কোটাব্যবস্থা পুনর্বিবেচনায় ইতিবাচক ভাবনা সরকারে
জনদুর্ভোগ সৃষ্টির কর্মসূচি ঠেকাতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঝর্ণা মনি : কোটা পুনর্বহাল করে ৫ জুন হাইকোর্টের রায়ের পর থেকে আন্দোলন করে আসছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গত বুধবার হাইকোর্টের রায়ে আপিল বিভাগ চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারি করলেও সন্তুষ্ট হয়নি আন্দোলনকারীরা। আদালত নয়, নির্বাহী বিভাগ থেকেই সমাধান চায় তারা। পরদিন বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের রায়ের প্রকাশিত মূল অংশে বলা হয়, সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। এই অবস্থায় কোটা ইস্যুতে সমাধানটা কে দেবে, বিচার বিভাগ নাকি নির্বাহী বিভাগ- এই আলোচনা সামনে চলে আসে। বিশ্লেষকদের মতে, বল এখন সরকারের কোর্টে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কোটা পদ্ধতির সংস্কারে ইতিবাচক সরকারও। আদালতের নির্দেশনাকে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবতার নিরিখে কোটা সংস্কারের উদ্যোগ নেবে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারের একাধিক শীর্ষ ব্যক্তি ভোরের কাগজকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা একাধিকবার বলেছেন, আদালতে বিচারাধীন থাকায় সেখানেই কোটার বিষয়টি সমাধান হতে হবে। বিচারাধীন বিষয়ে সরকার কথা বলবে না। কিন্তু বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হাইকোর্টের আলোচিত রায়ের মূল অংশে বলা হয়েছে, সরকার প্রয়োজনে/চাইলে কোটা সংস্কার (কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন) করতে পারবে। কোটা পূরণ না হলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারবে। এ ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এক বৈঠকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। সূত্রমতে, সরকারও কোটাব্যবস্থায় সংস্কারের বিষয়ে ভাবছে। এ বিষয়ে সরকার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। এর পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশের পরও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখন আর স্বাভাবিকভাবে দেখছে না সরকার। ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা বলেছেন, কোটা বাতিলের নামে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির এই আন্দোলনে রাজনৈতিক ইন্ধন রয়েছে। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যেই কোটাবিরোধীদের সমর্থন দেয়ায় বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একজন মন্ত্রী ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ভোরের কাগজকে বলেন, কোটা থাকবে তবে সরকারও সংস্কার চায়। এ নিয়ে সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সুষ্ঠু সমাধান করবে। কোটাবিরোধী আন্দোলনকে আর সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। কারণ সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন উসকে দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, সর্বোচ্চ আদালতের ওই আদেশের পরদিনই হাইকোর্টের রায়ের মূল অংশ প্রকাশিত হওয়ায় ২০১৮ সালের আগের সব কোটা পুনর্বহালের আদেশের পাশাপাশি প্রয়োজনে সংস্কারে সরকারের সুযোগ তৈরি হল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি দলের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ভোরের কাগজকে বলেন, সময়ের সঙ্গে বাস্তবতার নিরিখেই এই সমস্যার সমাধান করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে কোনো ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের ঐকমত্য রয়েছে। কোটা সমস্যার অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত সুরাহা হবে।
আন্দোলন মোকাবিলায় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা : সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলছেন, ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে কর্মসূচি পালন করছে। এতে চরম জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার এত দিন ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। এখন
এই আন্দোলন মোকাবিলা ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। সরকারের জন্য শেষ কৌশল হলো কঠোর অবস্থানে যাওয়া। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এর পরও যদি কোটা আন্দোলনের ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা অনড় থাকে; তাহলে বুঝতে হবে তাদের পিছনে একটি রাজনৈতিক চক্র রয়েছে, যারা শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। আর এই কারণেই সরকার আগামীতে অবরোধের নামে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয় বা জনগণ ভোগান্তিতে পড়ে এ ধরনের কর্মসূচিগুলো করতে দেবে না। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশের মানুষের যৌক্তিক দাবির প্রতি সব সময় আন্তরিক আওয়ামী লীগ। তাহলে শিক্ষার্থীরা কার বিপক্ষে আন্দোলন করছে? সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশ তো তাদের পক্ষেই রয়েছে। এরপরও আন্দোলন করা মানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোনো গোষ্ঠী বা মহল আন্দোলনকে উসকানি দিচ্ছে।
স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রেতাত্মারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, যারা ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে, সেই প্রেতাত্মারা এরমধ্যে (কোটাবিরোধী আন্দোলন) কিছুটা হলেও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নয়- সেটি আমি অস্বীকার করতে পারব না। সরকারের দায়িত্ব জনগণের জানমাল রক্ষা করা। সুবিধা-অসুবিধা দেখা। এটি কেউ বাধাগ্রস্ত করলে সরকারকে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে।
আলোচনার ভিত্তিতে কোটাব্যবস্থার পুনর্বিবেচনা : দেশের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে কোটার সিদ্ধান্ত আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে পুনর্বিবেচনা হতে পারে বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এ ব্যাপারে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, বিগত ৫টি বিসিএসের ফল পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মধ্যে আবেদন করেছে ৫ শতাংশের মতো। আর রিটেনে পাস করেছে ২-৩ শতাংশের মতো। কাজেই সবক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীও পাওয়া যায় না। এসব পরিসংখ্যান দেখে কী পরিমাণ কোটা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বা নাতিদের জন্য রাখা যায়, সেটা সরকার নিশ্চয়ই পুনর্বিবেচনা করবে এবং এটা নিশ্চিত হতে হবে- এই সংখ্যাটি মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য থাকবে, সেখানে কাউকে নিয়োগ দেয়া সঠিক হবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব স্টেক হোল্ডার যারা- নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী, নারী আন্দোলন নেত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে দিতে পারে সরকার। একটি বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তির মাধ্যমে কোটাব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। এ ব্যাপারে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের পাশের দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কোটা প্রথার প্রচলন রয়েছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠী যারা রয়েছে, যেমন- মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী, প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা রাখার যৌক্তিকতা রয়েছে। এসব বিষয় আরো গভীরভাবে পর্যালোচনা প্রয়োজন। সরকারকে বুঝে-শুনে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।