকোমেন্ড না করলে, স্যার শাড়ি কিনতেন? রুবী আনন্দে গদগদ হয়ে বলে। ‘আমি আর কী করলাম! এমনিতে তোমার ব্যবহার ভালো। অল্পতে সবাই গলে যায়। তোমার জন্য শুভকামনা।’ ‘ওকে আপা। ভালো থাকবেন।’ কিন্তু শুক্রবার যাওয়ার কথা থাকলেও রুবী ওদিন হাসানের বাসায় যায় না। কোনো সংবাদও দেয় না। মিতু কুমড়োর মতো মুখ করে বলে, কই তোমার মেয়েটা তো এলো না। এখন! আমি বাড়িতে মা- বোনদের বলে রেখেছি- তোমাদের জন্য শাড়ি নিয়ে আসছি। এ প্রশ্নের উত্তরে হাসান কিছুই বলতে পারে না। মেয়েটি এমন করবে তা ওর ধারণার বাইরে ছিল। মিতু ফোসফাঁস করতে থাকে। হাসান দুখি দুখি মুখ করে বলে, বুঝতে পারলাম না। মেয়েটার কী হলো। ফোন করব তারও উপায় নেই। ওর ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। ঠিক আছে, আমি যখন সামনের মাসে তোমাকে দেখতে যাব, তখন নিয়ে যাব। মিতু হ্যাঁ-না কিছু বলে না। এ সময় রাগ-অভিমান করে শরীরের ওপর চাপ নিতে চায় না মিতু। তাই মন খারাপ করে, পরের দিন বাবার বাড়ি চলে যায়। ট্রেনের টিকেট কাটা ছিল। হাসান কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে মিতুকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসে। হাসান দিনাজপুর পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছিল। মিতু বলেছে, আমি একা যেতে পারব। বাবা তো স্টেশনে এসে নিয়ে যাবে। কোনো অসুবিধা হবে না। তাছাড়া তুমি তো ঘনঘন ছুটি পাবে না। দু’সপ্তাহ পরে আমাকে দেখতে যেতে চেয়েছ না? তবু হাসানের মন খারাপ হয়। এ সময়ে একা একা যাওয়া! যদিও এখন তিন মাস বাকি। যত সময় ট্রেন না ছাড়ে, হাসান জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন চলা শুরু করলে হাত নেড়ে মিতুকে বিদায় জানায়। হাসানের অফিস সকাল ন’টায়। মিতুকে সাতটায় ট্রেনে তুলে দিয়ে হাসান আর বাসায় যায় না। সরাসরি অফিসে চলে আসে। হাসান মাঝে মধ্যে বেশ আগে অফিসে চলে আসে। এসে আগের দিনের জমা ফাইলগুলো ছেড়ে দেয়। গতকালকের দুটো ফাইল টেবিলে পড়ে আছে; কিন্তু ফাইল দুটো দেখতে হাসানের মন চাচ্ছে না। ভেতরটা গজ গজ করছে। কতক্ষণে গুলশান অফিসে আসবে। এ সময় পিয়ন হারুন এসে বলে, স্যার কফি দেব? ‘না।’ ‘না’ শব্দে বোম্বাই মরিচের ঝাঁজ ছিল, সেটা বুঝতে পেরে হারুন আর কোনো কথা বলে না। ওদিনের দুটো নিউজ পেপার টেবিলে রেখে রুম থেকে বের হতে চায়। হাসান হারুনকে ডেকে বলে, এই শোন, গুলশান ম্যাডাম এসেছেন? ‘জ্বি স্যার।’ ‘ডাকো তাকে।’ হারুন গুলশান ম্যাডামের রুমে গিয়ে বলে, ম্যাডাম, হাসান স্যার মনে হয় খুব রেগে আছেন। আপনাকে ডাকে। গুলশান ভয়ে ভয়ে হাসান স্যারের রুমে ঢুকে বলে, গুড মর্নিং স্যার। ‘গুড মর্নিং। ওই মেয়েটাকে বলেছিলেন, শুক্রবার বাসায় আসতে?’ ‘কেন যায়নি স্যার! আমি তো বলেছিলাম।’ ‘বাসার অ্যাড্রেস বলেছিলেন?’ ‘জ্বি স্যার। অ্যাড্রেস টেক্স করে দিয়েছিলাম।’ ‘ও তো যায়নি। তোমাদের ম্যাডাম তো খুব রাগ করেছে। বাবার বাড়ি খালি হাতে যেতে হলো। ভেবেছিল মা-বোনদের জন্য কয়েকটা শাড়ি নিয়ে যাবে।’ ‘স্যার আমি এখনই রুবীকে ফোন দিচ্ছি।’ গুলশান রুম থেকে বের হয়ে রুবীকে ফোন দেয়। ফোনে উত্তর আসে- সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকবার ফোন দেয়। প্রতিবারই একই- সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। গুলশান কাচুমাচু হয়ে, রুমে এসে বলে, স্যার রুবীকে ফোনে পাচ্ছি না। ফোন যাচ্ছে না। ‘লিভ দিস।’ ‘স্যার আপনাকে কফি দিতে বলি?’ ‘না। যান, কাজ করেন গিয়ে।’ গুলশান মন খারাপ করে রুম থেকে বের হয়ে আসে। হাসান স্যারের কাছ থেকে এ ধরনের ব্যবহার এই-ই প্রথম পেল। শুক্রবার হাসানের বাসার ডোরবেল বাজলে, হাসান এসে দরজা খোলে। দরজায় রুবী দাঁড়িয়ে। ‘তুমি!’ হাসান রুবীকে না-চেনার ভান করে বলে। ‘স্যার আমি রুবী। ওই যে অফিসে ভাবির জন্য শাড়ি নিলেন।’ ‘তো?’ ‘গুলশান আপা ফোন করে আমাকে বলেছিলেন, আরো কয়েকটা শাড়ি নেবেন, তাই-’ ‘ভেতরে আসুন।’ ভেতরে আসুন- কথাটা এমন ঝাঁজ মিশিয়ে হাসান বলে, তাতে রুবী বুঝে যায়, সামথিং রং। রুবী ড্রয়িং রুমের এক কোণে গিয়ে ভেজা বেড়ালের মতো বসে, কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে পায়ের কাছে রাখে। দুটো ব্যাগই বেশ ভারি। একটা কাঁধে, একটা হাতে নিয়ে রুবী সবসময় বেরোয়। এতে করে কেউ বুঝতে পারে না, ও শাড়ি ফেরি করে বিক্রয় করে। হাসান নিজের রুমে চলে যায় এবং পাঁচ মিনিট পরে ফিরে আসে। রুবী লক্ষ করে, দরজা খোলার সময় হাসান স্যারের গায়ে গেঞ্জি ছিল। চুল ছিল এলোমেলো। পরনে ছিল লুঙ্গি। এখন একটা হাফশার্ট পরে, চুল আঁচড়িয়ে, লুঙ্গি পাল্টে, প্যান্ট পরেছে। রুবী ভেবেছিল, পোশাকের এ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, হাসান স্যারের ভেতরের রাগটাও পাল্টাবে। কিন্তু না। হাসান আগের শক্ত স্বরেই বলে, কবে আসবেন গুলশান বলেনি? ‘বলেছিল, শুক্রবার।’ ‘তো?’ ‘আজ তো শুক্রবার।’ ‘শুক্রবার তো মাসে চারটে থাকে। বছরে থাকে অনেকগুলো।’ ‘বুঝলাম না, স্যার।’ ‘গত শুক্রবার আসার কথা বলেছিলাম।’ ‘স্যার গুলশান ম্যাডাম তো নির্দিষ্ট করে বলেননি। শুধু বলেছেন, শুক্রবার দেখা করতে। বিশ্বাস না হয়, আমার ফোনে রেকর্ড করা আছে, শুনবেন স্যার?’ ‘দরকার হবে না। তবে যখন বলা হয় শুক্রবারের কথা, তখন পরের শুক্রবারকেই বুঝায়।’ ‘স্যরি স্যার। আমি বুঝতে পারিনি। আমি আপার ফোন পেয়ে, আমাদের বাড়ি রাজশাহী চলে গিয়েছিলাম, আরও ভালো ভালো কিছু শাড়ি আনতে।’ ‘তুমি ফোনও ধরোনি।’ ‘স্যার আমাদের বাড়ি রাজশাহী শহর থেকে অনেক ভেতরে। একটা অজপাড়াগাঁ। ওখানে প্রায়ই ইলেকট্রিসিটি থাকে না। ফোনে চার্জ ছিল না।’ ‘বুঝলাম। কিন্তু যিনি শাড়ি নেবেন, তিনি তো চলে গেছেন।’ ‘কোথায় গেছেন স্যার? আসবেন না?’ হাসান একথার আর উত্তর দেয় না। বলে, আজ তুমি ফিরে যাও। তোমার ফোন নম্বর রেখে যাও। প্রয়োজন মতো আমি ডাকব।’ এ কথা শুনে রুবীর ভেতরটা ছেৎ করে ওঠে। কত আশা নিয়ে এসেছে, সামনে ওর থার্ড সেমিস্টারের ফি জমা দিতে হবে। কয়েকটা শাড়ি বিক্রয় করতে পারলে, বাকিটা টিউশন ফি মিলে হয়ে যেত। তবে আশার আলো, হাসান স্যার ওকে ‘তুমি’ বলেছে। নিশ্চয় আগের রাগ আর পুষে রাখেনি। তাই ভেবে রুবী সাহস নিয়ে বলে, স্যার নতুন কিছু শাড়ি এনেছি, আপনি একটু দেখেন। ‘আমি তো শাড়ির কিছু বুঝি না।’ ‘স্যার ম্যাডাম কি, ভাই বাড়ি গিয়েছেন? কবে আসবেন?’ ‘হ্যাঁ। ওদের বাড়ি গিয়েছে। প্রথম ইস্যু। আসতে বেশ দেরি হবে।’ দেরি হবে শুনে রুবী দ্বিতীয় বারের মতো ধাক্কা খায়। ও নিজের বুকের মধ্যে ধক ধক ঢেঁকির পাড় শুনতে পায়। ওর সব যোগবিয়োগ এলোমেলো হয়ে যায়। রুবী শেষ চেষ্টা করে বলে, স্যার এক কাজ করলে হয় না, ম্যাডামকে ভিডিও-তে শাড়ি দেখান। ‘না, সেটার আর দরকার নেই। আমি সামনের মাসে সতের তারিখ ওদের ওখানে যাব। তার আগে একদিন আসো। এর মধ্যে আমি একদিন মিতুর সঙ্গে কথা বলে নেবো।’ ‘কিছু মনে করবেন না স্যার। তার আগে মানে, ডেটটা যদি নির্দিষ্ট করে বলতেন। না হলে, আজকের মতো ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে।’ ‘সতের তারিখের আগে দশ তারিখ, শুক্রবার।’ ‘ওকে স্যার। তবে আজ একটু যদি দেখতেন। কষ্ট করে এসেছি, আমার ভালো লাগত। আর ম্যাডামকে কিছু বর্ণনাও দিতে পারতেন।’ কিছু সময় থেমে রুবী আবার বলে, স্যার আমি আরেকটা জিনিস বিক্রি করি। ‘কী?’ ‘অভয় দিলে বলতে পারি।’ ‘আমি কি পুলিশ, না র‌্যাব?’ ‘না। আপনি পছন্দ করেন, কী করেন না, তাই ভাবছি।’ ‘আমি তো অভয় দিয়েছি।’ রুবী আর কোনো কথা না বলে, ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করে, টি টেবিলের ওপর রেখে বলে, অনেকে চায়। তাই মাঝে মধ্যে সঙ্গে রাখি। ‘আমি কখনো খাইনি। অভিজ্ঞতা নেই।’ ‘তা হলে রেখে দিই।’ ‘তাই করো।’ রুবী কোনো দ্বিরুক্তি না করে, যেখানে বোতলটা ছিল, সেখানে রেখে দেয়। ‘স্যার, আজ উঠি তা হলে।’ ‘বোতলটা নিতে পারলাম না বলে, মন খারাপ করেছো?’ ‘না স্যার। খুশি হয়েছি। আমারই ভুল হয়েছে। আপনার অনুমতি ছাড়া আনা ঠিক হয়নি।’ ‘তোমার তো এটা ব্যবসা। নানা ধরনের পণ্য সঙ্গে রাখতেই পারো।’ রুবী হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, স্যার আপনি একদিনের জন্যও খাননি? ‘বললাম তো। আমি ওসবের গন্ধ শুকতে পারি না।’ ‘স্যার এটা হোয়াইট লেডিস ওয়াইন। খুব সফট। একবার ঠোঁট ছোঁয়াতে পারেন।’ ‘না। ওকে।’ ‘উঠি স্যার।’ ‘অনেক দূর থেকে এসেছ। এক কাপ কফি খেয়ে যাও।’ ‘ধন্যবাদ স্যার। আমি কফি খাই না।’ ‘তা হলে অন্য কী খাবে?’ ‘কিচ্ছু না।’ তুমি বসো, আমি দেখি, এই বলে হাসান ভেতরে গিয়ে কিছু সময় পর দুটো প্লেট হাতে করে ফিরে আসে। একটায় দু’পিস কেক। অন্যটায় কয়েকটা চকলেট। প্লেটটা রুবীর সামনে টেবিলে রাখতে রাখতে হাসান বলে, কোনো বাসা থেকে খালি মুখে যেতে নেই। ধন্যবাদ স্যার। না ভাবলাম বাসায় ম্যাডাম নেই। আপনার কষ্ট হবে। রুবী ওড়নার আঁচল খুটতে খুটতে বলে। কষ্টের অপর নামই তো জীবন। এই যে তুমি কষ্ট করছো না? আচ্ছা, গুলশান বলছিল- তুমি নিজের আয় দিয়ে পড়াশোনা করছ। একটা ভালো প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ছ। রুবী হাসানের একথার কোনো জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে থাকে। আরে লজ্জা কিসের! কোনো কাজকেই হালকা করে বা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কাজ তো কাজই। তাছাড়া তুমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পড়াশোনা করছ, এটাতে ভাববার কী আছে। আরো মুখ উঁচু করে বলবে নিজের পড়ার খরচ নিজে জোগাড় করছ। হাসানের এ কথায় রুবী মুখ তুলে বলে, স্যার আমার বাবা তো কোনো টাকা-পয়সা পাঠাতে পারেন না। প্রতি মাসে আমার মামা কিছু পাঠান আর আমাদের স্কুলের হেড মাস্টার স্যার কিছু পাঠান। বাকিটা আমার টিউশনি আর এই শাড়ি-টাড়ি বিক্রি করে যা হয়। রুবীর এ কথা শুনে হাসানের মন নরম হয়। হাসান বলে, শোন, কখনো মন খারাপ করবে না। কোনো কাজই ছোট না। শোন তয়, আমি আমার স্কুল-কলেজ জীবনে প্রায় ছ’বছর বাসায় বাসায় পেপার বিলি করেছি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে, বাসায় বাসায় পেপার পৌঁছে দিয়ে, তারপর ক্লাসে যেতাম। এতে আমার কোনো লজ্জা ছিল না। এখনো নেই। আমার বাবাও তোমার বাবার মতো গরিব ছিলেন। আমার লেখাপড়ার খরচ দিতে পারতেন না। হাসানের এ কথা শোনার পর রুবীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলে, স্যার ওই বয়সে আপনি জীবনকে বুঝতে পেরেছিলেন, তাই আজ এতবড় হতে পেরেছেন। ‘ঠিক তাই। তুমিও একদিন বড় হবে।’ এ কথা বলে হাসান কী যেন ভাবে। কান চুলকায়। তারপর বলে, ঠিক আছে শাড়িগুলো দেখাতে চেয়েছিলে, দেখাও। আর তোমার পছন্দ মতো পাঁচটা শাড়ি রেখে যাও। আমি তোমাকে চেক লিখে দিচ্ছি। হাসানের এ কথা শুনে রুবীর চোখ-মুখ সকালের কাঁচা রোদের মতো ঝলমল করে ওঠে। ও খাওয়া রেখে ব্যাগ খুলতে যায়। হাসান বাঁধা দিয়ে বলে, আরে সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে না। আগে কেক খেয়ে নাও। আর চকলেটগুলো পকেটে ঢোকাও। রুমমেটদের দিও। লজ্জা ও আনন্দ মিশ্রিত একটা আদল ফুটে ওঠে রুবীর সাড়া মুখে। রুবী বুঝতে পারে, স্যারের এ ধরনের একটা অতীত আছে দেখে, বিষয়টাকে এত সহজ, এত আন্তরিকভাবে নিয়েছেন। রুবী একটা কেকের অর্ধেকটা খেয়ে বলে, স্যার এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে। তবে আমাকে যদি বানাতে দেন, তবে। ‘তুমি যে বললে কফি খাও না।’ ‘একেবারে খাই না বললে ভুল বলা হবে। মানে, পরিবেশ পরিস্থিতি ফেবারে থাকলে মাঝে মধ্যে খাই। তখন খাওয়ার ইচ্ছেটা অনেক বেড়ে যায়। দমিয়ে রাখতে পারি না।’ ‘তা হলে বলতে চাচ্ছো, পরিবেশ এখন তোমার ফেবারে?’ রুবী এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলে, স্যার, যতই সময় যাচ্ছে, যতই আপনাকে দেখছি, ততই আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। হাসান রুবীর এ কথার কোনো উত্তর দেয় না। দেয় না মানে, কী বলবে খুঁজে পায় না। কয়েক সেকেন্ড দুজনই নীরব থাকে। পরে নীরবতা ভেঙে রুবী বলে, স্যার কফি বানানোর অনুমতি দিলেন তো? ‘যাও, কিচেনে সবকিছু আছে। কফি এখন আমি নিজেই বানিয়ে খাই। মিতু যাওয়ার সময়, কাজের মেয়ে হাসিকে ছুটি দিয়ে গেছে। আমি একা থাকব- তাই। এ কথা বলে হাসান একটু মৃদু হাসে। কথার অর্থ রুবী বুঝতে পেরে, রুবীও চোরা হাসি হাসতে হাসতে রান্না ঘরে যায়। চার মিনিটের মাথায় রুবী এককাপ কফি বানিয়ে এনে হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়। হাসান তখন একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। ম্যাগাজিন থেকে মুখ তুলে কফির কাপটা নিয়ে বলে, তোমার কফি? ‘স্যার এককাপই বানিয়েছি।’ ‘কেন?’ ‘স্যার, আপনার সামনে বসে কফি খেতে আমি পারব না, তাই শুধু আপনার জন্য বানিয়েছি।’ ‘আমার সঙ্গে বসে কফি খেতে লজ্জা কিসের! তোমাকে তো বললাম। তুমিও ব্যবসা করছো। আমিও ব্যবসা করছি। শুধু তোমারটা একটু ছোট, আমারটা একটু বড়, এই যা পার্থক্য।’ হাসান একটু থেমে, কফির কাপে একটা লম্বা টান দিয়ে বলে, ঠিক আছে, কফি না খাও, তোমার ব্যাগে যে লেডিস ওয়াইন আছে, ওটা বের করো। আমরা দুজনে একটু খাই। রুবী হাসানের কথা শুনে, হা করে হাসানের দিকে চেয়ে থাকে। চট করে ব্যাগটা খুলতে পারে না। ওর হাত কাঁপতে থাকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App