বিশিষ্টজনদের উদ্বেগ-নিন্দা
লালনভক্ত বৃদ্ধার ঘর ভাঙচুরে এনএইচআরসির সুয়োমটো
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কাগজ প্রতিবেদক : কুষ্টিয়ায় মসজিদে মাইকিং করে লালনভক্ত বৃদ্ধা চায়না বেগমের ঘর ভাঙচুরের ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগ (সুয়োমটো) নিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি)। গতকাল রবিবার গণমাধ্যমে পাঠানো সুয়োমটোতে উল্লেখ রয়েছে, মসজিদে মাইকিং করে ৯০ বছর বয়সি লালনভক্ত বৃদ্ধার ঘর ভাঙচুর এবং প্রতিবাদ করায় বৃদ্ধাকে মারধর করার অভিযোগটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এই ঘটনায় কুষ্টিয়া সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ অবস্থায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত ও আসামি গ্রেপ্তারের সর্বশেষ অগ্রগতি আগামী ৩০ জুলাইর মধ্যে কমিশনকে অবহিত করতে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারকে বলা হয়েছে।
এর আগে, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার টাকিমারা গ্রামের এ ঘটনায় সদর থানায় মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী বৃদ্ধা। এতে ওই এলাকার সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য এনামুল হক, মাতব্বর মোশারফ হোসেন, আনার মণ্ডল ও সাইদুল হাজির নাম উল্লেখসহ ৪৫-৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, গত বুধবার (২৬ জুন) সকাল ৬টার দিকে অভিযুক্তরা চায়না বেগমের বাড়িঘর ভাঙচুর করে লক্ষাধিক টাকার ক্ষতিসাধন করেছেন। এমনকি রাতের আঁধারে সেখানে তাকে পেলে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন অভিযুক্তরা। চায়না বেগম জানান, তার স্বামী আধ্যাত্মিক সাধক লালন সাঁইজির অনুসারী ছিলেন। জীবনের শেষ
দিনগুলো স্বামীর কবরে মাথা ঠেকিয়ে কাটিয়ে দেবেন বলে ভেবেছিলেন তিনি। লালনভক্ত এ বৃদ্ধা বলেন, আমার স্বামী মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, কোথাও জায়গা নাহলে তুমি আমার কবরের পাশেই থাকবা। প্রতি বছর বাতাসার সিন্নি হলেও করবা। তার কথা রাখতেই ঘরখানা তৈরি করি। কিন্তু এলাকার লোকজন আমাকে না জানিয়েই সব ভেঙে ফেলেছে। চায়না বেগমের বোন জামাই সাধু শাহাবুদ্দিন সাবু বলেন, আমাদের অপরাধটা কী? আমরা সাধু সমাজ কি নিজের জমিতেও আর থাকতে পারব না। আজকে সাধুর ঘর কেন ভাঙা হলো? সাধু সমাজকে কেন অপমান করা হলো? মসজিদে মাইকিং করে লোক জড়ো করে ঘর ভাঙা হয়েছে। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।
বিশিষ্টজনদের উদ্বেগ : অশীতিপর বৃদ্ধা চায়না বেগমের ওপর এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা। গতকাল রবিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা বলেন, সংস্কৃতি নির্ভরতায় বিকশিত স্বাধীন বাংলাদেশে লালন অনুসারীর বসতিতে হামলা ও নির্যাতনের ঘটনায় আমরা ব্যথিত ও বিক্ষুব্ধ।
টাকিমারা গ্রামের হামলার ঘটনাটি বাউল ঘরানার ওপর আক্রমণের প্রথম কোনো ঘটনা নয়। প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। সা¤প্রতিক স্বভাব কবি রাধাপদ সরকারের ওপর অমানবিক নির্যাতনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই চায়না বেগমের বসতিতে হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটল। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাউল শিল্পী ও নাট্যকর্মীর ওপর ধারাবাহিক হামলা-নির্যাতন, হেনস্তা, বাউলের বাদ্যযন্ত্র ও পাণ্ডুলিপিতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও বরাবরই রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে একদিকে সংস্কৃতিবিরোধী চরম ভাবাপন্ন মানসিকতার স¤প্রসারণ যেমন ঘটছে তেমনি সংস্কৃতি চর্চা ভীতিকর আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হচ্ছে।
তারা বলেন, এ ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেপ্তার না করে বরং কথিত ‘সুষ্ঠু সমাধান’-এর নামে উভয়পক্ষকে থানায় ডাকা হয়েছে। যা শুধু বিস্ময়করই নয়, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার এবং জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার-রক্ষণের পরিপন্থি। এ ধরনের অপরাধের ঘটনায় দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তারা।
বিবৃতিদাতারা হলেন- সুলতানা কামাল, রাশেদা কে. চৌধুরী, রামেন্দু মজুমদার, ডা. সারওয়ার আলী, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ডা. ফওজিয়া মোসলেম, খুশী কবির, কাজল দেবনাথ, অধ্যাপক এম এম আকাশ, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক ড. জোবায়দা নাসরিন, দীপায়ন খীসা প্রমুখ।