×

সাময়িকী

বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত

Icon

আবু রাইহান

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতায়  মাইকেল মধুসূদন দত্ত
প্রতিভাধরদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়- যুগে যুগে প্রতিভাকে কষ্ট পেতে হয় এই দৃষ্টান্ত প্রচুর। বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার প্রথম অগ্রপথিক মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো অনন্যসাধারণ এক কাব্যপ্রতিভার অধিকারী শক্তিশালী সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। তিনি ছিলেন বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, বাংলা সনেট আর আধুনিক মহাকাব্যেরও জনক। ধর্মান্তরিত হলেন, সমাজচ্যুত হলেন- হয়ে গেলেন আত্মবঞ্চিত এক রিক্ত পথিক। কলম হাতে ভাঙলেন প্রাচীন যুগজীর্ণ সাহিত্যপ্রথা, তছনছ করলেন মধ্যযুগের দেবনির্ভর, ভাগ্যনিয়ন্ত্রিত জীবনের চেনা ছকের কাব্যিক প্রকাশরূপ। আধুনিক চেতনা ও আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করলেন সংকট-সংশয়, সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলন দিয়ে গড়া দৈবশক্তি ও নিয়তিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সোচ্চার মানবসত্তার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে। বাংলা সাহিত্যে আনলেন নতুন কাব্যিক ছাঁচ, ছন্দ আর স্বাদ। অসম্ভব প্রতিকূলতা, সমালোচনা স্বীকার করে ক্ষতবিক্ষত কবি ইউরোপীয় রেনেসাঁর অভিঘাতে নবালোকে, নব মননে নির্মাণ করলেন নতুন সাহিত্য প্রকরণ। প্রতিষ্ঠিত করলেন বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, বিপন্ন মানুষের চিরন্তন লড়াই সংগ্রাম আর তাদের অবিনাশী প্রাণশক্তিকে। মধুসূদন প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষার বিদ্রোহী কবি। তার কাছে রাম নয়, রাবণ মহামান্য চরিত্র। মেঘনাদবধকাব্য শুরু হয়ে যায় যেন মাঝখান থেকে। বদলে যায় আখ্যান। বাংলা কবিতায়, কাব্যে তিনি আনলেন পাশ্চাত্যের কণ্ঠস্বর। ইউরোপের ব্ল্যাঙ্ক ভার্স ছন্দকে বাংলা অমিত্রাক্ষর ছন্দে বিনির্মাণ করলেন। পেত্রার্কের সনেট হলো বাংলার চতুর্দশপদী কবিতাবলী। মধুসূদনের রচনাকাল ছিল মাত্র ১৮৬০ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত। আধুনিক মন ও মননের অগ্রণী কবি মধুসূদনকে তাই তার জন্মের দ্বিশতবর্ষ পেরিয়ে আবার ফিরে দেখা। গোলাম মুরশিদ মধুসূদনের জীবন ভিত্তিক ‘আশার ছলনে ভুলি’ পুস্তকের সূচনায় লিখেছেন- ‘বন্ধু রাজ, তোমাকে আমি হলপ করে বলতে পারি, আমি দেখা দেব একটা বিশাল ধূমকেতুর মতো-’ বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত যা লিখেছিলেন, তার মধ্যে সন্দেহের সত্যি কোনো কারণ ছিল না। তবে তার এই উক্তিতে একটি ভ্রান্তি লক্ষ্য করি- তিনি যখন (জুলাই ১৮৬১) বলেছেন, তিনি ধূমকেতুর মতন- ‘দেখা দেবেন’, তখন আসলে তিনি কেবল দেখা দেননি, রীতিমতো তুঙ্গে পৌঁছে গেছেন। মেঘনাদবধ কাব্যের দ্বিতীয় খণ্ড এবং বীরাঙ্গনা ছাড়া তার সব গ্রন্থ ততদিনে প্রকাশিত হয়েছে। ততদিনে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বাংলা সাহিত্যের বিতর্কাতিত সর্বশ্রেষ্ঠ কবি এবং নাট্যকার হিসেবে। এ প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও তিনি অবশ্য নিজেকে নিয়ে পুরোপুরি তৃপ্ত ছিলেন না। তখনো ভাবছেন, কাব্যকলা তার ঠিক আয়ত্তে আসেনি। সেজন্য বলেছেন, দেখা দেবো। গত দেড়শ বছরে বাংলা সাহিত্যের আকাশে ছোট-বড় অনেক তারকা দেখা দিয়েছেন। নিজের নিজের বৈশিষ্ট্যে তারা সমুজ্জ্বল। কিন্তু ধূমকেতুর মতো হঠাৎ দেখা দিয়ে নাটকে, কাব্যে যুগান্তর ঘটিয়ে সবাইকে একেবারে উচ্চকিত করেছিলেন একজন মাত্র- মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি যে কেবল ধূমকেতুর মতো অল্প সময়ের জন্য দেখা দিয়েছিলেন, তাই