স্থিরতা আনতে গুরুত্ব দিতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যে
সহিংসতায় ট্রমায় ভুগছেন অনেকে
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সেবিকা দেবনাথ : রামপুরা এলাকার বাসিন্দা শিক্ষক দম্পতি রাকিবুল ইসলাম ও জাহানারা সুরভী। ছোট্ট ফ্ল্যাটের ছিমছাম এই দম্পতির সংসারে আছে সাড়ে চার বছরের ছেলে সৌরভ। জোরে কোনো শব্দ হলেই সৌরভ দৌঁড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। মুখ লুকিয়ে বলতে থাকে, ‘মা গুলি, মা গুলি’। ঘুমের মধ্যেও সৌরভ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। ভোরের কাগজকে সুরভী বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকার যে কয়েকটি স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে, রামপুরা-বনশ্রী এলাকা তার অন্যতম। ওই গোলাগুলির শব্দে আমার ছেলেটা খুব ভয় পেয়েছে। এখন জোরে কোনো শব্দ হলে সৌরভ আঁৎকে উঠে। ঘুমের মধ্যেও কান্না করে। আগে সারাক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ির চলাচল দেখত। আর এখন ওর জন্য জানালা খোলাই যায় না। জানালা খুললেই কান্না করছে।
১৮ জুলাই রামপুরা এলাকায় কমপ্লিট শাটডাউনের খবর সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন ডিবিসি নিউজের রিপোর্টার ফারহানা যুঁথী। সেদিনের বিভৎস দৃশ্য মনে করে এখনো শিউড়ে উঠেন তিনি। নিজেও টিয়ার শেলের আঘাতে আহত হয়েছেন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় যুঁথী বলেন, রামপুরা এলাকায় আমার ডিউটি ছিল। দেখলাম পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কয়েকজন ছেলে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে মেরে হাত-পা ভেঙে গলির মধ্যে টেনে নিয়ে আসে। লোকটার গায়ে কোনো কাপড় নেই। লোকটাকে তারা সবাই মিলে মারছে আর তার মাথা থেকে ঘিলু পড়ছে। তারা বলছিল, এমনভাবে মারব যাতে বেঁচে থাকলেও পালাতে না পারে। আমি তাদের অনেক আকুতি মিনতি করেছি। বলেছি, এভাবে মাইরেন না, তিনি তো মানুষ। কিন্তু আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি। আমার চোখের সামনে একজন মানুষকে নির্মমভাবে পিটিয়ে খুন করা হলো। আমি নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছি না। আর লোকটার মাথা থেকে ঘিলু বেরিয়ে আসার দৃশ্য এখনো আমি ভুলতে পারিনি। প্রায়ই আমি ঘুমাতে পারি না।
উত্তরার বাসিন্দা বিমল চন্দ্র সাহা (৫৭)। কাজ করেন গুলশানে অবস্থিত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ১৯ জুলাই সকালে অফিসের একটি কাজে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। দুপুরে বাসায় ফেরার সময় উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকার সহিংস ঘটনার সামনে পড়েন। স্বচক্ষে এত রক্তপাত দেখার পর থেকেই নিজের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছেন তিনি। বিমল
সাহা ভোরের কাগজকে বলেন, আমার এত বছরের জীবনে আমি কখনো এত রক্তপাত দেখিনি। এই দৃশ্য দেখার পর কোনো কিছুই খেতে পারছি না। এত দিন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গত কয়েকদিন ধরে ওষুধ খাওয়ার পরও উচ্চ রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত। দৃশ্যগুলো কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছি না।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সহিংসতার কারণে উচ্চ মাধ্যমিকের বেশ কয়েকটি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। ফলে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন গোপীবাগের বাসিন্দা পুলক মজুমদার। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, কতগুলো পরীক্ষা পিছিয়ে গেল। সেগুলো কবে হবে এরও ঠিক নেই। একটা বাড়তি চাপ অনুভব করছি।
