কাগজ ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়াতে জো বাইডেনের ওপর চাপ বাড়তে থাকার মধ্যে ন্যাটো সম্মেলন শেষের সংবাদ সম্মেলনের দিকে নজর ছিল সবার। এই সংবাদ সম্মেলন ছিল বাইডেনের জন্য নিজের বয়স নিয়ে উদ্বেগ দূরে করে শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা প্রমাণের এক অগ্নিপরীক্ষা। আর সেই মঞ্চেই একের পর এক ভুল করে বসলেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলন শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে গুলিয়ে ফেলেন অশীতিপর এই প্রেসিডেন্ট। জেলেনস্কিকে মুখ ফসকে ‘পুতিন’ সম্বোধন করেন বাইডেন। শুধু তাই নয়, প্রতিদ্ব›দ্বী রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসও বানিয়ে বসেন। সংবাদ সম্মেলনে কমলা হ্যারিস সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার নামের জায়গায় ‘ট্রাম্প’ বলে ফেলেন বাইডেন।

কিন্তু এত ভুলের পরও বাইডেন নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকার ব্যাপারে অনড় অবস্থান প্রকাশ করেছেন। বয়স নিয়ে উদ্বেগ উপেক্ষা করে দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, তিনি নির্বাচনে লড়বেন। নিজেকে সুস্থ দাবি করে বাইডেন বলেন, আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে পরাজিত করার জন্য তিনিই সেরা প্রার্থী।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাতে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ৭৫তম সম্মেলন শেষে একক সংবাদ সম্মেলন করেন বাইডেন। এক ঘণ্টার এ সংবাদ সম্মেলনে তার রাজনৈতিক জীবন, পুনর্নির্বাচিত হওয়ার আশা, প্রেসিডেন্সি, পররাষ্ট্রনীতি, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ইস্যু ও গাজার যুদ্ধসহ নানা বিষয় উঠে আসে। সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ২৩ জন নেতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট ইউক্রেন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন বাইডেন। ইউক্রেনকে রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে সুরক্ষার গুরুত্ব নিয়ে তিনি কথা বলেন। এরপরই বক্তব্য রাখার জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ডাকার সময় বাইডেন ভুল করে তাকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ‘পুতিন’ নামে ডাকেন। বাইডেনকে বলতে শোনা যায়, আমি এবার মঞ্চ ছেড়ে দিতে চাই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে। যার আছে সাহস, আছে কিছু করে দেখানোর ইচ্ছা। ভদ্রমহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ, আমি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে স্বাগত জানাচ্ছি। অবশ্য পরক্ষণেই নিজেকে শুধরে নেন বাইডেন। বলেন, জেলেনস্কি পুতিনকে হারাবেন। পরিস্থিতি সামলাতে সাহায্য করেন জেলেনস্কিও। সাবেক এই কৌতুক অভিনেতা সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠেন, আমি পুতিনের চেয়ে ভালো।

এর পরেও বাইডেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আরো একবার মুখ ফসকান। তিনি বলেন, দেখুন, আমি ট্রাম্পকে ভাইস প্রেসিডেন্ট করতামই না, যদি তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য না হতেন।

বাইডেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের ওপর তার আস্থা আছে কিনা। এর জবাব দিতে গিয়ে বাইডেন ওই ভুল করেন।

স্বভাবতই বাইডেনের শারীরিক সক্ষমতা, বয়স নিয়ে নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে। ট্রাম্পের সঙ্গে এর আগে টিভিতে প্রথম নির্বাচনী বিতর্কে শোচনীয় পরাজয়ের পরই বাইডেন ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে পারবেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিতর্কে বাইডেনের কাঁপা-কাঁপা গলা, বক্তব্যের খেই হারিয়ে ফেলা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয় ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেই। এমনকি প্রার্থী বদল করার প্রস্তাবও আসে। বাইডেনকে সরে যাওয়ার আহ্বানও আসে। প্রতিনিধি পরিষদের ২১৩ জন ডেমোক্র্যাট সদস্যের মধ্যে অন্তত ১৬ জন এবং সিনেটের ৫১ জন ডেমোক্র্যাট সদস্যের একজন প্রকাশ্যে তাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তবে ৮১ বছর বয়সী বাইডেন জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। তিনি নির্বাচনে লড়বেন এবং ট্রাম্পকে হারাবেন।

এবার বৃহস্পতিবারের ন্যাটো সংবাদ সম্মেলনের পর আরো বেশ কিছু ডেমোক্র্যাট বাইডেনকে নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বাইডেন এখনো অনড়। নিজেকে স্নায়বিকভাবে সুস্থ দাবি করে তিনি বলেন, তার কোনো মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। কারণ, তিনি যদি দুই বা সাতজন চিকিৎসকও দেখান তারপরও তার সমালোচকরা সন্তুষ্ট হবেন না। নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্পকে হারাতে পারবেন সেই আত্মবিশ্বাস আছে বলে আবারো জানান তিনি।

বাইডেন বলেন, স্টাফরা যদি তাকে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত দিতে পারে যে তিনি নির্বাচনে জিতবেন না, তাহলে তিনি সরে দাঁড়ানোর কথা ভাবতে পারেন। কিন্তু জরিপে এখনো তেমন আভাস পাওয়া যায়নি।

বাইডেনের পক্ষে ন্যাটো নেতারা : ন্যাটো সম্মেলনে অংশ নেয়া কোনো দেশের নেতাই অবশ্য বাইডেনকে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করায় বা তার সক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেননি।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, আমি হোয়াইট হাউসে নৈশভোজে বাইডেনের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছি। আমি সব সময়ই দায়িত্বশীল একজন প্রেসিডেন্টকে দেখেছি, যিনি বিভিন্ন বিষয়ে ভালোভাবে জানেন।

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজও একই সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, আমাদের সাধারণ জোটের নেতৃত্ব প্রমাণ করেছেন বাইডেন। জেলেনস্কিকে বাইডেনের ‘পুতিন’ বলে সম্বোধন করা নিয়েও কথা বলেন শলৎজ। তিনি বলেন, মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে যেতেই পারে, যদি আপনি সবার ওপর নজর রাখেন, আপনি অনেক কিছু খুঁজে পাবেন।

যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারও বাইডেনের পক্ষ নিয়েছেন। তিনি বলেন, বাইডেনের নেতৃত্ব নিয়ে যেসব অভিযোগ রয়েছে, তা ভুল। ওভাল অফিসে বাইডেনের সঙ্গে এক ঘণ্টার বেশি সময় আলোচনা হয়েছে। বাইডেন সবদিক দিয়েই যোগ্য আছেন।

পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদে, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার স্টাবও নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতার ক্ষেত্রে বাইডেন যথেষ্ট যোগ্য বলে মত দেন।

ন্যাটোর অনেক নেতাই চান না আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হোক। প্রকাশ্যে ন্যাটোর সমালোচক ট্রাম্পকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বোঝা বলে মনে করেন।

পুতিন-সিকে মোকাবিলায় প্রস্তুত : সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, বাইডেন যদি পুনর্নির্বাচিত হন, তাহলে আজ থেকে দুই বা তিন বছর পরে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মতো নেতাদের মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন কিনা। জবাবে বাইডেন বলেন, তিনি এখন তাদের (পুতিন-শি) মোকাবিলায় প্রস্তুত। আর এখন থেকে তিন বছর পরেও তাদের মোকাবিলায় তিনি প্রস্তুত।

বাইডেন বলেন, তিনি এখনই শিকে মোকাবিলা করছেন। শির সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগও আছে। তবে পুতিনের সঙ্গে এখন কথা বলার কোনো উপযুক্ত কারণ নেই। কারণ পুতিন তার আচরণে বদল আনার কোনো ইচ্ছা দেখাননি। বাইডেন দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, এমন কোনো বিশ্বনেতা নেই, যাকে মোকাবিলা করার জন্য তিনি প্রস্তুত নন।

গাজা যুদ্ধ বন্ধের সময় এসেছে : ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বাইডেন বলেন, এই যুদ্ধ শেষ করার সময় এসেছে। হামাস ও ইসরায়েল- উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন বলেও জানান তিনি।