রাজারবাগে তোপের মুখে আইজিপি কর্মস্থলে ফেরেনি অনেক পুলিশ
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজিজুর রহমান জিদনী : নিরাপত্তাহীনতায় দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্ব স্ব পুলিশ লাইন্স, দপ্তর, পিওএম ও ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছিল পুলিশ সদরদপ্তর। কেউ কেউ সেই নির্দেশনায় সাড়া দিলেও প্রাণহানি ও হামলার শঙ্কায় বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য এখনো কাজে ফেরেননি। গতকাল বৃহস্পতিবার সরজমিন ডিএমপি সদর দপ্তর, ডিবি কার্যালয় ও কয়েকটি থানা ঘুরে এমনই দৃশ্য দেখা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিভিন্ন স্থানে কাজে যোগ দিতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। এছাড়া তাদের ১১ দফা দাবি পূরণের বিষয়টিও রয়েছে। যদিও গতকাল পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সবার সহযোগিতায় কর্মস্থলে ফিরছে পুলিশ, বাধার তথ্য স্রেফ গুজব।
এদিকে গত বুধবার রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে গিয়ে বাহিনীর সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন নবনিযুক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম। এ সময় অধস্তনদের ছেড়ে যাওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবিলম্বে অপসারণেরও দাবি জানান পুলিশ সদস্যরা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের দিন ৫ অক্টোবর ঘটে ভয়াবহ ঘটনা। ওই দিন দেশের অন্তত শতাধিক থানায় হামলা-ভাঙচুর হয়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশের কিছু সদস্য গুলি ছোড়েন। তাতে কয়েকটি থানায় ব্যাপক রক্তপাত হয়। রাজধানীর উত্তরা পূর্ব, যাত্রাবাড়ী থানাসহ বেশ কয়েকটি থানায় প্রাণহানি হয় সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্যদের। এমন বাস্তবতায় প্রাণহানি ও হামলার শঙ্কায় বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য গা ঢাকা দিতে বাধ্য হন। তবে চাকরির নিয়ম অনুযায়ী, এভাবে থাকার সুযোগ নেই তাদের।
এদিকে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের উচ্চ পদে হয়েছে ব্যাপক রদবদল। নতুন করে আইজিপি করা হয় মো. ময়নুল ইসলামকে। তিনি গত বুধবার নির্দেশনা দেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগদানের। এরপরও পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, সাবেক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অতি উৎসাহী কিছু পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছে। এতে হতাহত হয়েছেন অনেক আন্দোলনকারী ও সাধারণ মানুষ। তবে কর্মকর্তাদের দাবি- কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের একটা পর্যায় পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য তেমন সহিংসতায় জড়ায়নি পুলিশ।
গতকাল দুপুর ১টার দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকে সেনাবাহিনী ও স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রোটেকশন ব্যাটালিয়ন (এসপিবিএন) নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। কার্যালয়ে ডিবি সংশ্লিষ্ট ছাড়া আর কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তবে যারা সেখানে ঢুকছেন, সবাইকে পরিচয় নিশ্চিত করে প্রবেশ করতে হচ্ছে। সেখানে দায়িত্বে থাকা ডিবির এক সদস্য জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৮৫ জনের মতো ডিবি সদস্য কার্যালয়ে এসেছেন। যেখানে গত ৩ দিনে কাউকেই দেখা যায়নি। ডিএমপি সদর দপ্তরে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে সিভিল পোশাকে পুলিশের সদস্যরাই গেটে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। যারা ভেতরে প্রবেশ করছেন, তাদের ইউনিফর্ম ছাড়া সাধারণ পোশাকে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। তাদেরও গেটে পরিচয় নিশ্চিত করে ভেতরে যেতে হচ্ছে।
এদিকে ডিএমপির থানাগুলোও অনেকটা জনশূন্য। গতকাল বেলা ৩টার দিকে ডিএমপির রমনা মডেল থানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আনসার সদস্য ছাড়া কোনো পুলিশ সদস্য নেই। আনসাররা সেখানকার একটি কক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তারাই থানার নিরাপত্তা দিচ্ছেন। লালবাগ থানায় গিয়ে সেনাসদস্যদের দেখা গেলেও কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি। ভোরের কাগজের রাজশাহী প্রতিনিধি জানান, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশে ১২টি ও জেলায় ৯টি থানা রয়েছে। গতকাল সরজমিনে জেলা পর্যায়ের
দুয়েকটি থানায় কিছু পুলিশ সদস্য দেখা গেলেও অধিকাংশই ছিল খালি। মেট্রোপলিটন এলাকার থানাগুলোতে আনসার সদস্যরা রয়েছে। অন্য বিভাগ ও জেলার থানাগুলোতেও ছিল একই অবস্থা।
কর্মস্থল যোগদান না করার অন্যতম কারণ হিসেবে জানা গেছে, প্রাণহানি ও হামলার শঙ্কায় রয়েছেন বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য। এছাড়া পুলিশের অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংস্কার চেয়ে ১১ দফা দাবি জানিয়েছেন। এসব দাবিতে পুলিশ সদস্যরা উল্লেখ করেছেন, ওপরের নির্দেশনা মেনেই তাদের জনতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। তবে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সবাই তাদের ছেড়ে পালিয়েছেন। পুলিশকে যেন কোনো রাজনৈতিক সরকার তাদের কর্মী হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করার দাবিও রয়েছে তাদের।
এদিকে গত বুধবার দায়িত্ব নেয়ার পরই রাতে রাজারবাগ ছুটে যান আইজিপি ময়নুল ইসলাম। এ সময় তাকে বাহিনীর সদস্যদের তোপের মুখে পড়তে হয়। ভোরের কাগজের কাছে আসা একটি ভিডিওতে সার্জেন্ট পদমর্যাদার একজন নারী সদস্যকে নিরাপত্তার কথা বলে ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা যায়। বলতে শোনা যায়, ওপরের নির্দেশনা মেনেই তাদের জনতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। কিন্তু সেই কর্মকর্তারাই তাদের ছেড়ে পালিয়েছেন। প্রাণহানি ও হামলার শঙ্কায় রয়েছেন বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য। এর মধ্যে ওইসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরোপুরি নিশ্চিত না করে কেনো তাদের কাজে আসতে বলা হলো- প্রশ্ন তোলেন ওই পুলিশ সদস্য। অন্য সদস্যরাও পুলিশকে আর জনগণের মুখোমুখি করা হবে না- এমন নিশ্চয়তা চান।
অন্যদিকে, গতকাল বিকালে পুলিশ সদর দপ্তরে বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা আইজিপির সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ৮ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়- যারা সবার সঙ্গে আলোচনা করে নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া, আহত পুলিশ সদস্যদের সুচিকিৎসা ও তাদের প্রস্তাবসমূহ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন কল্পে সুপারিশ দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।