শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ
ট্রাইব্যুনালে ‘গণহত্যার’ বিচার
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ঘিরে সংঘটিত সহিংসতায় গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর জন্য নির্দেশদাতা হিসেবে সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এবং সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা মো. বুলবুল কবিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম গতকাল বুধবার আবেদনটি করেন। তদন্ত সংস্থা এ আবেদন গ্রহণও করেছে।
আবেদনে অভিযোগটি কমপ্লেন্ট রেজিস্ট্রারভুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের বিধান অনুযায়ী আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। জানতে চাইলে তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) আতাউর রহমান বিকালে গণমাধ্যমকে জানান, অভিযোগটি গ্রহণ করা হয়েছে। কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। অভিযোগ তদন্ত করা হবে। আবেদনে ঘটনার স্থান হিসেবে ‘সমগ্র বাংলাদেশ’ উল্লেখ করা হয়েছে। আর ঘটনার তারিখ ও সময় হিসেবে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত এবং ঘটনার তারিখে আহত হয়ে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন তারিখে নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।
অভিযোগকারীর আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বলেন, অভিযোগসংবলিত আবেদনটি গতকাল (বুধবার) দুপুরে তদন্ত সংস্থায় দাখিল করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায় তদন্ত সংস্থা এখন অভিযোগের তদন্ত করে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে জমা দেবেন। চিফ প্রসিকিউর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আকারে তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবেন। এর আগে তদন্ত চলাকালে তদন্ত কর্মকর্তা চিফ প্রসিকিউটরের মাধ্যমে আসামিদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারেন। তখনই এটি ট্রাইব্যুনালের মামলা হিসেবে লিপিবদ্ধ হবে।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ : আবেদনে আসামি হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা; সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের; সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল; সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক; সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং তৎকালীন সরকারের কিছু মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য; পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন; ঢাকা মহানগর ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ; ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য; র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ ও কিছু অসাধু র্যাব কর্মকর্তা, সদস্যসহ অজ্ঞাতনামা অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী এবং সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আবেদনে অপরাধের ধরনের বিষয়ে বলা হয়- ১ থেকে ৯ নম্বর আসামির নির্দেশে ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা দেশি ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচার গুলি করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে তাদের সমূল বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের মতো অপরাধ করেছে।
যা বললেন আইন উপদেষ্টা : এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে চলা সহিংসতায় গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর জন্য নির্দেশদাতা হিসেবে সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হতে পারে। যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্র্তীকালীন সরকার। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি। আসিফ নজরুল বলেন, গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে।
গণহত্যা ও গুলিবর্ষণ, এসব ঘটনার জন্য কিছু মামলা হয়েছে। রাজপথে থাকা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রশ্ন করেছে, এটাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিচার করার সুযোগ আছে কি না। তারা সেটি খতিয়ে দেখেছেন। তাতে তারা দেখেছেন, এই আইনের অধীনে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা, যারা আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব। আইন উপদেষ্টা বলেন, সাবেক সরকারের সরকারপ্রধান-সহ অন্য যারা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, যাদের আদেশ-নির্দেশ থাকার অভিযোগ রয়েছে, আমরা পত্রপত্রিকায় কিছু মন্ত্রীর নাম দেখেছি। আমরা এখানে কোনো ছাড় দেব না। আমরা বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদেরও যদি কমান্ড রেসপনসিবিলিটি থাকে, আমরা তাও পর্যন্ত খতিয়ে দেখব।
আরো দুই মামলা : এছাড়া রাজধানীর কাফরুলে কলেজ ছাত্র হত্যা ও রাজধানীর উত্তরা থেকে এক আইনজীবীকে অপহরণ করে গুম করার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরো দুটি মামলা নথিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। গতকাল বুধবার পৃথক দুটি আদালত দুটি মামলা নেয়ার আদেশ দেন। দুই মামলাতেই শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে আসামি করা হয়েছে। গতকালের পৃথক দুই মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৭ নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি আছেন ৬০০ জন। এ নিয়ে গত দুই দিনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ৩টি মামলা নেয়ার নির্দেশ দিল আদালত। পুলিশকে মামলা রেকর্ড করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট থানাপুলিশ এখনো নথি হাতে পায়নি বলে জানা গেছে। আদালতের আদেশের কাগজ হাতে পাওয়ার পর কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে ঢাকার সিএমএম আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. হেলাল উদ্দিন জানান, রাজধানীর কাফরুলে কলেজছাত্র ফয়জুল ইসলাম হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় মামলা রেকর্ড করার আদেশ দিয়েছেন সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট আহমদ হুমায়ুন কবির। এ খুনের মামলার বাদী হয়েছেন ভুক্তভোগীর ভাই রাজীব।
মামলায় বাদীর অভিযোগ, গত ১৯ জুলাই হত্যার উদ্দেশ্যে নির্বিচার গুলি চালিয়ে ফয়জুল ইসলামকে মিরপুর-১০ গোল চত্বরসংলগ্ন ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সামনে হত্যা করা হয়। সেদিন তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্রসমাজ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য মইনুল হোসেন খান নিখিল, ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এ মান্নান কচি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেজবাউল হক সাচ্চুু, সাবেক সংসদ সদস্য কামাল আহম্মেদ মজুমদার, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মানুন, অতিরিক্ত আইজিপি ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ, সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, স্থানীয় আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন, উত্তর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর জামাল মোস্তফা, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ নেতা সালামত উল্লাহ সাগর এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সদস্য দীপংকর বাছার। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ৫০০ থেকে ৬০০ নেতাকর্মীকে।
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবীকে অপহরণের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মামলা হিসেবে নিতে উত্তরা পশ্চিম থানাকে আদেশ দেন সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা শাকিল সুমু চৌধুরীর আদালত। সিএমএম আদালতের বেঞ্চ সহকারী রাকিব চৌধুরী বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ছাড়াও এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন- পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। এছাড়া মামলায় র্যাবের ২০-২৫ জন অজ্ঞাতপরিচয় সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ভুক্তভোগী সোহেল রানা দাবি করেছেন, ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে উত্তরা এলাকা থেকে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে আটক করা হয়। পরে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নানা নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।
এর আগে গত মঙ্গলবার পুলিশের গুলিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার মুদি দোকানি আবু সায়েদ নিহত হওয়ার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মামলা হিসেবে নিতে নির্দেশ দেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী এ আদেশ দেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। এছাড়া মামলায় র্যাবের ২০-২৫ জন অজ্ঞাতপরিচয় সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।