নয়, তার গতিপ্রকৃতি অন্যদের থেকে আলাদা, কক্ষপথও আলাদা। যতক্ষণ ছিলেন, ততক্ষণ তিনি অসাধারণ দীপ্তিতে ভাস্কর ছিলেন। চোখ ধাঁধানো জ্যোতি দিয়ে সবাইকে চমক লাগিয়ে অচিরে তিনি হারিয়ে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব অথবা তার বিস্ময়কর আবির্ভাবের কথা এত কাল পরও বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা ভুলতে পারেননি। বস্তুত বাংলা সাহিত্যের আকাশে বিরল ও বিশাল এক ধূমকেতুর মতোই আবির্ভাব মাইকেল মধুসূদনের। চোখ-ধাঁধানো দীপ্তিতে ভাস্বর, ভিন্নতর গতিপ্রকৃতি, স্বতন্ত্র এক কক্ষপথ। রেখে গেছেন এক চিরস্থায়ী ঔজ্জ্বল্য-কীর্তিতে, জীবনে। সৃষ্টির মতোই আশ্চর্য এক বর্ণময় জীবনও মাইকেল মধুসূদন দত্তের। প্রতিভা ও প্যাশনের, আকাক্সক্ষা ও আকিঞ্চনের, বৈপরীত্য ও নাটকীয়তার অন্তহীন দ্ব›েদ্ব দীর্ণ, বিধ্বস্ত, বিপন্ন। সজীব, স্বমহিম এবং সমকালকে ছাপিয়ে ওঠা সেই জীবন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী স্রষ্টা মধুসূদন দত্তের ব্যক্তিজীবন, আদর্শবোধ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার আলোকে তার কাব্যবৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে দেখা যাবে এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে ধর্মান্তরিত হওয়া, বিদেশে পাড়ি জমানো বা ইংরেজিতে প্রথম কাব্যচর্চা, কল্পনাবিলাস থেকে দ্রুত বাস্তবের মাটিতে নেমে এসে তিনি ভালোবেসেছেন তার স্বদেশ, তার স্বদেশবাসী আর মাতৃভাষাকে। সুদূর ভার্সাই নগর থেকেও তার মানসপটে উদিত এই বাংলার একটি ছোট নদীকে। কপোতাক্ষ নদ কবিতায় আবেগাপ্লুত কবি লিখলেন- ‘সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে!/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে,/ সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে/ শোনে মায়ামন্ত্র ধ্বনি) তব কলকলে/ জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!/ বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে/কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?/দুগ্ধ-স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে।’ মধুসূদনের আগে কেই বা এভাবে নিজের জন্মভূমি, তার প্রকৃতি, নদ-নদীর জন্য এরকম আকুতি অনুভব করেছেন? তার কাব্য রচনায় তিনি ইতালির কবি পেত্রার্কের সনেট নীতি গ্রহণ করলেও তার স্বদেশিয়ানা একটুও বিসর্জন দেননি। নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও পরম্পরাকে অনুসরণ করে ঐতিহ্য স্বদেশ-স্বজাতির প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই তিনি কাব্যচর্চা করেছেন। জীবনের প্রারম্ভের কল্পনা বিলাস থেকে সরে এসে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি তার নিখাদ প্রেম ধরা পড়েছে তার বঙ্গভাষা কবিতায়- ‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন-/ তা সবে, (অবোধ আমি) অবহেলা করি,/ পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ/ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি!/কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।/অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ,/মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;—/কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন!’ কবি মধুসূদনের বঙ্গভূমির প্রতি কবিতায় একই সুরের অনুরণন আমরা দেখি। তার রচনায় পৌরাণিক কাহিনিসমূহের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মূল্যায়নে দেশচেতনা ও বোধের প্রকাশ হতে দেখি। কবির মেঘনাদবধ কাব্যে মহত্ব, বীরত্ব ও দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা তৎকালীন শিক্ষিত বাংলার মননে পরাধীনতার প্রতি ঘৃণা ও শৃঙ্খলা মুক্তির আবেগের সঞ্চারিত করেছিল। মধুসূদন মনে করতেন ধর্ম ও জাতিত্ব এক নয়। স্বধর্মত্যাগী মধুসূদন হিন্দু ধর্মের বিদ্বেষী ছিলেন- এটা বলা যাবে না। মেঘনাদ বধ কাব্যে স্বজাতিদ্রোহী বিভীষণকে ভর্তসনার মধ্যে তার স্বজাতিপ্রীতি ফুটে উঠেছে। মাদ্রাজ হিন্দু ক্রনিক্যাল পত্রিকায় কবির সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, নিবন্ধ ও প্রবন্ধগুলোর মধ্য দিয়ে মানবতাবাদী, অস¤প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, মুক্তচিন্তার অধিকারী মধুসূদন দত্তকে আমরা খুঁজে পাই। বিধবা বিবাহের সমর্থক মধুসূদন নারীর অধিকার রক্ষার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। কলকাতার লোহার সার্কুলার রোডে মহাকবি মধুসূদনের সমাধিফলকে তারই লেখা এপিটাফে তিনি লিখেছেন- দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে-এখানে লক্ষণীয় কবি বঙ্গ পথিককে দাঁড়ান বলেননি, বলেছেন দাঁড়াও। আসলে নিজের দেশ, নিজের দেশের মানুষ ও মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং দৃঢ় প্রত্যয় অটুট বিশ্বাস ছিল বলেই তিনি এরকম সম্মোধন করতে পেরেছেন। সাহিত্য একাডেমি থেকে প্রকাশিত মাইকেল মধুসূদন দত্ত নির্বাচিত রচনা সংকলনের ভূমিকায় সাহিত্যিক শিশির কুমার দাশ লিখেছেন- ‘ইস্কুলে কলেজে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কিছু রচনার পাঠ এখনো বাধ্যতামূলক। তার ফলে শিক্ষিত বাঙালির কাছে তার নাম অপরিচিত নয়। কিন্তু তার কবিতা বা নাটকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে এমন বাঙালির সংখ্যা নগণ্য। আমরা জানি যে তিনি উনবিংশ শতাব্দীর একজন শক্তিশালী কবি, অনেকের মতে তিনিই গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি। কিন্তু আমাদের জাগ্রত সাহিত্যিক চৈতন্যে তার কোনো স্থান নেই। মাইকেল একটি শ্রদ্ধেয় স্মৃতি, মাইকেল একজন স্মরণীয় পূর্বপুরুষ মাত্র। স্মরণীয় কিন্তু সুদূর এবং বিচ্ছিন্ন। কালের ধুলোয় ঢাকা তৈলচিত্রে পূর্বপুরুষদের অবয়ব অস্পষ্ট হয়ে আসা স্বাভাবিক, কিন্তু স্মৃতি উদযাপনের জন্য একটি অবয়বই যথেষ্ট। স্মৃতি ক্রমশই মাইকেলকে দূর থেকে দূরে টেনে নিয়ে গেছে। তবু যে মাইকেলের স্মৃতি বাঙালির মনে উনবিংশ শতাব্দীর অন্য কবিদের চেয়ে উজ্জ্বলতর, তার কারণ বোধহয় বাংলা কবিতার ইতিহাসে তার আকস্মিক এবং প্রায় বৈপ্লবিক আবির্ভাব। আর বোধ হয় তার জীবনের নাটকীয়তা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে নাটকীয় ব্যক্তিত্ব। ধনীর সন্তান, বিলাসলালিত বালকের গ্রাম থেকে শহরে আসা, উচ্চাকাক্সক্ষী তরুণের পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি প্রবল তীব্র আকর্ষণ ইত্যাদি সবকিছু মিলে তার জীবনী যেন বঙ্গীয় এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির পরিচয়ের ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক রূপক। তিনি অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন মাতৃভাষা, আত্মপ্রকাশের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ইংরেজি, আবার ঘটনাচক্রে তাকে ফিরে আসতে হয়েছিল মাতৃভাষারই আশ্রয়ে, এই মাতৃভাষাকে অবলম্বন করেই পেয়েছিলেন যশ, প্রতিষ্ঠা এবং কিছুটা তৃপ্তি। গৃহ ত্যাগ এবং গৃহে প্রত্যাবর্তনের এই কাহিনিকে তিনি স্মরণীয় করে রেখেছেন একটি কবিতায়। সেই কবিতায় যেমন তার ব্যক্তিজীবনের অস্থিরতা, জীবনের অরণ্যে পথ হারানোর জন্য আত্মধিক্কার ও শেষ পর্যন্ত প্রাপ্তির আনন্দ, সেই কবিতা তেমনই গত শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির অভিঘাতে মুগ্ধ বিভ্রান্ত বাঙালি সমাজের মানসিক দ্ব›েদ্বর ও ইতিহাস। ব্যক্তি ও ইতিহাসের এক সংকটময় অধ্যায়ের রূপ সংহত হয়ে আছে একটি আন্তরিক সনেটে।...তিনি নিজে তার পথ পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন স্বপ্নের রূপকের, বঙ্গ কুলল²ী তাকে নির্দেশ দিয়েছেন মাতৃভাষায় প্রত্যাবর্তনের উন্মার্গগামীতার বিপরীতে নির্দেশ করেছেন স্ব-ভূমি। মধুসূদনের জীবনের সবচেয়ে সাফল্যের সময় ১৮৬০-১৮৬১ সাল, যখন তার পারিবারিক জীবন অনেক সুস্থির, আর্থিক জীবন অপেক্ষাকৃত সুদৃঢ় এবং বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও কবি হিসেবে তিনি স্বীকৃত। এই সময়ে তিনি ‘আত্মবিলাপ’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন- ‘আশার ছলনে ভুলি/কী ফল লভিনু, হায়,/তাই ভাবী মনে?/জীবন-প্রবাহ বহি/কাল-সিন্ধু পানে যায়,/ফিরাব কেমনে?/দিন দিন আয়ুহীন/ হীনবল দিন দিন/-তবু এ আশার নেশা ছুটিল না? এ কি দায়!’ এই কাব্যের কথককে আমরা মাইকেল মধুসূদনের সঙ্গেই অভিন্ন করে জেনেছি... তার ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে এই কবিতাকে অবলম্বন করে। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গভাষা সনেট এবং আত্মবিলাপ খণ্ডকাব্য দুটি সমকালেই রচিত। একটিতে তার প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস ও প্রাপ্তির তৃপ্তি, অন্যটিতে অনির্বাণ দাহ, অনিঃশেষ জ্বালা এবং অসহায় আর্তনাদ। এই ভাবমূর্তি আরও অনড় হয়েছে তার জীবনের পরবর্তী অন্যান্য নানা ঘটনার প্রভাবে তার বিলাপ যাত্রা, ফ্রান্সে করুন জীবন, আত্মীয়দের বঞ্চনা এবং সর্বশেষে দারিদ্র্য ও উপেক্ষার মধ্যে মৃত্যু। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার সমাধি লিপির আত্মপরিচয়। ....মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম কিভাবে আমরা উল্লেখ করব তা নিয়ে বাঙালি শিক্ষিত সমাজ যেন কিছুটা সচেতনভাবে দুটো আলাদা শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে। প্রমথনাথ বিশীর ‘মাইকেল মধুসূদনের জীবনভাষ্য’ এবং মোহিতলাল মজুমদারের ‘কবি শ্রীমধুসূদন’ এই গ্রন্থ দুটি সেই দৃষ্টিভঙ্গির অভিজ্ঞান। মাইকেলের ব্যক্তিত্ব ও তার জীবনের নাটকীয়তা বাঙালিকে কি পরিমাণ আকর্ষণ করেছিল তার কিছুটা চিহ্ন আছে রঙ্গমঞ্চ এবং পর্দায়। বনফুলের নাটক ‘শ্রীমধুসূদন’, শিশির কুমার ভাদুড়ীর নাট্য প্রযোজনা ‘মাইকেল মধুসূদন’, মধু বসুর চলচ্চিত্র ‘মাইকেল মধুসূদন’, নট ও নাট্যকার উৎপল দত্তের নাটক ‘দাঁড়াও পথিক বর’। আর কিছুটা চিহ্ন আছে মাইকেলের জীবনী গুলিতে। যোগীন্দ্রনাথ বসুর ‘মাইকেল মধুসূদনের জীবন চরিত’ থেকে সা¤প্রতিকতম গোলাম মুরশিদের ‘আশার ছলনে ভুলি’ সেই নাটকীয় ব্যক্তিত্বের সমালোচনার ইতিহাস। তার জীবনই একটি উপভোগ্য নাটক, তিনি তার ট্র্যাজিক নায়ক। কিন্তু এই নাটকের অন্তর্নিহিত শক্তি শুধু মাইকেলের ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্সক্ষা, বিলাসিতা, হটকারিতা ও অন্যান্য ব্যক্তিগত ভুল ত্রæটি থেকে উৎসারিত নয়। এই শক্তি প্রবলতম হয়ে উঠেছে যখন তার ব্যক্তিগত জীবন একটি বিশেষ কালের সংকটের সঙ্গে একইভূত হয়ে গেছে। তার ব্যক্তি জীবন ও সাহিত্য জীবন হয়ে উঠেছে একটি বিশেষ সময়ের ও সমাজের প্রতীক।....তার কবিতাই তার জীবন: জীবন কাব্যের এমন ঘনিষ্ঠ সামীপ্য বিরল। বাংলা কবিতার ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে মেঘনাদবধ কাব্যের মতো একটি রচনাকে যখন দেখি, তখন বুঝি তার মধ্যে ছিল একটা শক্তির প্রচণ্ডতা, যা বাংলা কবিতায় সম্পূর্ণ নূতন। পুরনো কোনো কিছুর সঙ্গেই যেন তার যোগ নেই। শুধু প্রচণ্ডতা নয়, তার মধ্যে আছে একটা আকস্মিকতা। বাংলা কাব্যের স্বাভাবিক বিবর্তনে তার জন্ম নয়। তার আবির্ভাব যেন ইতিহাসের স্থির ধাপগুলি লাফিয়ে অতিক্রম করে। এক কথায় বলা চলে তার মধ্যে রয়েছে এক বৈপ্লবিকতা।... অভ্যস্ত কাব্য পরম্পরাকে মাইকেল চ্যালেঞ্জ করলেন। এই চ্যালেঞ্জ করার কারণ সেই সময় বাঙালি সাহিত্য চৈতন্যে একটা আলোড়ন এসেছিল ইংরেজি সাহিত্যের সংস্পর্শে এবং বিদেশি শাসনের প্রতি পরস্পরবিরোধী মনোভাবে। একটা সংবেদনশীলতা জন্ম নিচ্ছিল বাঙালির সাহিত্যিক চৈতন্যে যার উপযোগী ভাষা তৈরি করে নিতে হচ্ছিল কবিদের। মাইকেল তার কবিতার ভাষাকে সচেতনভাবে কৃত্তিবাস, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্রের আখ্যানের ভাষা থেকে পৃথক করতে চাইলেন। বাংলা কবিতায় মাইকেল বিচিত্র পরীক্ষা করেছেন, বিষয়ের পরীক্ষা এবং আঙ্গিকের পরীক্ষা। বাংলা কবিতাকে তিনি যুক্ত করতে চেয়েছেন ইউরোপীয় কবিতার ঐতিহ্যের সঙ্গে। অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি করেছেন, তার আদর্শ পেয়েছেন ইংরেজিতে, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ লিখেছেন অভিড এর কাব্যের অনুসরণে। বাংলায় সনেটের সূচনা করেছেন পেত্রার্কের আদর্শে। এইসব কথা গত ২০০ বছর ধরে বাঙালি গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করে। কিন্তু মাইকেলের খ্যাতির মূল ভিত্তি ‘মেঘনাথবধ কাব্য’। কারণ এখানে তার প্রতিভার উজ্জ্বলতম প্রকাশ। এখানেই অমিত্রাক্ষরের নৃশংসয় প্রতিষ্ঠা। এখানে আছে নানা ইউরোপীয় কবিতার অন্তর্বয়ন, এখানে আছে এক গ্রিক মহাকাব্যের কাঠামোর মধ্যে নতুন করে রামায়ণ রচনা। মেঘনাদবধ কাব্য ও মাইকেল মধুসূদন বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসের অঙ্গাঙ্গিবদ্ধ কাব্য ও জীবন। এই কাব্য তার সমকালকে মুগ্ধ করেছিল তার বিচিত্র গঠনের জন্য। মাইকেল রামায়ণ লিখেছিলেন হোমারের কাব্যের আদলে, আখ্যানের যে গঠনকে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট, মাইকেল সচেতন ভাবে সেই গঠনটির সন্ধান করেছিলেন। প্রাচীন আখ্যানে যিনি ছিলেন প্রতিনায়ক, মাইকেল তাকে আনলেন আখ্যানের কেন্দ্রে। রাম নয়, রাবণ এই নতুন কাব্যের নায়ক। এই প্রথম বাংলা ভাষায় এক কাব্য লেখা হলো যার নায়ক আখ্যানের শুরু থেকেই অভিশপ্ত, অনিবার্য পরাজয়ের দিকে যার যাত্রা। আর তার প্রতি কাব্যের কথকের সমস্ত সহানুভূতি। এক পুত্রের মৃত্যুতে আখ্যানের উদ্বোধন, আরেক পুত্রের মৃত্যুতে কাব্যের অবসান। আর এই দুই মৃত্যুর মধ্যে প্রসারিত হয়ে আছে রাবণের জীবন। রাবণ কখনও পুত্র শোকে মুহ্যমান, কখনো অদৃষ্টের প্রতি ক্ষুব্ধ অভিমানী, কখনো বা পুত্রের মৃত্যুর প্রতিহিংসায় উদ্দীপ্ত। কিন্তু সমস্ত কিছুকে আচ্ছন্ন করে যা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা এক নিঃসঙ্গ মানুষ, এক শোকার্ত পিতা, এক পরাজিত বীর, যার ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অলক্ষ্যে। মাইকেল যখন কালবৈশাখীর মত্ততায় বাংলা সাহিত্যকে স্বচকিত করে তুলেছিলেন, ঠিক সেই সময়ই জন্ম হচ্ছিল নতুন এক কাব্য ধারার। এই কাব্যের কেন্দ্রে ছিল কবি স্বয়ং। প্রকৃতপক্ষে মাইকেলের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলা কবিতায় একটা আদর্শের টানা পড়েন তীব্র হয়ে ওঠে। শুরু হয় বস্তুমুখিতা থেকে আত্মমুখিতার দিকে যাত্রা। একদিকে আখ্যান কবিতার স্রোত, আর একদিকে ছোট ছোট আকারের কবিতার স্রোত। ছোট কবিতার ও একটি সমগ্রতা আছে, পূর্ণতা আছে। তার জোর মুহূর্তের ওপর। একটি মুহূর্ত, একটি অনুভূতির অভিনবত্বই তার কেন্দ্র। আখ্যান কবিতা থেকে ছোট কবিতার অভিমুখে বাংলা কবিতার যে পরিবর্তন ঘটেছিল তা মধুসূদনের মৃত্যুর পরে। বঙ্গীয় রেনেসাঁ যখন ধর্মীয় কুসংস্কার, জড়তা ও নানামুখী অন্ধকার প্রবণতা থেকে মুক্ত করে সমাজ সংস্কারকে উদ্বুদ্ধ করে, সেই যুগ পরিপ্রেক্ষিত ও পটভূমির দ্বারা প্রভাবিত ইউরোপীয় চিন্তনের আলোকে আলোকিত কবি মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী সত্তা। একদিকে ছক ভাঙা সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা, অন্যদিকে প্রচলিত বিশ্বাস ও মিথ ভেঙে বাল্মিকী রামায়ণের বিনির্মাণে রচিত তার ‘মেঘনাথবধ কাব্য’ বাংলা সাহিত্যে এক দুঃসাহসী প্রচেষ্টা। বাল্মিকীর সংস্কৃত রামায়ণ বা কৃত্তিবাসী বাংলা রামায়ণের নায়ক রামচন্দ্র ঐশী শক্তির অধিকারী তিনি। কিন্তু ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীভুক্ত