বাবাকে হারিয়ে ডুকরে কাঁদছে সারাহ
নৃশংসতায় স্তব্ধ পুলিশ গিয়াস উদ্দিনের স্বজন
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মরিয়ম সেঁজুতি : বাবাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না ৭ বছরের সারাহ। অথচ বাবা আসছে না ১০ দিন। এজন্য কারো সঙ্গে ঠিকভাবে কথাও বলে না সে। কেউ বাবার কথা জানতে চাইলেই চোখের কোণে ছলছল করে ওঠে পানি। নিজেকে লুকাতে বালিশে মাথা গুঁজে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। আবার কিছুক্ষণ নীরব থেকে মায়ের পাশে এসে বসে। স্কুলের বন্ধুরা তার বাবার মৃত্যুর কথা বলায় স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে অবুঝ এ শিশুটি। কিছুক্ষণ পর পর মা ও ভাইকে বলছে- বাবার কাছে ফোন দিতে, বাবার সঙ্গে সে কথা বলতে চায়। মেয়ের এ আবদারে মা জেসমিন সুলতানার বুকটা কষ্টে ফেটে গেলেও তিনি তা প্রকাশ করতে পারছেন না।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে সহিংসতায় রাজধানীর রায়েরবাগে গত ১৯ জুলাই শুক্রবার নৃশংসভাবে নিহত হন পুলিশ সদস্য গিয়াস উদ্দিন (৫৮)। তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের নায়েক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর ৭ মাস পর তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। স্বামীর মৃত্যুর কথা বলতে বলতে স্ত্রী জেসমিন সুলতানা বার বার কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, এত নৃশংসভাবে মানুষ মানুষকে কীভাবে
মারতে পারে? এত ভালো মানুষ ছিলেন তিনি, কখনো কারো ক্ষতি করেননি। এলাকায় তাকে সবাই খুব ভালো জানতেন। অথচ কতটা কষ্ট দিয়ে দিয়ে তাকে মেরেছে। চেহারাটাও ঠিকভাবে চেনা যাচ্ছিল না।
জেসমিন সুলতানা বলেন, আন্দোলনকারীদের ভয়ে আমার স্বামী বাসা থেকে পুলিশের পোশাক পরেনি। ব্যাগে পুলিশের পোশাক নিয়ে বের হয়েছিল। তারপরও ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচতে পারল না। মোটরসাইকেলে পুলিশ লেখা দেখে তাকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, আমাকে কখনো কোনো বিষয়ে চিন্তা করতে দেননি। কষ্ট পেতে দেননি যে মানুষটা, তিনি আজ সবকিছু ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন। আমি এখন তিন সন্তান নিয়ে কীভাবে চলব- বুঝতে পারছি না। আমি অবশ্যই এ নির্মমতার বিচার চাই।
জেসমিন বলেন, লাশ নিতে গেলে সেখানে লোকজন আমাদের সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করেছে। কাবুলি পাঞ্জাবি পড়া একজন বয়স্ক লোক বারবার বলেছে, পুলিশের বংশ শেষ করে দিতে হবে। শেখ হাসিনার সহযোগীদের নির্বংশ করতে হবে।
তিনি বলেন, আমার বড় ছেলে ঢাকা কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ছোট ছেলে জামিয়া ইসলামিয়া বায়তুন নূর মাদ্রাসায় চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ওরা আমার সঙ্গে ছিল। সেখানের লোকজন আমার ছেলেদের মারার জন্য তেড়ে আসে। আমরা কোনো রকম সেখান থেকে লাশ গাড়িতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসি। গ্রামে যাওয়ার পথে রাস্তায়ও আমাদের কয়েক জায়গায় আটকিয়ে ‘পুলিশ কি না’ জানতে চেয়েছে। সেখানে আমাদের মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বৈদ্যারবাজার