×

শেষের পাতা

হাল ছেড়ে দেয় থানা পুলিশ

ঢাকায় ছিনতাইয়ের ফোন ফেরত এলো ভারত থেকে

Icon

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকায় ছিনতাইয়ের ফোন ফেরত এলো ভারত থেকে
ইমরান রহমান : ছিনতাই কিংবা চুরি হওয়া দামি মোবাইল ফোন ভারতে পাচার হচ্ছে, আবার ভারতের চোরাই ফোন বাংলাদেশের বিভিন্ন শপিং মলে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। পুলিশ ভারতীয় নাগরিকসহ এই পাচার চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তারও করেছে। এটি বোঝা সহজ যে, দেশ বদল হলে সংশ্লিষ্ট দেশের পুলিশ আর মোবাইল ফোনটির হদিস পাবে না। ট্র্যাকিংয়ে ফোনের অবস্থান জানা গেলেও বাড়তি ঝামেলা এড়াতে তা ফেরত আনার পদক্ষেপও নেয়া হবে না। ফলে চোর চক্র পুলিশি ঝামেলা এড়াতে পাচারকেই বেছে নিয়েছে। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে ফেরদৌস মিয়ার ভাগ্যে। গত বছরের ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় তিনি রাজধানীর ধানমন্ডিতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান। সেখানে ডাক্তার দেখানো শেষে রাত পৌঁনে ৯টার দিকে ধানমন্ডি ৮ নম্বর রোডে এক আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছিলেন। তার হাতে ছিল জন্মদিনে প্রিয়জনের কাছ থেকে পাওয়া স্যামসাং এস-২৩ আল্ট্রা মডেলের ফোন। রাস্তায় যানজট থাকায় রিকশা কিছুটা ধীরে চলছিল। এক সময় বটগাছের নিচে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা পার হওয়ার সময় হেলমেট পরা দুজন মোটরসাইকেল আরোহীর একজন ছোঁ মেরে মোবাইল ফোনটি নিয়ে নেয়। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, পরিচিত কেউ দুষ্টুমি করছে। তবে পর মুহূর্তেই বুঝতে পারেন তার মোবাইল ফোনটি ছিনতাই হয়েছে। এ ঘটনায় হতভম্ব হয়ে যান ফেরদৌস মিয়া। অবাক চোখে ছিনতাইকারীদের চলে যেতে দেখেন, আর ভাবতে থাকেন- প্রিয়জনের কাছে কী জবাব দেবেন। ধানমন্ডি জোনের এক পুলিশ কর্মকর্তার পরামর্শে তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। একইসঙ্গে নিজেই ‘স্মার্ট থিংস ফাইন্ড ডিভাইস’ অ্যাপসের মাধ্যমে ছিনতাই হওয়া ফোনটির অবস্থান শনাক্ত করে খেয়াল রাখতে থাকেন। ছিনতাইয়ের পরের দিন ফোনটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর আর হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়- ফোন চালু হলে সেটি উদ্ধার হবে। তবুও মন মানছিল না তার। নিয়মিত লোকেশন দেখার চেষ্টা করেন, আর হতাশ হন। এভাবেই কিছুদিন কেটে যায়। হঠাৎ একদিন ফোনের ‘লোকেশন’ দেখতে পেয়ে চোখ কপালে ওঠে। দেশের সীমানা পেরিয়ে ফোনের অবস্থান দেখাচ্ছে ভারতের গুজরাট রাজ্যের আমরেলি শহরে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে বিষয়টি জানিয়ে বলেন- ফোন ফেরত আনা সম্ভব কিনা? বিষয়টি পরিচিতজনদেরও জানান। সবার একই জবাব- দামি ফোনগুলো ভারতে পাচার হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে কারোর কিছু করার থাকে না। বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না ফেরদৌস। কোনো উপায় না পেয়ে নিজেই কিছু করবেন বলে পণ করে বসেন। শুরুতে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেন- গুজরাট রাজ্যের প্রশাসন চালায় কারা? এক পর্যায়ে গুজরাটের স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ কমিশনার, পুলিশ সুপার, রাজ্য পুলিশের নোডাল অফিসার, দিল্লির হাইকমিশন ও ঢাকার হাইকমিশনের ইমেইল ঠিকানা জোগাড় করেন। পরে নিজের পরিচয়সহ ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে ফোনের লোকেশনের স্ক্রিনশট ও থানায় জিডির কপি সবাইকে পাঠিয়ে ফোনটি উদ্ধারের অনুরোধ জানান। ভেবেছিলেন- মেইল পাঠানো পর্যন্তই সান্ত¡না। ফোন আর ফেরত আসবে না। এখানেই সব প্রচেষ্টার সমাপ্তি। তবুও কোনো একটা জায়গা থেকে ফিরতি মেইল পাওয়ার আকাক্সক্ষায় ছিলেন তিনি। নিয়মিত মেইল চেক করে দেখেন। কিন্তু মেইলের জবাব আসে না। এভাবেই কেটে যায় আরো আড়াই মাসের বেশি। তখন ভাগ্যকে মেনে নেয়া ছাড়া আর উপায় হয়তো ছিল না। এরই মধ্যে গত ১ মার্চ একটি ভারতীয় নম্বর থেকে ফোন আসে- গুজরাটের আমরেলি থানা থেকে বলছি। আপনার জন্য একটি সুখবর আছে। আপনার হারিয়ে যাওয়া ফোনটি পাওয়া গেছে। এ কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়েন ফেরদৌস। কেউ মজা করছে? এমন প্রশ্নও মনে জাগে। পরে যখন কুরিয়ারের জন্য ঠিকানা চাওয়া হয়- তিনি বুঝতে পারেন, মজা নয়। ঠিকানার বিস্তারিত দেয়ার পর ফেরত আসে প্রিয়জনের কাছ থেকে উপহার পাওয়া শখের মোবাইল ফোনটি। এতক্ষণ যার কথা বলা হলো, সেই ফেরদৌস মিয়া দিনাজপুর জেলা কারাগারে ডেপুটি জেলার হিসেবে কর্মরত। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সঠিক চেষ্টা আর মনোবল নিয়ে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই- এই চিন্তা থেকেই বারবার হতাশ হলেও কখনো হাল ছাড়িনি। ফোনটি উদ্ধার করে ফেরত পাঠানোয় গুজরাট পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সেইসঙ্গে সবাইকে অনুরোধ জানাব- মোবাইল ফোন হারিয়ে গেলে যেন হাল ছেড়ে না দেন। কুরিয়ারে আসার পর মোবাইল ফোনটি যখন হাতে নিলেন তখন অনুভূতি কেমন ছিল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই ফোন দিয়েই আপনার সঙ্গে কথা বলছি। এর চেয়ে ভালো অনুভূতি আর কী হতে পারে? পাচার হওয়া ফোন উদ্ধারে পুলিশ কি নিরুপায় : ফোন পাচার হয়ে গেলে সেটি অন্য দেশের নেটওয়ার্কে ঢুকে যায়। ফলে পুলিশের ট্র্যাকিং সিস্টেমে সেটি আর শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। যদি ফেরদৌস মিয়ার মতো কেউ কোনো অ্যাপসের মাধ্যমে নিজের ফোনের লোকেশন শনাক্ত করে পুলিশকে দেয়, সেক্ষেত্রে পুলিশের করণীয় কী? জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের লিডার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, পাচার একটি আন্তঃদেশীয় অপরাধ। যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) শাখার সহযোগিতা নিয়ে উদ্ধারের সুযোগ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে মামলাটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি দেখতে হয়। অথচ আমাদের দেশে ফোন চুরি বা ছিনতাই হলে ভিকটিমরা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। যেগুলোর বিষয়ে সাধারণ তদন্ত হয়। অনেক সময় আমরা আনঅফিসিয়ালি চেষ্টা করে সেটি উদ্ধার করে দিই। কেউ যদি কোনো অ্যাপসের মাধ্যমে তার ফোনের লোকেশন অন্য দেশে আছে বলে শনাক্ত করে, তাহলে পুলিশ কী করতে পারে- এমন প্রশ্নে এডিসি নাজমুল হক বলেন, প্রতিদিন শত শত ফোন হারানোর জিডি হয়। পুলিশ সাধ্যমতো চেষ্টা করে সেগুলো উদ্ধার করে দিতে। এক্ষেত্রে দেশের মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর সহযোগিতা নেয়া হয়। যদি ফোন অন্য দেশে চলে যায় তাহলে আর আমাদের সিস্টেমে লোকেশন আসবে না। এক্ষেত্রে যদি কেউ অন্য কোনো অ্যাপসের মাধ্যমে লোকেশন শনাক্ত করে দেখায়, সেটি বিশ্বাস করাটাও আমাদের জন্য কঠিন। পাশাপাশি চোর চক্র ফোনের আইএমইআই পরিবর্তন করে ফেলছে। অনেক ফোনের ডিভাইস ট্র্যাকিংয়েও আসে না। এসব চ্যালেঞ্জ মেনেই পুলিশ সব সময় সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে ফোন উদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং প্রতিনিয়তই ফোন উদ্ধার করে ভিকটিমদের বুঝিয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ থামাতে পারে পাচার : সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, ফোনের পাচার ঠেকাতে সবার আগে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের একমত হতে হবে। এরপর দুই দেশই পাচারকারীদের গ্রেপ্তারে কঠোর অভিযান পরিচালনা করতে পারে। এর ফলে, পাচার চক্রগুলো না থাকলে আর এই প্রশ্নই সামনে আসবে না। তিনি বলেন, দুই দেশের ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে ফোন পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামতে পারে। সীমান্তের যেসব রুট দিয়ে ফোন পাচার হয় সেগুলো কড়াকড়ি করতে হবে। অভিযানে যে ফোনগুলো উদ্ধার হবে সেগুলো সঠিক মালিকের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। সঠিক মালিক না পেলে ফোনগুলো ধ্বংস করে ফেলতে হবে। যদিও এই কাজটি খুব সহজে দ্রুত সময়ের মধ্যে বন্ধ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App