×

শেষের পাতা

নারীর প্রতিবাদের ভাষা যখন রাত দখলের ডাক

Icon

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নারীর প্রতিবাদের ভাষা যখন রাত দখলের ডাক

কাগজ ডেস্ক : কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষোভে ফুঁসছে পশ্চিমবঙ্গ। দোষীদের শাস্তি এবং নারী নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ, সামিল হয়েছে অন্য দেশের নাগরিক সমাজও। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদ কর্মসূচি এখন শুধু দিনের বেলাতেই সীমাবদ্ধ নেই। প্রতিবাদের নতুন ভাষা হয়ে উঠছে রাতের রাস্তায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়া। সমাজকর্মীরা বলছেন, রাত কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তার লড়াইয়ে প্রতীক হয়ে উঠছে। গতকাল বুধবারও ‘রাত দখল’-এর ডাক দেয়া হয়।

আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই বারবার রাস্তায় নেমেছে নারী-পুরুষ, শিশু-প্রবীণ নির্বিশেষে। তবে প্রতিবাদ জানিয়ে গর্জে ওঠার ঘটনা এই রাজ্যে নজিরবিহীন নয়। কলেজ স্কোয়ার, ধর্মতলা, একাডেমি চত্বর বা অন্যান্য জায়গায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপুল জনতার জমায়েতও নতুন নয়। মিছিলে, সেøাগানে এর আগেও মুখর হয়েছে রাজপথ। কিন্তু তরুণী চিকিৎসককে হত্যা ও এরপর শুরু হওয়া এই আন্দোলন যেন একটা ভিন্ন দিক তুলে ধরেছে। যেখানে রাজনীতির ছোঁয়াচ বাঁচাতে মরিয়া মানুষ। মরিয়া প্রতিবাদের আগুন জ¦ালিয়ে রাখতেও। ঠিক সেই কারণেই গত রবিবার প্রতিবাদীদের সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় রাত জেগেছেন অঙ্কিতা পাল। যেমনটা জেগেছিলেন গত ১৪ আগস্ট ‘রাত দখলের কর্মসূচি’তে। তিনি বলেন, আমরা বিচার চাই। আরজি করের ঘটনায় অভিযুক্তদের সবার শাস্তি চাই। কিন্তু এই প্রতিবাদ তারপরও চলবে যতদিন না এই রেপ কালচার বন্ধ হয়, ধর্ষকরা ভয় পায়। লোকে বুঝতে পারে আমার সম্মতির অর্থ, আমার স্বাধীনতার অর্থ।

গত রবিবার শহরের একাধিক কর্মসূচির মধ্যে একটি ছিল ‘আমরা তিলোত্তমা’ নামক একটি মঞ্চের কর্মসূচি। ১ সেপ্টেম্বর দুপুরে কলেজ স্কোয়ার থেকে হেঁটে একটি মিছিল ধর্মতলায় আসে। কলকাতার শিল্পীদের ডাকা এই জমায়েতে সামিল হন সাধারণ মানুষ। মিছিল শেষে প্রশাসনের কাছে তাদের দাবি জানিয়ে প্রশাসনের জবাবের অপেক্ষায় রাসমণি এভিনিউয়ে তারা ধর্নায় বসেন। ধর্না চলে সকাল পর্যন্ত, যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সদুত্তর মেলেনি।

তৃণাঙ্কুর দাশ নামে এক কলেজ শিক্ষার্থীও ছিলেন ওই ধর্নায়। তিনি বলেন, এর আগে রাতের রাস্তায় মেয়েদের এমন নিশ্চিন্ত জমায়েত আগে দেখিনি। ১৪ আগস্ট রাত দখল আমাদের প্রথম সাহস জুটিয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে প্রতিবাদে রাত সামিল হচ্ছে। প্রতিবাদ কর্মসূচি কিন্তু এখন শুধু দিনেই আটকে নেই, রাতেও হচ্ছে।

