সাইফুজ্জামান, আসাদুজ্জামান ও হারুনের সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কাগজ প্রতিবেদক : বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া এবং সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। গতকাল রবিবার দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
দুদক সূত্র জানায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৫ বছর ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সাল থেকে তার মালিকানাধীন কোম্পানি প্রায় ২০ কোটি ব্রিটিশ পাউন্ড (২৭৭০ কোটি টাকা) মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি কিনে যুক্তরাজ্যে রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। যুক্তরাজ্যের কোম্পানি হাউস করপোরেট অ্যাকাউন্ট, বন্ধকি চার্জ এবং এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে এ পরিসংখ্যান পেয়েছে বার্তা সংস্থা ব্লæমবার্গ। ওই প্রতিবেদনের বরাতে দুদকে অভিযোগ দাখিল এবং পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে রিট হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দুদক থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। দুদকের অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচারের টাকায় গড়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কিনেছেন ফ্ল্যাট। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রে তিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ৯টি ফ্ল্যাট। সাইফুজ্জামান ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার শুরু করেন। দেশটিতে নাহার ম্যানেজমেন্ট ইনকরপোরেটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন তিনি। ২০০৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময় এ প্রতিষ্ঠানের নামে ৯টি প্লট বা ফ্ল্যাট কেনেন।
সাইফুজ্জামান সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবসা করার জন্য র?্যাপিড র?্যাপ্টর এফজিই নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। পরের বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি ভবন নির্মাণ ও নির্মাণসামগ্রী বিক্রির জন্য জেবা ট্রেডিং এফজিই নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এছাড়া গত বছরের শেষ দিকে তার স্ত্রী রুখমিলা জামান চৌধুরীর নামে আল-বারশা সাউথ-থার্ড এলাকায় কিউ গার্ডেন্স বুটিক রেসিডেন্স ব্লক বিতে দুটি ফ্ল্যাট কেনা হয়। এর মধ্যে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ১১ লাখ ২৫ হাজার ৩০০ দিরহামে একটি এবং ৩০ নভেম্বর ১১ লাখ ২৫ হাজার ৬৯ দিরহামে অপর ফ্ল্যাটটি কেনা হয়। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে দুবাই ইসলামী ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এছাড়া দেশটির ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংকে একটি দিরহাম ও একটি ডলার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আর দেশটিতে কার্যরত জনতা ব্যাংকে রয়েছে একটি দিরহাম অ্যাকাউন্ট। সব মিলিয়ে এসব অ্যাকাউন্টে ৩৯ হাজার ৫৮৩ দিরহাম এবং ৬ হাজার ৬৭০ ডলার জমা আছে।
লন্ডনেও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ৮টি কোম্পানি রয়েছে, যার বাজারমূল্য ২০ কোটি ৩১ লাখ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। দেশটিতে তার স্ত্রী রুখমিলা জামান ও মেয়ে জেবা জামানের নামেও কোম্পানি রয়েছে। এছাড়া পারিবারিক মালিকানায় থাকা ব্যবসায়িক গ্রুপ আরামিটের নামে একটি কোম্পানি রয়েছে বলে জানা যায়।
এদিকে, গত ২৭ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের দাবি জানিয়ে দুদকে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। ওই আবেদনসহ আরো বেশকিছু অভিযোগ জমা হয় দুদকে। যা যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অভিযোগে বলা হয়, আসাদুজ্জামান নিজ নামে, স্ত্রী আফরোজা জামান ও তিন সন্তান আসিফ শাহাদাত, আয়েশা সিদ্দিকা, আসিফ মাহাদীন এবং শ্যালক-শ্যালিকা, ভাগনেসহ আরো অনেকের নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। এর মধ্যে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ভাঙ্গা হাইওয়ের পাশে এবং রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকাসহ আফতাবনগর, মোহাম্মদপুর, জোয়ার সাহারা, সাভার ও পূর্বাচলে তাদের জমি, প্লট ও বাড়ির ছড়াছড়ি। সম্পদের মধ্যে আসাদুজ্জামান মিয়ার নামে সাড়ে ৭ কাঠা, আফতাবনগরে ৬ কাঠা, পুলিশ হাউজিংয়ে ৬ দশমিক ৯ কাঠা, পূর্বাচল ১৪ নম্বর সেক্টরে ৩ কাঠা, পূর্বাচল ৮ নম্বর সেক্টরের ১০৮ নম্বর রোডে ৫ কাঠা ও সাভারে ২
হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় তার নামে ৩২২ শতাংশ, ৬৮ ও ২১৫ শতাংশ, ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ৮ শতাংশ জমি আছে। ফরিদপুরের গ্রামে আছে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি। তার বড় ছেলে আসিফ শাহাদাতের বয়স ৩৫ বছর। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার বয়স ৩১ বছর। ২১ বছর বয়সি ছোট ছেলে আসিফ মাহাদীন আমেরিকায় পড়াশোনা করেন। এই তিন ভাই-বোন অল্প বয়সেই শত কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
আসাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামান গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও তার সম্পদের অভাব নেই। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় তার নামে একাধিক দামি ফ্ল্যাট, প্লট, ৫০ কোটি টাকা দামের আলিশান বাড়ি এবং গাজীপুরের কালীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে কোটি কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ কিশোরগঞ্জে নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’। জেলার মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে ৪০ একরেরও বেশি জায়গা নিয়ে বিলাসবহুল রিসোর্টটি তৈরি করা হয়। রিসোর্টের প্রিমিয়াম স্যুটের প্রতিদিনের ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন ডিলাক্স রুমের ভাড়া প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা। রিসোর্টটিতে শত কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে ধারণা স্থানীয়দের। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রিসোর্টটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। পুলিশের আলোচিত-সমালোচিত কর্মকর্তা হারুনের প্রতিষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার ছোট ভাই ডা. শাহরিয়ার। তিনি হলি ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেন। রিসোর্টটিতে হারুনের পরিবারের ৫ থেকে ৭ একর জায়গা রয়েছে। বাকি অন্তত ৩৫ একর জায়গা ছিল অন্যদের। অন্য জমির মালিকদের দাম দেবেন বলে হারুন রিসোর্টের জন্য জায়গা দখলে নেন। তবে কেউই জমির দাম পুরোটা পাননি। জায়গার দাম না পাওয়ায় এখনো অন্তত ১০ থেকে ১২ জন তাদের জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি।
মূলত গাজীপুরের এসপি থাকাকালীন কপাল খুলে যায় হারুনের। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের এসপি থাকার সময় থেকেই হারুন তার পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে বাড়ির পাশের হাওরে জমি কিনতে শুরু করেন। নামে-বেনামে তার কমপক্ষে ১০০ একর জমি রয়েছে। সেই সঙ্গে শতাধিক একর অন্যের জমিও দখল করেছেন। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রেও হারুনের শত শত কোটি টাকার সম্পদ থাকার অভিযোগ রয়েছে।