ইউনিয়নের মনারবাগ গ্রামে মৃত আবদুর রহমান ও মা আম্বিয়া খাতুনের চার ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে সবার ছোট গিয়াস উদ্দিন। মাতুয়াইলে একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। জেসমিন বেগম জানান, ২০০৩ সাল থেকে গিয়াস উদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডিউটি পালন করতেন। তিনি বলেন, ঘটনার দিন রাতে ছেলেমেয়ে খুব করে বলে- আব্বু, বাইরে খুব ঝামেলা চলছে, ডিউটিতে না গেলে হয় না। স্যারদের বলো যাত্রাবাড়ী এলাকায় অনেক ঝামেলা হচ্ছে। মেয়ে সারাহ কোনোভাবেই কোল থেকে নামতে চাচ্ছিল না। বারবার বলছে, বাবা তুমি আজ যেও না। কিন্তু তিনি হাসিমুখে সন্তানদের বলছিলেন, সরকারি চাকরিতে এসব কথা বললে হয় না। আজকে দেশের খারাপ সময় যদি আমি বাসায় বসে থাকি, তাহলে কখন দেশের জন্য কাজ করব। তোমরা দোয়া করো, কিছুই হবে না। একথা বলে বের হয়ে যান।
রাজারবাগে পৌঁছেছেন কিনা খোঁজ নিতে ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফোন দেন জেসমিন। কিন্তু ফোন বন্ধ পেয়ে টেনশন করতে থাকেন। সারারাত কেউ না ঘুমিয়ে কাটান। ভোরে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য তৈরি হলে ২০ জুলাই ভোর ৫টায় পুলিশ পিএমও শাখা থেকে ফোন করে জানতে চাওয়া হয় গিয়াস কোথায়? এখনো রাজারবাগে এসে রিপোর্ট করেনি। তাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। এ কথা শুনে তখনই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন। বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও তাকে পাননি। পিএমও শাখা থেকে আবার জানানো হয়, যাত্রাবাড়ীতে খোঁজ নিতে। তখন তারা যাত্রাবাড়ী রায়েরবাগ ফুট ওভারব্রিজের নিচে লাশ দেখেন। মরদেহের পাশে রশি দিয়ে তার আইডি কার্ড ও দুটি ড্রাইভিং লাইসেন্স ঝুলিয়ে রাখে দুষ্কৃতকারীরা। এটা দেখেই লাশ শনাক্ত করে পরিবার।
হত্যার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাদা পোশাকে মধ্যবয়সি এক ব্যক্তিকে কদমতলী থানার দিকে যেতে দেখে সেখানে অবস্থানরত জামায়াত-শিবির কর্মীরা চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘ওই পুলিশ যাচ্ছে, ধর ধর ধর...।’ মুহূর্তেই শত শত মানুষ তাকে ধাওয়া দিয়ে ধরে ব্যাপক মারধর করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এরপরও থামেনি বর্বরতা। এক পর্যায়ে ওই পুলিশ সদস্যের দুই পা রশি দিয়ে বেঁধে শত শত মানুষের সামনে ওভারব্রিজের উপরে ঝুলানো হয়। ঝুলানোর সময় জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের চিৎকার করে উল্লাস করতে দেখা যায়। অথচ, তখনো মাথা নড়ছিল ওই পুলিশ সদস্যের। আর ঝুলানো দুই হাত বেয়ে টপ টপ করে রক্ত ঝরছিল। এ সময় উৎসুক জনতার মধ্যে ফিস ফিস করে কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, মানুষটা তো এখনো মরেনি, অথচ কী নৃশংসভাবে লোকটাকে ঝুলানো হলো। এরকম নৃশংসতা কখনো কাম্য নয়। এটা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। জাতীয় একটি দৈনিকের একজন সাংবাদিক এই ঘটনার একটি ছবি তুলতে গেলে জামায়াত-শিবির কর্মীরা তাকে বেদম মারধর করে, একই সঙ্গে তার ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে।