জসীম আল ফাহিম
বন্ধুর পরিচয়
প্রকাশ: ০১ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
খড়ের ঘর। সেই ঘরের চালের ফাঁকে ইঁদুরের বাসা। বাসায় ইঁদুর আর ইঁদুরি শান্তিতে বসবাস করে। একসঙ্গে তারা খায়-দায়, ঘুমায়। আর খেলাধুলা করে। ইচ্ছা হলে সারাঘর বিচরণ করে। এ ঘর থেকে ও ঘরে যায়। ক্ষণে খাবার ঘরে যায়। ক্ষণে আবার রান্না ঘরে যায়। এদিক-ওদিক খাবার খুঁজে বেড়ায়। খাবার পেলে দুজন মিলে মজা করে খায়। আর না পেলে সরসর করে খাবারের আশায় শুধু ছুটেই বেড়ায়।
সেদিন ছুটতে ছুটতে দুজনই মালিকের হুলো বিড়ালটার সামনে গিয়ে পড়ল। হুলোকে দেখে তো ভয়ে ওদের শরীরের রক্ত একেবারে হিম হয়ে গেল। এই বুঝি ওটা ওদের ওপর হামলে পড়ে। কিন্তু না। হুলোটা তা করল না। বরং সে ওদের দিকে অত্যন্ত নিরীহভাবে তাকাল। ওর এভাবে তাকানো দেখে দুজনই যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল। ওদের দেখে হুলোটা কী বুঝে যেন মিটিমিটি হাসতে শুরু করল। ওর এমন বোকামো হাসি দেখে ইঁদুরেরাও সহসা হেসে ওঠল।
হাসি থামিয়ে ইঁদুরি বলল- হুলো মামা তোমার হাসিটা না খুব সুন্দর! হাসলে তোমাকে সত্যিই দারুণ লাগে!
ইঁদুরির মুখে নিজের প্রশংসা শুনে হুলোটা মনে মনে খুব খুশি হলো। বলল- তোকে অনেক ধন্যবাদ।
তখন ইঁদুরটা ভাবল, আমারও তো কিছু একটা বলা দরকার। কিছু একটা বলে হুলোটাকে খুশি করা দরকার। কী যে বলি এখন! ভাবতে লাগল বেচারা। পরে বলল- হুলো মামা তোমার লেজটাও না খুব সুন্দর। ঘন লোমে আবৃত। দেখতে কতই না সুন্দর লাগছে!
ইঁদুরটার মুখে নিজের প্রশংসা শুনে হুলোটা আরো বেশি খুশি হলো। বলল- তোকেও ধন্যবাদ।
পরে হুলোটা হাসি থামিয়ে বলল- আচ্ছা, তোরা কোথা থেকে এলি?
জবাবে ইঁদুরি বলল- এই তো আমাদের বাসা থেকে এলাম।
ইঁদুরটাও বলল- হ্যাঁ মামা। আমাদের বাসা থেকেই তো এসেছি।
তখন হুলোটা বলল- তোদের বাসাটা কোথায়?
জবাবে ইঁদুরি বলল- ঘরের চালের ফাঁকে।
ইঁদুরটা বলল- খড়ের চাল ফাঁক করে আমরা বড় যতœ করে বাসাটা বানিয়েছি হুলো মামা।
ওদের কথা শুনে হুলোটা বলল- তাই নাকি? খুব চমৎকার তো!
পরে একটু দম নিয়ে সে বলল- তোরা যখন আমাকে মামা ডেকেছিস, তাই তোদের সঙ্গে আমার দু-দুজন মায়ের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।
হুলোটার কথা শুনে ইঁদুরেরা একে অন্যের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। মনে হলো তারা হুলোর কথার মানে কিছুই বুঝেনি। অবাক হয়ে তারা ভাবছে, হুলোর তাহলে দু-দুজন মা রয়েছে।
তখন হুলোটা নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করল- কী রে আমার কথা বুঝতে তোদের কোনো সমস্যা হয়েছে?
অমনি ইঁদুরি বলল- জি মামা। আপনার কথা আমরা ঠিক বুঝিনি, কী বলেছেন আপনি।
তখন হুলোটা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলল- আমি বলেছি, তোরা তো আমাকে মামা ডেকেছিস, তাই না? এর মানে হলো তোরা দু-দুবার ‘মা’ বলেছিস। দু-দুবার মা বলে সম্বোধন করলে সম্পর্কটা নিশ্চয়ই গভীরতর হয়ে যায়। তাই আজ থেকে তোরা আমার ভাগ্নে হয়ে গেলি।
হুলোর এমন আন্তরিক কথাবার্তা শুনে নিমেষেই যেন ইঁদুর পরিবারের মনের সব ভয়-ডর দূর হয়ে গেল। তারা হুলোকে আরো জোরে জোরে মামা বলে ডাকতে শুরু করল। আর বলতে লাগল-
‘মামা ভাগ্নে যেখানে
বিপদ-আপদ নেই সেখানে।’
ওদের কথা শুনে হুলোটা বলল- বাহ্ চমৎকার ছড়া বলেছিস তো। খুব মজা পেলাম রে ভাগ্নেরা। পরে সে নিজেও একটা কবিতা আবৃত্তি করে ফেলল-
‘চিত্ত যেথায় ভয়শূন্য
উচ্চ সেথায় শির।’
ওর কবিতাটি শোনে ইঁদুর-ইঁদুরি ভারি অবাক হলো। ওরা ভাবতেই পারেনি, হুলো বিড়াল এমন চমৎকার একটা কবিতা বলতে পারে। ওরা হুলোকে অনেক বাহবা দিল। ওদের বাহবা পেয়ে হুলো বিড়ালের যেন আবেগ উথলে উঠল। সে বলল- এবার তাহলে একটা ছড়া শোনাই। ইঁদুর-বিড়ালের ছড়া। ছড়াটি আমি নিজেই তৈরি করেছি। আশা করি শুনতে তোদের ভালো লাগবে। বলে সে ছড়াটা বলতে শুরু করল-
‘বিড়ালেরা ইঁদুর খেলেও
আমার প্রিয় মাছ
মাছের কাঁটা খেতে মজা
খেয়ে করি নাচ।’
ওর ছড়াটা শুনে ইঁদুর ও ইঁদুরি খুবই মুগ্ধ হলো। মুগ্ধ কণ্ঠে ইঁদুরি জিজ্ঞেস করল, হুলো মামা তুমি নিরামিষি নাকি?
জবাবে হুলো বিড়াল বলল- না। মোটেই না।
তখন ইঁদুরটা বলল- তাহলে তুমি কি?
হুলো বিড়ালটা বলল- আমি হলাম তোদের বন্ধু। একজন ভালো বন্ধু। আমি তোদের খুব পছন্দ করি। তাই আমি তোদের কোনো ক্ষতি করতে পারব না। কথাটা বলে সে ঘরের বাইরে চলে এলো। ওর সঙ্গে ইঁদুর দুটোও এলো।
আর সে সময় একটি উড়ন্ত ঈগল পাখি উঠানের ওপর দিয়ে একবার গুইতি মেরে গেল। হয়তো সে দেখার চেষ্টা করল, নিচে কোনো শিকার আছে কিনা। শিকার ঠিকই তার চোখে পড়ল। পরে সে আরেকবার গুইতি দিয়ে এসে ইঁদুরটাকে ছোঁ মেরে ধরে শূন্যে উড়াল দিল। শূন্যের ওপর ইঁদুরটা খুব কান্নাকাটি করছিল। কিন্তু কোনো সুফল মিলল না। ঈগলটা ওকে ছাড়ল না।
নিচ থেকে ইঁদুরি হায় হায় করে উঠল। কিন্তু সে কিছুই করতে পারছিল না। তাই রীতিমতো বিলাপ শুরু করে দিল।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখে হুলো বিড়ালটাও হাহাকার করে ওঠল। কিন্তু ইঁদুরটার জন্য সেও কিছু করতে পারছিল না। পরে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ তার কী যেন মনে হলো। সে লাফিয়ে অদূরে উঁচু একটা শিমুল গাছের আগায় গিয়ে উঠে চুপটি করে বসে রইল। কিছু একটাকে আকস্মিক আক্রমণের জন্য বেচারা মনে মনে তৈরি হতে লাগল।
এদিকে আকাশের গায়ে কয়েকবার চক্কর দিয়ে ঈগলটি সেই উঁচু শিমুল গাছের ডালে এসে বসল। তারপর ইঁদুরটাকে খাওয়ার জন্য ঠোঁকর মারতে উদ্ধত হলো। কিন্তু পারল না। ওৎ পেতে থাকা হুলো বিড়ালটা সেই মুহূর্তে ওর ওপর এসে হামলে পড়ল। আকস্মিকভাবে হুলোটা ঈগলের ওপর হামলে পড়ায় সে রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তখনই ইঁদুরটা ওর থাবা থেকে ছুটে গেল। ঈগলের থাবা থেকে মুক্ত হয়ে ইঁদুরটা বড় একটা লাফ দিল। সেই লাফে শিমুল গাছের নিচে একটা ঝোপের ওপর এসে আছড়ে পড়ল বেচারা। তারপর প্রাণে বাঁচার জন্য ওই ঝোপটার ভেতরই আত্মগোপন করল সে।
এদিকে হুলো বিড়ালটাও কয়েক লাফে শিমুল গাছ থেকে নিচে নেমে এলো। নেমে দৌড়ে গিয়ে সেই খড়ের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। ততক্ষণে ইঁদুরটাও ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সেই খড়ের ঘরেই গিয়ে প্রবেশ করল। ইঁদুরটা অক্ষত অবস্থায় ফিরতে পারায় ইঁদুরি মনে দারুণ স্বস্তি ফিরে পেল।
হুলোটা ঘরের ভেতর ঢুকে কয়েকবার ম্যাঁও ম্যাঁও করে ডেকে উঠল। এর মানে হলো, ঈগলটা ওদের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। তাই তাদের বিজয় হয়েছে।
সে সময় ইঁদুর ও ইঁদুরি কৃতজ্ঞতায় হুলোর সামনে একেবারে শুয়ে পড়ল। হুলোটা ওদের দুজনকেই তুলে দাঁড় করাল। আর বলল- সব সময় সতর্ক হয়ে চলতে হয়। যারা সাবধানী তাদের কখনো ক্ষতি হয় না।