লণ্ডভণ্ড সবকিছু, বন্যার্তরা এখন ঘর গোছানোর যুদ্ধে
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের এগারো জেলার নদনদীর পানি নেমে গেছে বিপৎসীমার নিচে। প্লাবিত এলাকা থেকে নামছে বন্যার পানি। জেগে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। বিধ্বস্ত বাড়িঘরে ফিরছেন নিরাপদ আশ্রয় নেয়া বানভাসিরা। সপ্তাখানেক বন্যার সঙ্গে জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ করে এখন শুরু হয়েছে তাদের ঘর গোছানোর যুদ্ধ। বাড়িঘরে ভিটেমাটি নেই। কারো ঘর নেই। যাদের ঘর আছে তা-ও লণ্ডভণ্ড। ঘরের জিনিসপত্র নেই। গবাদিপশু নেই। নেই কোনো খাবার। পুকুর-ডোবার মাছ, মুরগির খামার, দোকানপাট সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বানের পানি।
সরকারি হিসাবেই প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে বেসরকারি হিসাবে নিঃস্ব মানুষের সংখ্যা এক কোটির কাছাকাছি। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে। জলাবদ্ধতায় এখনো পানিবন্দি অনেকে। তাদের এখন খাবারের সংকট। সংকট বিশুদ্ধ পানির। সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। দুর্গম এলাকায় পৌঁছায় না ত্রাণসামগ্রী। এখনো খাবারের জন্য হাহাকার দুর্গতদের।
উজান থেকে নেমে আসা তীব্র ঢল এবং অতি ভারি বৃষ্টির কারণে গত ২০ আগস্ট থেকে দেশের উত্তর-পূর্ব, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে আকস্মিকভাবে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে তা বিস্তৃত হয় ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে। এই বন্যা এখন ডুবিয়ে মারছে রাঙ্গামাটি ও চাঁদপুর জেলাকেও। বানের জলে কেবল বাড়িঘরই ভাসিয়ে নেয়নি, কৃষিজমি, মাছের ঘের, পুকুর, ডোবা, মুরগির খামার, গরুর খামার সবকিছু তলিয়ে গেছে। এসবের ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে দীর্ঘ সময়।
আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে গিয়ে নিজের ঘরের চেহারা দেখে সবার হৃদয় তছনছ হয়ে গেছে। পানির তোড়ে নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় সবকিছু। তাই এখনো আশ্রয়কেন্দ্রেই কাটছে অনেকের দিন। যারা ছাড়ছেন, তারা ভাঙা ঘর মেরামতের কঠিন লড়াইয়ে নেমেছেন। এ লড়াই কবে শেষ হবে, তা-ও জানেন না কেউ। এ যেন এক অনিশ্চয়তাকে পেছনে ফেলে আরেক দুর্গম পথে পা বাড়ানো। আর এসব ক্ষতির পাশাপাশি রাস্তাঘাটও ভয়াবহভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। মানুষের জীবন প্রায় বিপন্ন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা গতকাল বুধবার জানিয়েছেন, বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও ১১ জেলার ১২ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৪টি পরিবার এখনো পানিবন্দি। আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৮ লাখ ২২ হাজার ৭৩৪ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটির কাছাকাছি। আর এই মানুষগুলোই হারিয়েছেন সর্বস্ব।
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার শিলুয়া গ্রামের বাসিন্দা ফারুক জানান, পানি কমার পর আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে গিয়ে দেখেন ঘর ভাঙা। মাটির ঘর একেবারে মিশে গেছে। এখন কীভাবে এই ঘর করবেন তা নিয়ে দিশাহারা। একই গ্রামের বাসিন্দা বেলাল হোসেন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঘরে ফিরে দেখেন, তার ঘর লণ্ডভণ্ড। ঘরে থাকার মতো অবস্থা নেই। তার ছোট মুরগির খামার ও পুকুরের সব মাছও ভেসে গেছে। সরকারের সহায়তার আশা করছেন তিনি। লেমুয়া আনিসুর রহমান পরিবারের সবাইকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলেন। বাড়িতে ফিরে দেখেন ঘর বিধ্বস্ত। এখন দুই মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে কোথায় উঠবেন, তা তার জানা নেই। ঘর মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও নেই তার কাছে।
দাগনভূঞা উপজেলার কামাল আতাতুর্ক উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে আয়েশা আক্তার বলেন, পানি নেমে যাওয়ায় বাড়িতে গিয়ে দেখেন ঘরের বেড়া ও মেঝে ভেঙে গেছে। হাতে টাকা-পয়সা নেই। কারো কাছ থেকে ধার করে ঘরের কাজ করবেন। এরপর বাড়িতে ফিরবেন। বন্যায় সবজিক্ষেত ভেসে গেছে ছাগলনাইয়া বাজারের পাশের বাসিন্দা দিনমজুর অজি উল্যাহর। তিনি ঋণ নিয়ে বর্গা জমিতে বেগুন ও পুঁইশাকের চাষ করেছিলেন। পানির তোড়ে ভেঙে গেছে ঘরের একাংশও। এখন ঋণ পরিশোধ আর ঘর ঠিক করার পাশাপাশি আগামী দিনে সংসারের খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।
বিপৎসীমার নিচে সব নদীর পানি : বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ভয়াবহ বন্যার দুর্যোগ কাটিয়ে নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে এসেছে। গতকাল বুধবার সকালে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের ১১৬টি স্টেশনের মধ্যে ৯টি পয়েন্টে পানি বাড়ার প্রবণতা দেখা গেলেও ১০১ পয়েন্টে কমছিল; আর অপরিবর্তিত ছিল ৬টি পয়েন্টে। ওই সময় দেশের কোনো নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছিল না।
গতকাল কেন্দ্রের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী জেলার সীমান্ত অঞ্চল এবং ভারতের ত্রিপুরায় উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি। ওই অঞ্চল এবং উজানের নদীর পানি কমছে।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে সেখানে বলা হয়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় এ অঞ্চলে এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। ফলে এ সময় মনু-খোয়াই, ফেনী, মুহুরি, গোমতী, তিতাস নদীর পানি কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময়ে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানেও ভারি বৃষ্টির আভাস নেই। ফলে সাঙ্গু, মাতামুহুরি, কর্ণফুলী, হালদা ও অন্যান্য প্রধান নদীর পানি কমতে পারে।
উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের লঘুচাপটি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাতের আভাস নেই। ফলে এ সময় এ অঞ্চলের নদীর পানি স্বাভাবিক প্রবাহ বিরাজ করতে পারে।
বুলেটিনে বলা হয়েছে, দেশের প্রধান নদনদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় গঙ্গা নদীর পানি উজানে ফারাক্কা পয়েন্টে অপরিবর্তিত আছে এবং দেশের অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী পাংখা পয়েন্টেও অপরিবর্তিত আছে। গঙ্গা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে, পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা এমনই থাকতে পারে।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, পদ্মা এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি কমছে, উত্তরাঞ্চলের তিস্তা-ধরলা- দুধকুমার নদীতে স্বাভাবিক প্রবাহ বিরাজ করছে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এ পরিস্থিতি থাকতে পারে বলে জানানো হয়েছে বুলেটিনে।