জানালেন নতুন চেয়ারম্যান
ইসলামী ব্যাংকের দেয়া অর্ধেকেরই বেশি ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কাগজ প্রতিবেদক : দেশের ব্যাংকিং খাতের মাফিয়া এস আলম গ্রুপ। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ‘জামায়াতমুক্ত’ করার নামে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় অভিনব কায়দায় চট্টগ্রামের এ ব্যবসায়ী গ্রুপটি ইসলামী ব্যাংক দখলে নেয়। এরপর নিয়ম না মেনেই ব্যাংকটির অর্থ লুটপাট করে এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের অর্ধেকের বেশি নামে-বেনামে এস আলম গ্রুপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ।
তিনি বলেন, ব্যাংকটি ঋণ হিসেবে যত অর্থ বিতরণ করেছে, তার অর্ধেকের বেশি টাকা একাই নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এসব ঋণের পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখন বের করা হচ্ছে। এস আলম গ্রুপের ঋণের বিপরীতে যেসব সম্পদ বন্ধক দেয়া আছে, তারও পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। কারণ এসব সম্পদের দাম বেশি দেখিয়ে ঋণ বের করা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে বন্ধক দেয়া হয়নি, এস আলম গ্রুপের এমন সম্পদের খোঁজ নিতে আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেয়া হচ্ছে বলে জানালেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, এসব সম্পদ খুঁজে পাওয়ার পর তা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করা হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ায় এখন ‘প্রাণ খুলে’ কথা বলতে পারছেন বলে মন্তব্য করেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ।
ইসলামী ব্যাংক এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার পর গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকটির নতুন পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভা হয়। সভা শেষে চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ব্যাংকের পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। চলতি বছরের জুন শেষে ইসলামী ব্যাংকের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা এস আলমের পকেটে আছে বলে ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ জানান। তিনি বলেন, নতুন বোর্ড দায়িত্ব নেয়ার সময় ২৩০০ কোটি টাকা শর্টে ছিল। তা প্রতিদিন কমে আসছে। আজকে কমে তা দুই হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আশা করি, এ বছরের মধ্যে ইতিবাচক ধারায় ফিরবে ব্যাংকটি। তিনি আরো বলেন, অনেক গ্রাহকের এতদিন টাকা তুলতে যে সমস্যা হয়েছে তা আজকের পর আর হবে না। কারণ গত এক সপ্তাহ যে পরিমাণ জমা হয়েছে তার চেয়ে বের হয়েছে কম। নিট ব্যালেন্স পজিটিভ।
গত ২২ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকে এবং ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকের এমডি ছিলেন তিনি।
ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির মোট ঋণের অর্ধেকের বেশি নিয়ে গেছে। তবে পুরো তথ্য পেতে, আরো এক সপ্তাহ সময় লাগবে। গ্রুপটি সম্পদ অতিমূল্যায়ন করে ঋণ বের করে নিয়েছে। ইতোমধ্যে গ্রুপটির সম্পদ নতুন করে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া ঋণের বিপরীতে যেসব জামানত রয়েছে তা দিয়ে কাভার হবে না। তাই জামানতের বাইরে যেসব সম্পদ রয়েছে তা বের করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর সোনালী ব্যাংকের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। হলমার্কের ঘটনা আলোচনায় আসার পরও সোনালী ব্যাংকে আমানত বেড়েছিল। ইসলামী ব্যাংকের সমস্যাটি অনেক বড়। এ জন্য আমরা দায়িত্ব নিয়েই পথনকশা প্রণয়ন করেছি। প্রতিদিন ব্যাংকে উপস্থিত থেকে তদারকির চেষ্টা করে যাচ্ছি। চলতি বছর পুরোটাই হবে গ্রাহকের আস্থা ফেরানোর বছর। সামনের বছরেও এ কাজ চলবে। ২০২৬-২৭ সাল হবে ঘুরে দাঁড়ানোর বছর। ২০২৮-৩০ সাল এগিয়ে যাওয়ার বছর’।
ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ২০২২ সাল থেকে ব্যাংকে তারল্য সংকট শুরু হয়। এখন ব্যাংকের গ্রাহক, প্রবাসী আয় পাঠানো গ্রাহক, শেয়ারধারী ও বিদেশি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কেউই ব্যাংকের ওপর আস্থা পাচ্ছেন না। এজন্য ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ে তিনটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা ব্যাংকের ঋণ, বিনিয়োগ ও মানবসম্পদের ওপর নিরীক্ষা করবে। আগে ভালো নিরীক্ষা হয়নি, তাই আজ ব্যাংকের এই পরিণতি।
অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ব্যাংকের টাকা ভিন্ন খাতে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নিচের দিকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তবে দুষ্ট কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নেয়া হবে। পরিস্থিতি উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহায়তা করবে বলেও জানান তিনি।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম। ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। নতুন চেয়ারম্যানের দেয়া হিসেব মতে, ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা একাই বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ।