×

পাঠকের কলাম

মার্কিন মানবাধিকার

নীতির দ্বৈততায় আচ্ছাদিত

Icon

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

 নীতির দ্বৈততায় আচ্ছাদিত
বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে- ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে’? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন, তাদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে নেয়া তাদের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিপরীতে সবাই যখন হতাশা প্রকাশ করে তখন বাংলা এ প্রবাদটি বলা ছাড়া আর কিইবা করার আছে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার মতো কেউ কি আছে! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রতি বছর নিজেদের বাদ দিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উল্লেখ করে একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ ২০০টি দেশের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যাতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বলে মন্তব্য প্রকাশ করে। মার্কিন প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশের মানবাধিকারের উন্নতি মার্কিন প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশের মাত্র একদিন পরই মার্কিন সিনেটে বহুল আলোচিত ৯৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার বিল পাস করে। যা তাইওয়ান, ইউক্রেন ও ইসরায়েলে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য দেয়া বরাদ্দ। সমগ্র বিশ্ব যখন অবাক বিস্ময়ে যুদ্ধময় পৃথিবীতে শান্তির জন্য অধীর আগ্রহে সমাধানের পথ খুঁজছে ঠিক তখনই মানবাধিকারের ত্রাণকর্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সামরিক সহায়তা বিলের বিশাল বাজেট ছাড়ের খবরটি শান্তিপ্রিয় মানুষকে মর্মাহত করেছে। কারণ মুখে মানবাধিকারের কথা বলে যুদ্ধের রসদ জোগাতে ৯৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থ ছাড় নীতির দ্বৈততা ছাড়া কিছুই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ যুদ্ধ অর্থনীতি ও মানবাধিকারের মুখোশ উন্মোচনের জন্যই বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন মার্কিন বিমানবাহিনীর তরুণ কর্মকর্তা অ্যারন বুশনেল। ইসরায়েলি তাণ্ডব, বর্বরতা, হত্যাযজ্ঞ ও অমানবিক শিশু হত্যার মহাযজ্ঞে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও মানবাধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায্য নীরবতাকে মানতে পারেননি বুশনেল। তারপরও কি যুক্তরাষ্ট্রের মানবিকতা স্পর্শ করতে পেরেছিলেন বুশনেল? না পারেননি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৮ সাল থেকেই ইসরায়েলের এ অন্যায়কে সমর্থন করে আসছে। আর তারাই বিশ্বে প্রায় ২০০ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্যায্য হস্তক্ষেপ করে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের মানবাধিকার প্রতিবেদনে অন্যান্য দেশের গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা কিংবা পুলিশি নির্যাতনের কথা উল্লেখ করলেও নিজের দেশে এ বিষয়গুলোর যে কী বেহাল অবস্থা সে বিষয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ আমরা দেখতে পাই না। বিশেষ করে ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলছে তীব্র ছাত্র আন্দোলন। এতে যোগ দিয়েছেন ফিলিস্তিনে গণহত্যাবিরোধী শিক্ষকরাও। শুরুটা দেশটির একেবারে প্রথম কাতারের কুলীন বিশ্ববিদ্যালয় নামে খ্যাত নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফিলিস্তিনে মার্কিন মদদে গণহত্যা বন্ধ করার দাবিতে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস দখল করে সেখানে তাঁবু খাটিয়েছেন। সেই বিক্ষোভ দমনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশ ডাকার সিদ্ধান্ত নিলে এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক ওয়াক আউট করেন। পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে পুলিশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করে নিয়ে যায়। হার্ভার্ড, বোস্টন, এমআইটি, টেক্সাসসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই বিক্ষোভ দমনে আধাসামরিক বাহিনী তলব করার চিন্তা করছে। তাহলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করছে কারা? এতে কি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় না? আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৬৫৫টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে ১৪৮টি বন্দুক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা বিগত সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পাবলিক হেলথ এজেন্সি ঈউঈ (ঈবহঃবৎং ভড়ৎ উরংবধংব ঈড়হঃৎড়ষ ধহফ চৎবাবহঃরড়হ) এবং ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা এঁহ ঠরড়ষবহপব অৎপযরাব-এর তথ্য বলছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর গড়ে অন্তত ১০০০ জন লোক স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, গির্জা, মার্কেট কিংবা নিজ বাসভবনে বন্দুক হামলার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। গত বছরের শুরু থেকে জুলাই পর্যন্ত বন্দুক সহিংসতায় যুক্তরাষ্ট্রে ২৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ফয়সাল আরিফ বা রমিম উদ্দিনের হত্যার বিচার হওয়ার আগেই আমরা দেখলাম যুক্তরাষ্ট্র পুলিশ কীভাবে মায়ের সামনে নিজ ড্রইং রুমে উইন রোজারিও নামে আরেক বাংলাদেশি কিশোরকে গুলি করে হত্যা করে। যেখানে অন্য দেশের মানবাধিকার রক্ষার জন্য তারা গলা ফাটিয়ে ফেলছে সেখানে নিজ দেশে কেন তাদের মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ? ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস আন্দোলন কিংবা জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম হত্যায় এখনো যুক্তরাষ্ট্র পুলিশ অনুতপ্ত নয় বরং পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু কিংবা বন্দুকধারীর হামলায় হত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। গত ২৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাফেলো শহরে দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারা হলেন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার আবু সালেহ মো. ইউসুফ জনি (৫৩) এবং কুমিল্লার লাঙ্গলকোটের বাবুল মিয়া (৫০)। এর আগে ৭ এপ্রিল জাকির হোসেন খসরু নামে আরেক বাংলাদেশির ওপর হামলা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান ১০ এপ্রিল। গত ১২ এপ্রিল মিশিগান রাজ্যের ওয়ারেন সিটিতে নিজের বাড়িতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান হোসেন আলী রাজি নামে এক তরুণ। গত ২৭ মার্চ নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ১৯ বছর বয়সি বাংলাদেশি তরুণ উইন রোজারিও। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর আমেরিকার টেক্সাস শহরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আবির হোসেন নামে এক বাংলাদেশি নিহত হন। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের ডারবির ৬৯তম স্ট্রিটের মসজিদ আল মদিনার পার্কিং লটে বাংলাদেশি মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানকে (৬৫) গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের ফিনিক্স শহরের কাছে কাসা গ্রান্দে এলাকায় গুলিতে প্রাণ হারান কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আবুল হাশিম। ১৯ জুলাই দেশটির মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের সেন্টলুইস শহরের হ্যাম্পটন অ্যাভিনিউয়ে একটি গ্যাস স্টেশনে গুলি করে হত্যা করা হয় চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বাসিন্দা রমিম উদ্দিন আহমেদকে। গত বছরের ৪ জানুয়ারি ক্যামব্রিজে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থী সাইদ আরিফ ফয়সালকে গুলি করে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ। মানবাধিকার নিয়ে অন্যকে পরামর্শ দেয়া যুক্তরাষ্ট্র নিজ ভূখণ্ডে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে কেন? যেখানে বাংলাদেশের মানবাধিকার যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভয়াবহ নয়। প্রতিদিনই যেখানে কেউ না কেউ বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ হারাচ্ছেন, সেখানে তারা অন্যদের বলে শোনান বিচারবহির্ভূত হত্যার পাপ-পুণ্যের গল্প। কেন মার্কিন প্রশাসন নিজেদের বেলায় দায়সাড়া থাকেন। তারা কেন ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশি বর্বরতা ছড়িয়ে দেন, নিষ্পাপ নারী-শিশু হত্যায় কেন বিলিয়ন ডলারের বিল পাস করান, কেন কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন, রাজনৈতিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণ করেন। কারণ বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? তানজিব রহমান : হ লেখক ও গবেষক, ঢাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App