×

পাঠক ফোরাম

হৈমন্তী

মিথিলা ফারজানা

Icon

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

 মিথিলা ফারজানা
একটা জাত আছে। এরা নদীতে থাকে নৌকা কিংবা ট্রলার নিয়ে। জন্ম, বেড়ে ওঠা, বিয়ে, খাওয়া, ঘুম, মৃত্যু- সব হয় এদের নৌকায়। স্থানীয় ভাষায় আমরা বলি ‘ব্যাবাইজ্জা’। অরুচিকর ও অত্যাধিক বিরক্তিকর একটা শব্দ। সম্ভবত ‘বেদে’ শব্দের ধ্বনি বিপর্যয়ের মাধ্যমে এই শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। মাসফিকুরের প্রেম হলো সেই ব্যাবাইজ্জা সম্প্রদায়ের এক মেয়ের সঙ্গে। মেয়ের নাম হৈমন্তী। এ জাতের লোকজন আগের চেয়ে একটু উন্নত হয়েছে আজকাল। স্কুলে বাচ্চা-কাচ্চা পাঠায়। নিম্নস্তরের লোক হওয়ায় তাদের ভালো চোখে দেখে না কেউ। এরা খেটে জীবন পার করবে, নৌকায় যদি ভাগ্যক্রমে সুন্দরী যুবতী মেয়েলোক থাকে; তার দেহ নেবে উচ্চস্তরের পুরুষরা। রাতে আসবে, ভোগ করবে, আলো আসার আগে মিলিয়ে যাবে। যুবতীরা পেট বের করে শাড়ি পরে স্থলের পুরুষদের বিমোহিত করবে। এদের নাম হবে বিদঘুটে। এদের নাম কেন হৈমন্তী হবে? তুমুল সমস্যা হৈমন্তীর নামটা নিয়ে। আরো সমস্যা হৈমন্তী কেন স্কুলে পড়বে? স্কুল ওদের সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য না। মেয়েটা হাই স্কুল পাস করেছে। কলেজে ভর্তি হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার ইচ্ছা। ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা। কিন্তু বাধা হয় আমাদের সুশীল সমাজ। এহ, ব্যাবাইজ্জা সম্প্রদায়ের মেয়ে কেন উচ্চ মাধ্যমিক পড়বে? ও রোদে পুড়বে, মাছ ধরবে, নৌকায় ভেসে ভেসে রান্না করবে, পায়ে বৈঠা ঠেকিয়ে নৌকা চালাবে। ওর বিয়ে হবে ওর সম্প্রদায়ের কোনো ছেলের সঙ্গে। যে কিনা বছরের বেশির ভাগ সময় মাছ ধরবে। আর মাছের সংকটে গ্রামে-গঞ্জে নিম্নমানের চুড়ি, ফিতা কিংবা বাসন বেচবে। মাঝে মাঝে স্থল সম্প্রদায়ের ক্ষমতাসীন দলের লোক যাবে, ওকে ভোগ করবে। কথা গায়ে মাখেনি হৈমন্তী। চাল-চুলোহীন মেয়েদের সব কথা গায়ে নিতে নেই। কানাঘুষা হলো। স্থলের লোকদের কুনজর হৈমন্তীর শরীরে। কত ছেলে যে হৈমন্তীকে ভেবে হস্তমৈথুন করেছে তার ঠিক নেই। মধ্য দুপুরে একলা নারী পেয়ে কতই না চেষ্টা চালিয়েছিল কোনো ঝোপের আড়ালে নেয়ার। সম্ভব হয়নি। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি শিথিল হলেও এবার আরেক নতুন সংবাদ নিয়ে কথা শুরু হয়। চেয়ারম্যানের ছেলে মাসফিকুর নাকি হৈমন্তীকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে! কী লজ্জার ব্যাপার! সুদর্শন ছেলে, শিক্ষিত, উচ্চ জাত। সে কিনা ঘরে আনবে জাতহীন মেয়ে। লজ্জায় এলাকার লোকের মাথা কাটা যাচ্ছে একজনের কাছে অন্যজনের। তবুও আনিস চেয়ারম্যান চুপ। চায়ের দোকানে তিনি যান না। গেলেই শুনতে হয়, ‘চেয়ারম্যান সাহেব, আপনের পোলা নাকি ব্যাবাইজ্জা আনতে চায় ঘরে? এলাকায় কি মাইয়ার অভাব কন? ওই বেজাতের মাইয়া ক্যান আনব?’ চেয়ারম্যান উত্তর দেন না। বিড়ি ফুঁকে চলে আসেন। আসার পথে চ্যালারা বলে, ‘ভাই, মাসফিকুর বাবায় কামডা করল কী? যামু একটা ট্রলার লইয়া? ডুবাইয়া দেই?’ চেয়ারম্যান উত্তর দেন না। নিজ মনে কাজ করে যান, ঘুরে বেড়ান, সিগারেটে লম্বা সুখটান দেন। বৈশাখ মাস বোধ হয়। নদী উত্তাল। হৈমন্তী ওড়নার আড়ালে বই নিয়ে কলেজের করিডোরে দাঁড়িয়ে ভাবছে বৃষ্টির মাঝেই কি হাঁটা দেবে? বড়জোর ৩৪-৩৫ মিনিট লাগবে গন্তব্যে পৌঁছাতে। অথচ ঝড় থামার অপেক্ষা করলে লস হবে ১ ঘণ্টা। ৩৪-৩৫ মিনিটই ঢের শ্রেয় ভেবে হাঁটা ধরে সে। কালবৈশাখী! বেদে সম্প্রদায়ের মেয়ে হৈমন্তী, এসব ঝড়-টর তাদের গায়ে লাগে না। তবে আজ ঝড়ের বেগ প্রচণ্ড, বলা যায় না কখন কোন গাছের ডাল ভেঙে অক্কা পায়। তাই মনস্থির করে সামনেই মাধব রায়ের পোড়া ভিটে, সামান্য সময় দাঁড়িয়ে যাবে বরং। ভাবনা মোতাবেক হৈমন্তী রায়ের বাড়ির এক ভিটেয় দাঁড়াল। আগেও বহুবার এই একই জায়গায় তার আসা হয়েছিল। মাসফিকুরের সঙ্গে প্রেমালাপের তাগিদে। অথচ আজ গা ছমছমে। বোধহয় ঝড়ের প্রভাবে। ‘মাসফির উপস্থিতি আমাকে দুদণ্ড প্রশান্তি দিত’ আনমনেই ভেবে বসে হৈমন্তী। এই যাহ! বলে নিজেই লজ্জায় লাল হয়। টেলিপ্যাথি? নাকি সম্মোহন? মাসফিকুর দাঁড়িয়ে হৈমন্তীর সামনে! কেলেঙ্কারির সর্বোচ্চ সীমা যে ছাড়িয়ে যাচ্ছে...। লোক মুখে রসালো চর্চার প্রেম কাহিনি, এখন আবার একত্রিত দুজনেই। লোক দেখলে সর্বনাশ। সর্বনাশ! বলেই হৈমন্তীর চোখে একরাশ ভয় জমে গেলেও মাসফিকুরের চোখ-মুখ আগের মতোই উজ্জ্বল। জলে ভেজা যুবতী হৈমন্তী, ভেজা শরীর নিয়ে লজ্জা ও ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাসফিকুরের মুখোমুখি। মাসফিকুরের হাস্যোজ্জ্বল চোখ হৈমন্তীর চোখের পানে। অতি সাবধানে হৈমন্তীর হাত ধরে চোখে চোখ রাখে মাসফিকুর। আস্তে করে কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘জীবনানন্দকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলেন বনলতা সেন, আমায় সর্বশেষ শান্তি দিল এক বেদের মেয়ে। হৈমন্তী, আমার বুকে একবার হাত রাখবে? চোখে চোখ?’ এক নক্ষত্র সমান ক্লান্তি ও তৃষ্ণা নিয়ে চেয়ে আছে মাসফিকুর হৈমন্তীর চোখে। সে কী এক মায়া! ঝড় থেমেছে হৈমন্তী। তবে জলে যাও এবার? প্রেমিকা বিদায় দেয়ার মতো বিচ্ছিরি ঘটনা বোধহয় পৃথিবীতে নেই আর। একরাশ আকুতি নিয়ে হৈমন্তীর চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে মাসফিকুর। সব কিছু অস্পষ্ট, অন্ধকার। মাধব রায়ের বাড়ি ছাড়িয়ে হৈমন্তী চলে এসেছে বহুদূর। নিজের স্থানে এসে জল ঝরিয়ে পোশাক বদলে নিল। হৈমন্তীদের নৌকা ঘাটের কাছেই ছিল সে সন্ধ্যায়। ঝড়ের প্রকোপ রাতেও সামান্য হানা দিল। আলো নিভিয়ে যে যার মতো ঘুম। নৌকার দুয়ারে কড়া নাড়ছে। আঁতকে ওঠে হৈমন্তী। বিপদ! দুয়ারে কান পাতে, ফিসফিস শব্দে ভেসে আসে কিছু কথা, ‘আমার সর্বশেষ শান্তি তুমি হৈমন্তী, এ জলে বয়ে যায় আমার শরীরের অশরীরী ঘ্রাণ। অনুভব করবে কি?’ অতি সাবধানে দুয়ার খুলে অন্ধকার ব্যতীত কিছুই দেখেনি হৈমন্তী। এমনকি জলে ভেসে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত নিথর দেহটাও নয়। শুধু মৃদু বাতাসের অনুভূতি, শব্দহীন হারানোর শোক অনুভব করেছে হৈমন্তী। য় জমজম ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি অ্যান্ড ম্যাটস, বরিশাল

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App