নবচেতনায় উদ্দীপ্ত বিদ্রোহী মধুসূদনের কলমে রামায়ণের দেবতা রাম কোনো আদর্শবান, ব্যক্তিত্ববাদী, ভগবানের অবতার নন। বরং মানসিকভাবে দুর্বল, কপট, নীতিহীন মানুষ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। মধুসূদন দীর্ঘ লালিত বিশ্বাসে আঘাত হেনে তার সময়ে বাঙালি মনন ও মনে ঢেউ তুলেছিলেন। কবি একজন আধুনিক মানুষ হিসাবে রামচন্দ্র চরিত্রে কোনো দেবত্ব আরোপ করেননি। তার রচনায় সীতাহরণ কাণ্ডে রাবণের প্রেমময়তা প্রকাশিত হয়েছে। বীরবাহুর মৃত্যুর পর মেঘনাদের সেনাপতিত্ব গ্রহণ, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে নিরস্ত্র মেঘনাদকে লক্ষণের হত্যা করা- কবি অন্য আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। রামায়ণের খলনায়ক রাবণ নিছক এক রাক্ষসকূলপতি নন, বরং পিতার স্নেহ-মমতা, স্বদেশ-স্বজাতিকে রক্ষার তাগিদ তাকে মহিমান্বিত করেছে। বিভীষণের স্বজাতি বিরোধিতা কবির কলমে ধিকৃত হয়েছে। নতুন বিষয়কে মহাকাব্যে উপস্থাপন এবং নতুন আলোকে চরিত্রের বিনির্মাণের মতো দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী সত্তা। জন মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট মহাকাব্যের মতোই তার মেঘনাদবধ কাব্যে চিরায়ত প্রতিনায়ক রাবণ শৌর্যবীর্য, অনমনীয় আদর্শবোধ ও মানবিক গুণে হয়ে উঠেছেন নায়ক চরিত্র। এখানে রাবণ স্বদেশপ্রেমী, অপরদিকে রামচন্দ্র পরদেশ আক্রমণকারী, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের প্রেরণা, ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ আর পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের আকুতি কবি মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাই তার বিদ্রোহী সত্তায় রাবণ চরিত্রটি হয়ে উঠেছে আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত স্বাধীনচেতা মানুষের লড়াইয়ের মুখ। কবির বিদ্রোহী মানসপটের ভিত্তি ছিল তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য। আর মেঘনাদবধ কাব্য পরবর্তী রচনাতেও সে বিদ্রোহের সুর অ¤øান ছিল, ব্রজাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা শর্মিষ্ঠা প্রবৃত্তি কাব্য ও নাটকেও আধুনিক দ্রোহী মধুসূদনকে আমরা খুঁজে পাই। উনিশ শতকের মানবতাবাদ নারীর কাছেও নিয়ে এসেছিল সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার মূলবাণী। বীরাঙ্গনার প্রতিটি চরিত্র পৌরাণিক হলও কবি তাদের মধ্যে বাংলা নবজাগরণের মুক্তির বাণী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ সঞ্চারিত করেছেন। শুধু কাব্য বা নাটক নয়, তার প্রহসনমূলক রচনায় সামাজিক বিদ্রোহ সরব হয়ে উঠেছে। ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ‘প্রহসন দুটিতে তৎকালীন সমাজের প্রতি চিরবিদ্রোহী মধুসূদনের প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতে, প্রতিটি যুগেই পুরনো ঐতিহ্যকে সরিয়ে কবিকে নতুন পথের সন্ধান করতে হয়। আর তাতেই তাকে হতে হয় বিদ্রোহী। এভাবেই আধুনিক মননে ঋদ্ধ মধুসূদন দত্ত হয়ে উঠেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি সত্তা। মাইকেলের সাহিত্য জীবনকে স্পষ্টত তিনটি কাল পর্বে বিভক্ত করা চলে। প্রথম পর্ব ১৮৪২ থেকে ১৮৫৮ অর্থাৎ কলকাতায় ছাত্র অবস্থা থেকে শুরু করে মাদ্রাজ প্রবাস জীবন এবং কলকাতা ফিরে আসা। এই পর্বে তার সাহিত্যচর্চার ভাষা ইংরেজি। ঐতিহাসিক দিক থেকে প্রথম না হলেও আধুনিককালে মাইকেলই প্রথম স্মরণীয় দ্বিভাষী ভারতীয় সাহিত্যিক। প্রথম পর্বে রচনা মাইকেল প্রায় অস্বীকার করেছেন। মাইকেলের সাহিত্য জীবনের দ্বিতীয় পর্বের ভাষা বাংলা। কিন্তু ইংরেজি ও বাংলা পর্বের মাঝখানে একটি ছোট পর্ব রয়েছে সেটি অনুবাদ পর্ব। ইতিহাসের একটি পরিহাসও আছে এই উপপর্বটিতে মাইকেল শেষ পর্যন্ত মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় এলেন। কলকাতায় তিনি চাকরি পেলেন পুলিশ কোর্টে দোভাষীর। তার নতুন সাহিত্যজীবন শুরু হল অনুবাদের মাধ্যমে। এইখান থেকে শুরু হলো মাইকেলের সাহিত্য জীবনের ক্রান্তিকাল। অনুবাদক হিসেবে তার কলকাতা সাহিত্য সমাজে প্রথম প্রতিষ্ঠা। তারপরই তিনি বাংলা লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘শর্মিষ্ঠা’ নামের নাটক লিখলেন। মাইকেলের সাহিত্য জীবনের দ্বিতীয় পর্বের ব্যপ্তি মাত্র চার বছরের। এই চার বছরে তিনি নাটক লিখেছেন পাঁচটি-শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯), একেই কি বলে সভ্যতা? (১৮৬০), বুড়ো শালিকের ঘাড়ের রোঁ (১৮৬০), পদ্মাবতী (১৮৬০) আর কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১)। এই চার বছরে কাব্য লিখেছেন চারটি- তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য (১৮৬১), মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১), ব্রজাঙ্গনা (১৮৬১) এবং বীরাঙ্গনা (১৮৬২)। মাইকেলে সাহিত্য জীবনের দ্বিতীয় পর্বের ক্রিয়াস্থল কলকাতা। মাইকেল জীবনের তৃতীয় পর্বের ক্রিয়াস্থল ফ্রান্স এবং আবার কলকাতা। সময় ১৮৬২ থেকে ১৮৭৩, তার মৃত্যুর বৎসর। মাইকেলের সাহিত্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় দ্বিতীয় পর্বের চারটি বছর- তার খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, ঐতিহাসিক ভূমিকা সবই নির্ণিত হয়েছে মূলত এই চার বছরের কর্মে। তৃতীয় পর্বে তার সাহিত্যিক জীবন বিঘিœত, বিপর্যস্ত। মাইকেল রচিত পাঁচটি নাটকের মধ্যে তিনটি নাটক সম্বন্ধে বর্তমান সময়ের পাঠক পাঠিকার উৎসাহ ক্ষীণ। কিন্তু ব্যাঙ্গাত্মক নাটক একেই কি বলে সভ্যতা?, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ আজো বাঙালির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রহসন দুটি মাইকেলের বিচিত্র রীতি প্রয়োগের ক্ষমতার অসামান্য প্রমাণ। মেঘনাদবধ কাব্যের রীতির লক্ষ্য ছিল এক শিল্পিত প্রাচীনতত্ত্ব। তার লক্ষ্য ছিল এক ধ্বনি কল্লোলের উদ্ভাবন, লোকায়তন গীতি কবিতার কোমলতার পাশে এক মহাকাব্যিক কঠিন কোমলের মিশ্রণ। এই নির্মাণ কারুকার্যের জন্য মাইকেল প্রশংসা পেয়েছেন অনেক, সঙ্গে ধিকৃতও হয়েছেন। মাইকেলের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ এবং বুদ্ধদেব বসুদের অভিযোগ ছিল মেঘনাদবধ কাব্যের ভাষা কৃত্রিম। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, মাইকেল একটি ভাষা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন একটি বিশেষ কাব্যের জন্য। তিনি আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন বাংলা ভাষার একটি নিহিত, অপরীক্ষিত শক্তিকে। আর এই শক্তি যখন অগ্নুৎপাতের প্রচণ্ডতায় বিস্তারিত হয়েছিল তখন অবাক হয়ে দেখেছিল বাঙালি সাহিত্যিক স¤প্রদায়। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষার প্রয়োগের ইতিহাসে এমন ঘটনার কখনো ঘটেনি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) বাংলা সাহিত্যের ছায়াপথে এক আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্র। নতুন আঙ্গিক, বর্ণনাভঙ্গি আর গঠনরীতির প্রয়োগে এক উজ্জ্বলতম সাহিত্যিক হিসেবে তিনি আজো বহুল চর্চিত ও সমাদৃত কাব্যপ্রতিভা। এটা ঠিক, কবি তার প্রতিভা অনুযায়ী প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি। বাংলা সাহিত্যবোদ্ধারা তার যথাযথ মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছেন। কবি সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার তার ‘শ্রীমধুসূদন’ গ্রন্থে যথার্থই লিখেছেন- ‘মধুসূদনের দুর্ভাগ্য এই যে, এত বড় কবি শক্তির অধিকারী হইয়াও তিনি বাংলার কাব্য সাহিত্যে কেবল খ্যাত- খনন, সেতু নির্মাণ ও সোপান রচনাই করিয়া গিয়াছেন। এক দুঃসাহসিক অভিযানের পথিকৃৎ হিসেবেই তিনি এ যুগের সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করিয়া আছেন। যত বড় প্রতিভা তত বড় সৃষ্টির নিদর্শন রাখছে যান নাই।’ সাহিত্য জীবনের দর্পণ, সমাজের বিশ্বস্ত প্রতিভাস। একথা সত্য মধুসূদনের কাব্য, নাটকের চরিত্ররা পৌরাণিক কাহিনির নায়ক নায়িকারা। ফলে আধুনিক কবির চরিত্রগুলি আজ যুগান্তরে অনেকটা অচেনা, বা অধরা। কবি মধুসূদন যে কবিকে তার জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি ইংরেজি সাহিত্যের দিকপাল কবি জন মিল্টন। পিউরিটান বিপ্লবের সৈনিক মিল্টন যখন তার অমর কাব্য ‘প্যারাডাইস লস্ট’ লেখেন, তখন তিনি অন্ধ, চরম সংকটাপন্ন। তার বিপ্লবী উদ্যোগ পরাভূত হয়েছে, রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটেছে, পিউরিটানরা বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত। কিন্তু হার মানেননি কবি। প্যারাডাইস লস্ট এ বীরত্ব আছে, কিন্তু সে বীরত্ব কর্তৃত্ব পরায়ণ ঈশ্বরের নয়, ঈশ্বর বিদ্রোহী স্যাটার্নের। মহাকাব্যের কেন্দ্রে রয়েছে আদম ও ঈভের ঈশ্বর আদেশ অমান্য করার ঘটনা। সেও এক বিদ্রোহ বটে, যার পরিণতি অতি করুণ-আদি পিতা-মাতা আদম ঈভের স্বর্গচ্যুতি। মিল্টনকে জয়ের নয়, পরাজয়ের কাহিনি লিখতে হয়েছিল। কবি মধুসূদনকেও ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে তার কাব্য রচনা চালিয়ে যেতে হয়েছিল। যুগজীর্ণতায় মলিন সংস্কার আর সাহিত্যরীতিতে বুঁদ হয়ে থাকা বাংলার মানুষের প্রতি তার অভিমান ব্যক্ত হয়েছে- ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে, মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে, নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।’ তবুও হাল ছাড়েননি কবি। যে মধুসূদনকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত ছিলেন, তিনিই পরবর্তীতে ‘ভারতী’ পত্রিকায় লেখেন- ‘তিনি স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির প্রচণ্ড লীলার মধ্যে আনন্দ বোধ করিয়াছেন। এই শক্তির চারদিকে প্রভূত ঐশ্চর্য, ইহার হরম্যচূড়া মেঘের পথ রোধ করিয়াছে, ইহার রথ-রথি-অশ্ব-গজে পৃথিবী কম্পমান,... যে অটল শক্তি ভয়ংকর সর্বনাশের মাঝখানে বসিয়াও কোনোমতেই হার মানিতে চাহিতেছে না,- কবি সেই ধর্ম বিদ্রোহী মহাদম্ভের পরাভবে সমুদ্রতীরের শ্মশানে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন। যে শক্তি অতি সাবধানে সমস্তই মানিয়া চলে, তাহাকে যেন মনে মনে অবজ্ঞা করিয়া যে শক্তি স্পর্ধা ভরে কিছুই মানিতে চায় না, বিদায়কালে কাব্যল²ী নিজের অশ্রæসিক্ত মালাখানি তাহারই গলায় পরাইয়া দিল।’ মৃত্যুকে অবজ্ঞা করার দুঃসাহস কবির ছিল বলেই অমরত্বের বাসনা তার হৃদয়ে কোথাও যেন উঁকি মেরে গেছে। তাই তিনি লিখেছেন- ‘সেই ধন্য নরকূলে,/ লোকে যারে নাহি ভুলে,/ মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্বজন,-’। কবির জন্মের দুশ বছর পরেও কবিকে আমরা ভুলিনি। তার কাব্য কবিতার চরিত্র গুলির গুণমুগ্ধরা রাষ্ট্রীয় শক্তি বা আর্থিক শক্তিতে বলিয়ান আত্মদম্ভী, আধিপত্যকামীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আরও রসদ পান। প্রতিষ্ঠান বিরোধী কবি সাহিত্যিকরা চলমান সত্যের বিপ্রতীপে কাব্য সাধনার অনুপ্রেরণা পান। ক্ষতবিক্ষত সৈনিক নতুন লড়াইয়ের উৎসাহ পান। আর এই প্রাপ্তির মধ্যে বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী সাহিত্যিক মধুসূদন দত্ত কালজয়ী হয়েছেন। বর্তমানে আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক দল নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে রামায়ণের রামকে জাতীয় নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন। সাহিত্য বিশ্লেষকদের অভিমত, এই পরিপ্রেক্ষিতে মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App