পুলিশ সদস্য জাফর ভোরের কাগজকে বলেন, আমার চাকরি আছে আর মাত্র ৪ বছর। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও চাকরি করেছি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও চাকরি করছি। আমরা তো কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করি না। আমরা চাকরি করি। আমরা হুকুমের গোলাম। কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সহিংসতা, বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নানামুখী চাপের মধ্যে দিয়ে পুলিশ সদস্যদের কাজ করতে হয়। আমাদের কাজের ধরনটাই এমন। মাঝে মাঝে মনে হয় অনুভূতিগুলো সব মরে গেছে। আন্দোলন-বিক্ষোভ আমরা আরো অনেক দেখেছি। কিন্তু এবারের মতো এত ছোট ছোট বাচ্চাকে আন্দোলনের মাঠে নামতে দেখিনি। তাদের মধ্যে আগ্রাসী ভাবটাও বেশি ছিল। এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিবারসহ হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। এটাতো মানসিক চাপ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সৌরভ, যুঁথী, বিমল, পুলক, জাফরের মতো অনেকের মধ্যেই দেখা দিচ্ছে মানসিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, বিভিন্ন সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ অন্যান্য বিরূপ পরিস্থিতির প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী, সংবাদকর্মী, উদ্ধারকর্মী, চিকিৎসক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যেকেই মানসিক চাপের মধ্যে পড়েন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনার ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, কোনো সহিংস ঘটনা কিংবা বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষের মানসিক ট্রমা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। এটিকে আমরা বলে থাকি, ‘শেল শক সিনড্রোম’। এর মানে হচ্ছে কারোর উপর গুলি পড়েনি, আহত হননি কিন্তু শব্দটাই মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। সম্প্রতি আমরা যেটি দেখলাম, এ সময় শুধু গোলাগুলি হয়েছে, মানুষ নিহত-আহত হয়েছে তা নয়। মানুষের জিনিসপত্র পুড়েছে, সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। কারফিউ জারি হয়েছে, স্কুল ও পরীক্ষা বন্ধ হয়েছে। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। এসব কারণে সব পর্যায়ের মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে মানসিক চাপের মধ্যে পড়বে। যাকে বলা হয়, ‘তীব্র মানসিক চাপ’। এতে তাদের ঘুমের সমস্যা হবে। খেতে না পারার পাশাপাশি চিন্তা-ভাবনা খানিকটা এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। আচরণগত পরিবর্তনও হবে। এই সমস্যা বেশি দিন স্থায়ী হলে কারো কারো মধ্যে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেজ ডিজঅর্ডার বা পিটিএসডি’ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শিশু-কিশোর (৫ থেকে ১৪ বছর বয়সি) যাদের ব্যক্তিত্ব এখনো গড়ে উঠেনি তাদের মধ্যে এর প্রভাবটা দীর্ঘমেয়াদি হবে।
শিশু-কিশোরদের ওপর প্রভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টিভি ফুটেজে আমরা দেখেছি ঘটনার সময় অনেক শিশু-কিশোর রাস্তায় ছিল। কেউ সক্রিয়ভাবে থেকেছে, কেউ পথচারী হিসেবে দেখেছে, কেউ টিভিতে দেখেছে। যা তাদের মনের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। কারণ তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে এ ঘটনাগুলো প্রভাবকের ভূমিকা পালন করবে। কারো কারো ব্যক্তিত্বের মধ্যে ভয়, নিজেকে গুটিয়ে রাখা, আগ্রাসী হয়ে যাওয়া- এসব আচরণ পরিলক্ষিত হবে।
পরিত্রাণের উপায় হিসেবে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে তাদের মধ্যে সামাজিক দক্ষতা কম থাকবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ‘সেলফ হিলিং’ করা প্রয়োজন। সামাজিক সাপোর্ট বাড়াতে তাদের সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে হবে। একা থাকলে বিষয়গুলো নিয়ে তারা চিন্তা-ভাবনা বেশি করবে। তাই তাদের একা থাকতে দেয়া যাবে না। স্বাভাবিক কাজ-কর্মে বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে।