গাজীপুরের হাইটেক পার্কে হবে ‘বেস্ট’ প্রকল্প
দূষণ-স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে ‘ই-বর্জ্য’
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সেবিকা দেবনাথ : ‘নষ্ট মোবাইল, নষ্ট ল্যাপটপ, নষ্ট আইপিএস, নষ্ট টিভি থাকলে বেচতে পারেন-’ রাজধানীর অলি-গলিতে প্রায়ই হকারকে এসব কথা বলতে শোনা যায়। অনেকেই দরদাম করে ঘরের নষ্ট ইলেকট্রনিক পণ্য সেই হকারের কাছে বিক্রি করেন। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি খুবই সাধারণ। কিন্তু কয়েক হাত ঘুরে এই পণ্যই হয়ে উঠছে পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাতিল ইলেকট্রনিক যন্ত্র থেকে সৃষ্ট বর্জ্যকে বলা হয় ই-বর্জ্য। অর্থাৎ টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ক্যামেরা, এয়ারকন্ডিশনার, মাইক্রোওভেন, সিএফএল বাল্ব, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক খেলনা সামগ্রী ব্যবহারের পর যখন নষ্ট হয়ে যায় তখনই এটি বর্জ্যে পরিণত হয়। যা পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির নতুন এক আতঙ্ক। মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য এই ই-বর্জ্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দেশে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে এই বর্জ্যরে পরিমাণ।
এ প্রসঙ্গে গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ ভোরের কাগজকে বলেন, ই-বর্জ্যে রয়েছে মারাত্মক রেডিয়েশন, যা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক সামগ্রিতে থাকা উপাদান যেমন- ক্যাডমিয়াম, লিডঅক্সাইড, সিসা, কার্বন, সিলিকন, বেরিলিয়াম, ফাইবার গøাস, পারদসহ নানা ধাতব পদার্থ অন্যতম। পুরনো ইলেকট্রনিক সামগ্রী ভাঙারির দোকানে পৌঁছালে দোকানি সেগুলোকে রোদের তাপে শুকিয়ে নেয়। অনেকে সেগুলোকে দোকানে না রেখে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। বিপদটা ঘটে তখনই। রোদের তাপে ‘ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট’ থেকে মারাত্মক বিকিরণ নির্গত হতে থাকে। শুধু রোদেই নয়, এটি মাটির নিচে চাপা দিলে কিংবা পানিতে ফেলে দিলেও ক্ষতিকর বিকিরণ নির্গত হতে থাকে। এক চা-চামচ পরিমাণ পারদ ২০ একরের একটি জলাশয়ের পানি আজীবনের জন্য ব্যবহারের অনুপযোগী করে ফেলতে
পারে। আর যত্রতত্র ফেলে রাখার কারণে ই-বর্জ্যরে রেডিয়েশন রিসাইকেলের মাধ্যমে মানবদেহে দ্রুত প্রবেশ করে।
তথ্য বলছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, গত কয়েক বছরে গোটা বিশ্বের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা এশিয়ায়। কারণ বিশ্বে মোট ই-বর্জ্য সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় এশিয়ায়। বলা যায়, ই-বর্জ্য নিয়ে এক রকম বিপদেই আছে এশিয়ার দেশগুলো। ২০২০ সালে জাতিসংঘের প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে, ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে ৫২ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছিল। সেগুলোর মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ রিসাইকেল করা হয়। ২০১৯ সালে বিশ্বে যত ইলেকট্রনিক বর্জ্য তৈরি হয়েছিল; সেগুলোর ওজন ইউরোপের সমস্ত পূর্ণবয়স্ক মানুষের চেয়েও বেশি। আবার বর্জ্যগুলো এক সারিতে রাখলে তা ৭৫ মাইলের চেয়েও দীর্ঘ হতো। জাতিসংঘ সতর্ক করে জানিয়েছে ২০৩০ সালে বিশ্বে ই-বর্জ্য হবে ৭২ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন।
ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক জোট গেøাবাল ই-ওয়েস্ট স্ট্যাটিসটিকস পার্টনারশিপের (জিইএসপি) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি পাঁচ বছরে ই-বর্জ্য ২১ শতাংশ হারে বাড়ছে। বৈশ্বিক ই-ওয়েস্ট মনিটর প্রতিবেদন ২০২৪ অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে ৬২ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছে, যেটি পরিবহন করতে প্রায় সোয়া কোটি সংখ্যক ট্রাকের প্রয়োজন হবে। বেসরকারি এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে জাহাজভাঙা থেকেই উৎপাদন হচ্ছে ৮০ শতাংশ বর্জ্য, বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মোবাইলফোন সেট থেকে বেশি ই-বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ই-বর্জ্যরে ঝুঁকি কমাতে সরকার ২০২১ সালে ‘ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা’ তৈরি করলেও এর প্রয়োগ নেই। এ সমস্যা সমাধানের ভালো একটি উপায় রিসাইক্লিং। রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে অন্যান্য বর্জ্য সমস্যা যেভাবে সমাধান করা হয়, সেভাবেই ই-বর্জ্যর পরিমাণ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
বেসরকারি সংস্থা এনভাইরনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশনের (ইএসডিও) সেক্রেটারি জেনারেল ড. শাহরিয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ২০২১ সালে একটি আইন হয়েছে। এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। শুধু আইন করলেই হবে না। ব্যবস্থাপনার জন্য একটি গাইড লাইন দরকার। এই জায়গায় আমাদের দুর্বলতা আছে। এক্ষেত্রে সরকার এবং যারা ই-বর্জ্য রিসাইক্লিনিং করছে- এ দুটি পক্ষকেই বসতে হবে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ই-বর্জ্য প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (বেস্ট) প্রকল্পের অধীনে একটি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গাজীপুরে দেশের প্রথম ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট নির্মাণ হচ্ছে। পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বেস্ট প্রকল্পের কাজ চলমান। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পের চতুর্থ কম্পোনেন্টের অধীনে নির্মিত হবে এই প্ল্যান্ট। এজন্য প্রাথমিকভাবে ব্যয় হবে প্রায় ৩শ কোটি টাকা। গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে বলে জানা গেছে।
ই-বর্জ্য খাতকে প্রতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার সুপারিশ করেন ড. শাহরিয়ার হোসেন। তিনি বলেন, এই খাতটি এখনো অ-প্রাতিষ্ঠানিক খাতের অন্তর্ভুক্ত। পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। ই-বর্জ্য মানে ভারি ধাতব পদার্থ মনে করলেও আসলে কিন্তু তা নয়। এটি প্লাস্টিক দূষণও। ইএসডিওর গবেষণায় দেখা গেছে, প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া হচ্ছে ডাস্টবিনে। ফলে সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তাই ই-বর্জ্যকে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম একটি কারণ হিসেবে দেখা হয়। উন্মুক্ত জায়গায় ই-বর্জ্য পোড়ানো কিংবা অনিরাপদ ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। যারা এই কাজটি করছেন তারা এই কাজে দক্ষ নন। এর জন্য প্রকৃত অর্থে যে প্রযুক্তির দরকার সেটিও নেই। ফলে যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত তারা প্রতিনিয়ত ক্ষতির সুখে পড়ছেন এবং আশপাশের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
ই-বর্জ্য নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজের অভিজ্ঞাতা সম্পন্ন ড. শাহরিয়ার বলেন, দেশে যে পরিমাণ ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে সে পরিমাণ বর্জ্য রিসাইক্লিনিং করা যাচ্ছে না। সরকারের একার পক্ষে এটি করা সম্ভব নয়। সরকারি ও বেসরকারি পার্টনারশিপে যেতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ই-বর্জ্য শতভাগ রিসাইকেল হবে না। যেগুলো রিসাইকেল হবে না; সেই বর্জ্যগুলোর কী হবে সেটিও ভাবতে হবে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের অভাব এবং এর জন্য যে প্রযুক্তিগত দিকটি থাকা দরকার সেটিও আমাদের নেই। যা বড় চ্যালেঞ্জ।
পরিস্থিতি উত্তোরণ প্রসঙ্গে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এ বর্জ্য কমানোর উপর জোর দেন ড. শাহরিয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আগে আমাদের এই বর্জ্য কমাতে হবে। এর জন্য এসব পণ্যের স্থায়িত্ব বাড়াতে হবে। ন্যূনতম ৫ বছরের কম গ্যারান্টির কোনো পণ্য বিক্রি করা যাবে না। স্থায়িত্ব কম পণ্য আমদানি না করার উপরও জোর দিতে হবে। সরকার এই উদ্যোগ নিলে দেশে নতুন শিল্প গড়ার সুযোগ তৈরি হবে। আমদানি নির্ভরতা কমবে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হব। আর দেশে পণ্য উৎপাদন হলে সরকার তা সহজেই রেগুলেট করতে পারবে। যা আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ নিয়ে সমন্বয় জরুরি।
মানবদেহে ই-বর্জ্যরে ক্ষতিকর দিক প্রসঙ্গে প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এসব পণ্যের ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও রাসায়নিক মাটি, পানি ও বায়ুকে দূষিত করছে। ছড়াচ্ছে ক্ষতিকর রেডিয়েশন। যা পরিবেশের ক্ষতি করে। ফলে মাটি, গাছপালা, ফসল ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। সিসা ও পারদের মতো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ খোলা জায়গায় ফেলে রাখার কারণে মানুষের ত্বকের বিভিন্ন রোগ, কিডনি, ফুসফুস, হৃদযন্ত্র¿, স্নায়ুতন্ত্র, যকৃৎ, মায়েদের স্তন ও মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি করে। অটিজম ও মানসিক বিকাশ না হওয়ার একটি কারণও এটি। ই-বর্জ্য শিশুর মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলছে।