×

সাময়িকী

বাঙালি জাতি ও বাংলা নববর্ষ উৎসব

Icon

আলী ইদরীস

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাঙালি জাতি ও বাংলা নববর্ষ উৎসব
বাঙালি হলো দক্ষিণ এশিয়ার একটি ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠী, যারা বঙ্গ অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা এবং বর্তমানে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা বরাক উপত্যকা, নিম্ন আসাম এবং মণিপুরের কিছু অংশে বিভক্ত হয়ে বসবাস করে। বাঙালিরা মূলত ইন্দো-আর্য পরিবারের বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন’। হান চীনা ও আরবের পরে বাঙালিরা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। ইন্দো-ইউরোপীয়দের মধ্যে বৃহত্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ জাতিগোষ্ঠী। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক উপত্যকার বাইরেও ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বসবাস করে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, দিল্লি, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং উত্তরাখণ্ড রাজ্যগুলোতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাঙালিরা বাস করে। এছাড়া নেপালের প্রদেশ নং ১-এ বাঙালিদের উপস্থিতি রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, মিয়ানমার, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ইতালি, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াতেও ব্যাপক বাঙালি অভিবাসী (বাংলাদেশি বাঙালি এবং ভারতীয় বাঙালি) গড়ে উঠেছে। বাঙালিরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এক বৈচিত্র্যময় জাতিগোষ্ঠী। বাংলাদেশে সিংহভাগ বাঙালি ইসলাম ধর্মের অনুসারী। এছাড়া হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রয়েছেন। ইতিহাসের অন্যান্য বৃহৎ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মতো বাঙালিরাও শিল্প ও স্থাপত্য, ভাষা, লোককথা, সাহিত্য, রাজনীতি, সামরিক, ব্যবসা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে এবং অবদান রেখেছে। পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির সব ধর্মের মানুষের সর্বজনীন উৎসব। এ জাতির একটিমাত্র স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়। বাংলা নববর্ষ বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। বৈশাখী মেলা হলো এ উৎসবের মূলপ্রাণ। হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি। মোগল সম্রাট আকবর তার শাসন আমলে (১৫৫৬-১৬০৫) বাংলার কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তখনকার কৃষিভিত্তিক সমাজ ছিল এই উৎসবের মূলকেন্দ্র। বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, ওড়িশা, কেরালা, মণিপুর, পাঞ্জাব, তামিলনাড়–, নেপাল প্রভৃতি দেশের অর্ধিবাসীরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ হিসেবে এই উৎসব পালন করত। সম্রাট আকবরের আগে ভারতবর্ষের মোগল সম্রাটরা কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন হিজরি পঞ্জিকার দিন-তারিখ অনুযায়ী। কিন্তু হিজরি সন নির্ভর করে সম্পূর্ণ চাঁদের ওপর। ফলে খাজনা আদায় করা নিয়ে ব্যাপক বিপত্তি দেখা দিত। সম্রাট আকবর সুষ্ঠুভাবে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে একটি নতুন পঞ্জিকা প্রবর্তন করেন। এই পঞ্জিকাটির সনই ‘বাংলা সন’ হিসেবে পরিচিত। সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহণের বা অভিষেকের দিনটিকে স্মরণীয় করার লক্ষ্যে তার অভিষেকের দিন থেকেই বাংলা সন গণনা শুরু হয় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ ইংরেজি সন থেকে)। প্রথমে বাংলা সনের নামকরণ করা হয়েছিল ‘ফসলি সন’। পরে কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ‘ফসলি সন’ই ‘বাংলা সন’ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে। বাংলা সন প্রবর্তনে মুসলমান ও হিন্দু উভয় ধর্মে বেশ প্রভাব পড়ে। বাংলা সন ছাড়াও প্রায় সব সনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাবের একটি দিক থাকে। বাংলা সনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিমের মিলিত স্রোতে এ সনটি অসাম্প্রদায়িক অবস্থান সৃষ্টি করেছে। বাংলা নববর্র্ষের সেকাল : সেকালে পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বছর শুরুর আগের দিনে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যেই সবাইকে যাবতীয় খাজনা-মাশুল-শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। আর পরের দিন পহেল বৈশাখে ভূমির মালিক বা জমিদাররা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি আপ্যায়ন করাতেন। খাজনা পরিশোধ করা উপলক্ষে বিভিন্ন লোকজ ও সাংস্কৃতিক উৎসবেরও আয়োজন করা হতো। নববর্ষের প্রথম দিনে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লাল রংয়ের সালু কাপড় দিয়ে মোড়ানো ‘হালখাতা’ খোলা হতো। সেদিন প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় দেনা-পাওনার হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করা হতো। অর্থাৎ আগের বছরের হিসাবের পাট চুকিয়ে নতুন হিসাব শুরু করা হতো। নতুন হিসাবের খাতা খুলে এই হিসাব হালনাগাদ করাকেই বলা হতো ‘হালখাতা’। হালখাতার দিনে দোকানিরা ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করাতেন। এত বছর পরে আজো কিন্তু এই প্রথাটি অনেকাংশে প্রচলিত রয়েছে। বৈশাখ মাসে আরেকটি বড় উৎসব হলো বৈশাখী মেলা। এই মেলাসহ হালখাতা, নানা ধরনের গ্রামীণ খেলাধুলা, যেমন- হাডুডু, লাঠিখেলা, কুস্তি, নৌকাবাইচ, ঘোড়াদৌড়, ডাঙ্গুলি, কানামাছি, দাড়িয়াবান্দা ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান সেকালে মাসজুড়ে চলত। হালখাতাকে উৎসবমুখর পরিবেশে পরিণত করার জন্য রং-বেরং কাগজের তিনকোনাবিশিষ্ট পতাকা সুতোলিতে আঠা দিয়ে লাগিয়ে প্রাঙ্গণকে রঙিন করে তোলা হতো। মহাজন বা দোকানিবৃন্দ রসগোল্লা, বন্দে, জিলাপি, পুরি, লুচি, ডাল-তরকারি ইত্যাদি দিয়ে হালখাতার দিন গ্রাহককে আপ্যায়ন করাতেন। এছাড়া জারিগান, গাজনের গান, যাত্রাপালা, সার্কাসেরও আয়োজন করা হতো। বাংলা নববর্ষের একাল : বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বর্তমান বা একালে আদিকাল বা সেকালের অনেক উৎসব ও নিয়ম কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেলেও জমির খাজনা পরিশোধের বছর ধরা হয় বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ হিসেবে। ইংরেজি শাসনামল অবসানের পর কালক্রমে ‘নববর্ষ’ উদযাপন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর নববর্ষ উদযাপন অনেক প্রাণবন্ত ও বিস্তৃত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালের ‘নববর্ষ’ বা বর্ষবরণ’ এবং আদিকাল বা সেকালের ‘নববর্ষ’ বা বর্ষবরণের মধ্যে অনেক পার্থক্য ও ভিন্নতা লক্ষণীয়। বর্তমানকালে পহেলা বৈশাখের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে নববর্ষের প্রথম দিনটিকে বরণ করা। উল্লেখ্য, পাকিস্তানি শাসনামলে শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে দাবিয়ে রাখার জন্য রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এর প্রতিবাদে ছায়ানট ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে প্রথম ঢাকার রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উযাপনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্য দিয়ে নববরর্ষের প্রথম দিনটিকে স্বাগত জানানো হয়। সেই ধারা আজো অব্যাহত আছে। ১৯৭২ সাল থেকে এ দিনটি জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। পহেলা বৈশাখের আরেকটি অন্যতম আকর্ষণ হলো ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজিত হয় ঢাকায় ১৯৮৯ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ তখন ছিল চারুকলা ইনস্টিটিউট। সেই চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ও আয়োজনে পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়। তারপর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার তা ফিরে আসে চারুকলায়। আর সে শোভাযাত্রায় রং-বেরঙের মুখোশ আর বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিমূর্তি দিয়ে একেক বছর তুলে ধরা হয় আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। একেক বছর এই শোভাযাত্রার জন্য একেক থিম বেছে নেয়া হয়। কোনো বছর থিম রাখা হয় হাতি, কোনো বছর কুমির, কোনো বছর বাঘ। আবার কখনো এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিবাদও জানানো হয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ এবং ভারত ছাড়াও আমেরিকা, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড, সুইডেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাঙালিরা বিপুল আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করেন। উপসংহার : বর্তমানকালে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বাহ্যিক চাকচিক্য ও আনুষ্ঠানিকতা বাড়লেও আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান সময়ে ‘নববর্ষ’ উদযাপনে পান্তাভাত ও ইলিশ মাছ ভাজাসহ মুখরোচক অনেক খাবারের সমারোহ ঘটালেও এতে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না। ধনী ও বিলাসী মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও দরিদ্র ও অসহায় মানুষের অন্তরে সুখ আসে না। আধুনিক যুগের শহরের মানুষের প্রাণহীন জমকালো বর্ষবরণের কৃত্রিমতা পল্লীর প্রীতিপূর্ণ ছোট ছোট উৎসব অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। সমাজের বিত্তবানদের উৎসবের ভিড়ে বাঙালি কৃষকের নববর্ষ উৎসব আজ পিষ্ট। অথচ বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়েছে বাঙালি কৃষকের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। বাংলা নববর্ষের মূল উৎস কৃষক ও কৃষি। সকালের পান্তাভাত ছিল কৃষক সমাজের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক খাবার। সেকালে ইলিশ মাছের সঙ্গে পান্তাভাতের কোনো সম্পর্ক ছিল না। শহুরে আধুনিক জীবনে একালে পান্তাভাত ও ইলিশ মাছ খাওয়া ছাড়া যেন পহেলা বৈশাখের উৎসব অপূর্ণ থেকে যায়- এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App