রাজপথে দাবির হিড়িক যানজটে ভোগান্তি
প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কাগজ প্রতিবেদক : অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একের পর এক দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে নেমেছে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধ করে চলছে অবস্থান কর্মসূচি। এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের অভিযোগ- গত ১৫ বছর চাকরি বা নিজ নিজ কর্মস্থলে পদোন্নতি ও চাকরি স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে তারা বঞ্চিত এবং বৈষম্যের শিকার হয়ে কাজ করেছেন। নতুন সরকারের কাছে নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে নানা দাবিসহ প্রস্তাব দিচ্ছেন তারা। দাবি আদায়ে লাগাতার কর্মসূচিও দেয়ার ঘোষণা এসেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবসান ঘটে টানা ১৫ বছরের বেশি সময় রাষ্ট্র পরিচালনা করা আওয়ামী লীগ সরকারের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করার পর ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর থেকেই বিভিন্ন গোষ্ঠী বিগত বছরগুলোয় বৈষম্যের শিকারের কথা উল্লেখ করে আন্দোলনে নামে। রাজধানীর প্রেস ক্লাব, শাহবাগ, সচিবালয়ের সামনের সড়ক, সাইন্সল্যাব মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় চলছে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি। এমনকী প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনেও অবস্থান নিতে দেখা গেছে কোনো কোনো সংগঠনকে। এদিকে গত রবিবার থেকে চালু হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। আর এর ফলে তীব্র যানজট তৈরি হয়েছে রাজধানীজুড়ে। গতকাল সোমবারও ফার্মগেট, বিজয় সরণি, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, সিদ্ধেশ্বরী, মতিঝিলসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে। রমনা ও মতিঝিলের আশপাশ এবং যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের সড়কেও যানজট দেখা যায়। মেট্রোরেল বন্ধ থাকায় জনভোগান্তি কয়েকগুণ বেড়েছে।
সচিবালয়ের সামনে গ্রাম পুলিশ সদস্যদের বিক্ষোভ : তিন দফা দাবিতে গতকাল সচিবালয়ের গেটের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন বাংলাদেশ গ্রাম পুলিশের সদস্যরা। এ সময় নিরাপত্তার কথা ভেবে সচিবালয়ের ভেতর থেকে ৩টি গেটই বন্ধ করে দেয়া হয়। লিখিত বক্তব্যে বৈষম্যবিরোধী গ্রাম পুলিশ সংগঠনের সভাপতি লাল মিয়া বলেন, আমরা ৪৭ হাজার গ্রাম পুলিশ সদস্য। ২০০৯ সালে আমাদের জাতীয় বেতন স্কেলের গেজেট হওয়া সত্ত্বেও আমরা সেই মোতাবেক বেতন পাচ্ছি না। আমাদের দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। দাবিগুলো হলো- চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করতে হবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালনা করতে হবে এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
জাতীয় মহিলা সংস্থা বাস্তবায়িত ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পে কর্মরত নারীরাও এদিন সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেন। তাদের দাবি- চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে চাকরি রাজস্ব খাতে নিতে হবে। এর আগে রবিবার তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন
রাজধানীর মৎস্য ভবনের গেটের সামনে সরাসরি নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন মৎস্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ইউনিয়ন প্রকল্পের কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের নেতারা।
বাংলাদেশ বেতারে বৈষম্য নিরসনের দাবিতে মানববন্ধন : পদোন্নতি বঞ্চনাসহ বিভিন্ন বৈষম্য নিরসনের দাবিতে গতকাল বেলা ১১টায় মানববন্ধন করেন বাংলাদেশ বেতারের শিল্পী, কলাকুশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের সামনে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। তাদের দাবিগুলো হলো- কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বঞ্চনার অবসান, ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতিসহ উপসচিব পদে ন্যায্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি নিশ্চিত, একীভূত বিসিএস (তথ্য) ক্যাডার বাস্তবায়ন, বাংলাদেশ বেতার থেকে নিজস্ব মহাপরিচালক নিয়োগ, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য প্রস্তাবিত নিয়োগবিধি বাতিলপূর্বক পুনঃসংশোধন এবং নিজস্ব শিল্পীদের পদ স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতির ব্যবস্থা নেয়া।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনে মানববন্ধন : করোনাকালে নানা অজুহাতে পদত্যাগে বাধ্য করা বা ছাঁটাইয়ের শিকার হওয়া ব্যাংক কর্মকর্তারা চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে বলা হয়, করোনাকালে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক তার কর্মীদের চাকরিচ্যুত বা পদত্যাগে বাধ্য করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায়ও তাদের পুনর্বহালের কথা বলা হয়। এ নিয়ে ব্যাংকারদের পক্ষে হাইকোর্টও রুল জারি করেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও হাইকোর্টের নির্দেশনার প্রায় ৩ বছর হলেও একজন ব্যাংকারকেও চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়নি। মানববন্ধন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে চিঠিও দেন তারা।
এইসএসসিতে অটো পাসের দাবিতে বিক্ষোভ : এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অটো পাসের দাবিতে গতকাল ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সামনে বিক্ষোভ করেন পরীক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, অনেক সহপাঠী পরীক্ষার্থী আন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হয়েছেন। তারা এখন চিকিৎসাধীন। তাছাড়া বিভিন্ন থানায় রাখা প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র পুড়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে তারা আর বাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষায় অংশ নিতে চান না।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, শিক্ষার্থীরা অটো পাস চাইছে। আমরা বোর্ডের চেয়ারম্যান বা কর্মকর্তারা তো এ সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো চিঠি আকারে আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা সেটাই বাস্তবায়ন করব।
বসুন্ধরা সিটির সামনে দোকান মালিকদের অবরোধ : রাজধানীর পান্থপথে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন বসুন্ধরা সিটির দোকান মালিক-কর্মচারীরা। মার্কেটের ইনচার্জের পদত্যাগ ও দোকানের ভাড়া কমানোসহ বিভিন্ন দাবি জানান তারা। দুপুর ২টা পর্যন্ত তাদের বিক্ষোভ চলে। এতে ওই এলাকায় তৈরি হয় ব্যাপক যানজট।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভিসা দেয়ার কথা বলে শ্যাডো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২ হাজার কোটি টাকার প্রতারণা করলেও মামলা নিচ্ছে না পল্লবী থানার ওসি। এমন অভিযোগ তুলে সচিবালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন ভুক্তভোগীরা। সব অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি ও টাকা ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার প্রতি অনুরোধ জানান তারা।
বিকালে সিদ্বেশ্বরী গার্লস স্কুলের দুজন শিক্ষকের পদত্যাগ দাবিতে শান্তিনগর মোড় অবরোধ করে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সেলিনা আক্তারের পদত্যাগ দাবিতে দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন স্কুলের শিক্ষার্থীরা।
শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সকাল থেকে অবস্থান নেন কমিউনিটি ক্লিনিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। তারা চাকরি রাজস্ব খাতে নেয়ার দাবি জানিয়ে এ কর্মসূচি পালন করেন।
ঢাকার অদূরে সাভারে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলসহ (ডিইপিজেড) অন্যান্য কারখানায় সমহারে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের দাবিতে গতকাল টানা তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। তারা ডিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আহসান কবীরের পদত্যাগও দাবি করেন। সকালে বিক্ষোভকারীরা ডিইপিজেডের নতুন ও পুরাতন জোনের প্রধান ফটক দুটিতে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের কারখানায় প্রবেশে বাধা দেন। পরে তারা নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট দেখা দেয়। ভোগান্তিতে পড়েন সড়কে চলাচলরত যাত্রী ও পথচারীরা। এমন খবর শিল্পাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে জিরানী, কবিরপুর, বাড়ইপাড়া, চক্রবর্তীসহ বেশ কয়েকটি এলাকার বেশির ভাগ কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।