গত কয়েক সপ্তাহে রাতে মেয়েদের জমায়েত, গণআদালতের ডাকসহ একাধিক কর্মসূচির সাক্ষী হয়েছে এই রাজ্য। গতকাল বুধবার আবার ‘রাত দখলের’ ডাক দেয়া হয়। আজ সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা সংক্রান্ত শুনানি হওয়ার কথা।

রাতের রাস্তায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়াই কী তাহলে প্রতিবাদের নতুন ভাষা হয়ে উঠছে? এ প্রসঙ্গে সমাজকর্মী শবনম হাসমি বিবিসি বাংলাকে বলেন, রাত কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তার লড়াইয়ে প্রতীক হয়ে উঠছে। কারণ সেই সময় রাস্তাঘাট জনশূন্য থাকে। শুধু রাস্তাই নয়, মেয়েদের সংখ্যা রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র কমতে থাকে। তিনি বলেন, মেয়েদের যে বারবার বলে দেয়া হয়, কখন, কোথায় থাকবে তার ওপরে নির্ভর করবে তোমার নিরাপত্তা। অর্থাৎ তার স্বাধীনতাকে নজরদারিতে রাখা হয়, নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু প্রশাসন বা অবকাঠামোগত উন্নতির মাধ্যমে সেটাকে কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটা দেখা হয় না।

শবনম হাসমি বলেন, গণপরিসরে যতক্ষণ নারী এবং প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি না, ততক্ষণ সমাজকে সুরক্ষিত পরিসর হিসেবে গড়ে তুলতে পারব না। সেজন্য শুধু একদিন রাস্তায় একদিন রাত জাগা নয়। দিনের পর দিন রাত জাগতে হবে, রাতের দখল আদায় করে নিতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাত দখল সত্যিই আস্তে আস্তে প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার ভাষা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একটা ক্ষোভের জায়গা থেকে প্রথমবার রাত দখল করতে রাস্তায় নেমেছিল মানুষ... যে তাদের আর কত দমিয়ে রাখা হবে! আজ সেটাই প্রতিবাদের ভাষা। তাই একের পর এক কর্মসূচি রাতে হচ্ছে।

রাতই যখন প্রতীক : চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পরপরই একটি বাংলা সংবাদমাধ্যমের জন্য কলম ধরেছিলেন শিক্ষিকা ও নারী অধিকারকর্মী শতাব্দী দাশ। ডাক দিয়েছিলেন মেয়েদের রাত দখলের। যদিও সেখানে দিনক্ষণের উল্লেখ ছিল না। রিমঝিম সিনহা, শতাব্দী দাশ এবং তাদের মতো আরো কয়েকজন সমবেত হয়ে সমাজমাধ্যমে সেই বার্তা দেন। তারপর ১৪ আগস্টের ছবিটি সবার জানা। ১৯৭৭ ইংল্যান্ডের লিডস্ শহরে ‘রিক্লেম দ্য নাইট’ আন্দোলনের মতোই নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে ওই রাতে রাস্তায় নামেন নারীরা। নেমেছিলেন পুরুষরাও।

শতাব্দী দাশ বলেন, রাত আর রাস্তা- এই দুটি টাইম (সময়) আর স্পেসকে (স্থান) বোঝাচ্ছে। এই যে কিছু সময় ও স্থান বেঁধে দিয়ে বলা হয় এই সময়ে এই জায়গায় তুমি সুরক্ষিত এর বাইরে তোমার দায়িত্ব নিচ্ছি না, এটা বন্ধ হওয়া দরকার। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা পিতৃতান্ত্রিক এবং সেখান থেকেই রাত দখলের ভাবনাটা এসেছিল।

রাত দখলের ডাকের এমন সাড়া পাবেন কল্পনা করেননি শতাব্দী দাশ বা অন্য আহ্বায়করা। রাতকে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নেয়ার অন্য একটা কারণও জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, একজন নারী তিনি রাতে হাসপাতালেই কর্মরত হন বা পার্টি করতেই যান, একজন নাগরিক হিসেবে তিনি সুরক্ষিত থাকবেন না কেন? আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা সমস্ত স্থান এবং কালকে রিক্লেম করছি সবার জন্য।

