বিদেশি কূটনীতিকদের ড. ইউনূস
পাঁচ সংস্কারের পর নির্বাচন
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
- শেখ হাসিনা সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছেন
- নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, নিরাপত্তা সংস্থা, গণমাধ্যম সংস্কারে গুরুত্ব
অন্তর্বর্তী সরকার একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করবে। তবে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা সংস্থা ও গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের পর। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল রবিবার ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের উদ্দেশে দেয়া এক বক্তৃতায় এসব কথা বলেন।
প্রসঙ্গত, গত ৮ আগস্ট সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের ১০ দিন পর বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের জন্য এ আয়োজন করা হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রায় ৫০ জন মিশনপ্রধান যোগ দেন। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
এর আগে পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কূটনীতিকরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আসতে থাকেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ব্রিফিং রুমে আসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় ব্রিফিং। প্রথমবার বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফিংয়ে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় বিপ্লব বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। ব্রিফিংয়ের শুরুতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার ত্যাগের কথা জানান।
এরপর বলেন, অপার সম্ভাবনার এই দেশ দুর্নীতির জন্য সামনে এগোতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার সামনে যাত্রা শুরু করতে চায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসনের বর্ণনা দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। তার স্বৈরশাসনে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে। বিচার বিভাগ ভেঙে পড়েছে। গণতান্ত্রিক সব অধিকার নিষ্পেষিত হয়েছে। তরুণদের কয়েকটি প্রজন্ম কোনোরকম ভোটাধিকার চর্চা ছাড়াই বড় হয়েছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংকগুলো লুট হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের ভাণ্ডার তছরুপ করা হয়েছে।
ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর সংস্কার করা দরকার। এক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ জানান।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বাংলাদেশে যে দূতাবাসগুলো আছে তার রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘের যেসব সংস্থার প্রধান এখানে আছেন তাদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি সবার পূর্ণ সমর্থন চেয়েছেন।
শফিকুল আলম বলেন, ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর থেকে তিনি সারাবিশ্ব থেকে প্রচুর মেসেজ (বার্তা) পাচ্ছেন, সবাই তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। তিনি সেজন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বাংলাদেশ পুনর্নির্মাণের জন্য তিনি তাদের পূর্ণ সমর্থন চেয়েছেন।
প্রেস সচিব আরো জানান, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন- এটা দ্বিতীয় বিপ্লব ছিল। এখানে এত মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল- তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে যদি প্রথম বিপ্লব হয়, এটা (২০২৪) দ্বিতীয় বিপ্লব। তার বার্তা ছিল দ্রুত অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা। তিনি নির্বাচনটি তখনই করবেন যখন প্রয়োজনীয় সংস্কার করা যায়। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা সংস্থা ও গণমাধ্যম-সব কিছুতে সংস্কার চিহ্নিত করে বাস্তবায়ন করে যত দ্রুত নির্বাচন দেয়া তার লক্ষ্য।
শফিকুল আলম জানান, প্রধান উপদেষ্টা কূটনীতিকদের জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে তার সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা। ড. মু. ইউনূসকে উদ্ধৃত করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্তে জাতিসংঘ তদন্ত দলকে স্বাগত জানিয়েছেন।
ছাত্র-জনতার প্রত্যাশার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ড. ইউনূস বলেন, তারা এমন এক বাংলাদেশ গড়তে সচেষ্ট, যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকবে, থাকবে বাক স্বাধীনতা, থাকবে মানবাধিকার। একই সঙ্গে জাতিগত নৃ-গোষ্ঠী, লৈঙ্গিক ও অন্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
গণমাধ্যম সংস্কার বিষয়ে ড. ইউনূস কূটনীতিকদের বলেন, শেখ হাসিনার সরকার মানুষের বাক স্বাধীনতা হরণ করতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ বিভিন্ন নির্বতনমূলক আইন করেছিল। এখন ছাত্র সমাজ ও জন-আকাক্সক্ষা ধারণ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে বলে জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই মুহূর্তে আর্থিক খাতে বড় অগ্রাধিকার হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক। আমরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। তবে কেউ বৈশ্বিক পোশাক সরবরাহ কাঠামো বিঘ্নিত করার চেষ্টা করলে তা কোনোভাবে সহ্য করা হবে না বলে স্পষ্ট বার্তা দেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি এমন সময় দায়িত্ব নিয়েছি যখন দেশের অনেক কিছু চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। শেখ হাসিনা দেশের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে গেছেন। বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘ দেড় দশকের নির্মম দপন-পীড়নে গণতান্ত্রিক অধিকার ভূলন্ঠিত হয়েছে।
শেখ হাসিার নেতৃত্বে কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, শেখ হাসিনার সময়ে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। তরুণ প্রজন্মকে ভোটাধিকার ছাড়াই বড় হতে হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বিদেশি কূটনীতিকদের জানান, গত ১৫ বছর সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে ব্যাংক লুট এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুণ্ঠন করা হয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা করে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা একটা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করতে যাচ্ছি। আমাদের বীর ছাত্র-জনতা দেশের আমূল পরিবর্তন চায়। এটি একটি কঠিন যাত্রা। এই যাত্রায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশীদারদের বাংলাদেশের প্রতি আস্থা অটুট রাখার আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ যত আন্তর্জাতিক চুক্তি করেছে, যত আইনি বাধ্যবাধকতা আছে সেগুলো মেনে চলা হবে। রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়াসহ মানবিক সাহায্য অব্যাহত রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান ড. ইউনূস। ব্রিফিং শেষে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কূটনীতিকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।