রাজনীতি নয় : আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর থেকেই যে আন্দোলন চলছে সেখানে আরো একটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো রাজনৈতিক ছোঁয়াচ থেকে দূরে থাকতে চাইছে প্রতিবাদী মঞ্চগুলো।

কলেজ শিক্ষার্থী মৈনাক দত্ত প্রথমবার যাদবপুরে রাত জেগেছিলেন। গত রবিবার রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে ধর্নায় সামিল হন। তিনি বলেন, রাজনীতি এলেই কিন্তু প্রতিবাদ তার দিশা হারিয়ে ফেলবে। আমরা বুঝতেও পারব না কখন পুরো বিষয়টাই হাত থেকে বেরিয়ে যাবে। তাই ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি এই প্রতিবাদের আগুনকে যে করে হোক বাঁচিয়ে রাখতে আর রাজনীতির রঙও লাগতে দেয়া যাবে না।

রাতের রাস্তায় প্রতিবাদের ঘটনা কী নজিরবিহীন : সমাজকর্মী শবনম হাসমি জানান, রাতের রাস্তায় এমন প্রতিবাদ এর আগেও ভারতে দেখা গেছে। ২০০৯ সালের দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের ম্যাঙ্গালোরের একটি পাবে উপস্থিত মেয়েদের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল। হামলাকারীদের যুক্তি ছিল পানশালায় উপস্থিত নারীরা ভারতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। এর প্রতিবাদে সেই সময় মেয়েরা রাতের রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন এটা বোঝাতে যে, তারা স্বাধীন। কিন্তু প্রতিবাদের তীব্রতা এতটা ছিল না।

শবনম হাসমি বলেন, কলকাতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে প্রতিবাদের ভাষা বেছে নিয়েছে আন্দোলনকারীরা, বিশেষত মেয়েরা, তা নজিরবিহীন। তবে দীর্ঘদিন ধরে কোনো আন্দোলন সঠিক পথে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং পশ্চিমবঙ্গে একাধিক ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি একসময় তীব্র আন্দোলন হয়েছে, আবার তা স্তিমিতও হয়েছে। তাই সামনের পথ সহজ নয়।

ধর্ষণবিরোধী বিল পাস, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড : সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ধর্ষণবিরোধী ‘অপরাজিতা’ বিল পাস করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। গত মঙ্গলবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের আনা ধর্ষণবিরোধী বিলটি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। এর মধ্যদিয়ে ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় আইনে প্রথম কোনো সংশোধন আনল রাজ্য সরকার।

‘অপরাজিতা নারী ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন ও সংশোধন) ২০২৪’ বিলটিতে ধর্ষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। যদি ধর্ষণ ও যৌন অপরাধের ফলে কোনো ভুক্তভোগীর মৃত্যু হয় তাহলে নতুন আইন অনুযায়ী ধর্ষণকারী ও যৌন নিপীড়নকারীর মৃত্যুদণ্ড হবে। এছাড়া নতুন বিলে ধর্ষণের জন্য দোষী সাব্যস্তদের প্যারল ছাড়াই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

বিধানসভায় বিলটি নিয়ে কথা বলার সময়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী দলের নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে রাজ্যের গভর্নর সিভি আনন্দ বোসকে বিলটিতে সম্মতি দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। এদিকে, বিজেপি এই বিলটিকে স্বাগত জানিয়েছে। নেতারা বলেছেন, ভারতীয় ন্যায় সংহিতাতেও (বিএনএস) নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য সমস্ত কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে

২ দপ্তরে নতুন সচিব, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের ডিজিকে ওএসডি

২ দপ্তরে নতুন সচিব, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের ডিজিকে ওএসডি

যোগসাজশে বোতলজাত পানির দাম বৃদ্ধি, ৭ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা

যোগসাজশে বোতলজাত পানির দাম বৃদ্ধি, ৭ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা

মেগা দুর্নীতি করে বাংলাদেশকে হোগলা করে ছেড়েছেন: মামুনুল হক

মেগা দুর্নীতি করে বাংলাদেশকে হোগলা করে ছেড়েছেন: মামুনুল হক

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App