অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক ও সমমানের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতির খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসিসি)। এর ফলে ২০২৬ সাল থেকে বর্তমান পদ্ধতিতে এই পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশ হবে না। গতকাল সোমবার দুপুরে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সভাপতিত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এনসিসিসির এক বৈঠকে এটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। গতকালের সভায় ২০২৬ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার মূল্যায়ন চূড়ান্ত হলেও ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির পরীক্ষাগুলোর মূল্যায়ন ঠিক হয়নি। চলতি জুলাই মাসে ষাণ¥াসিক মূল্যায়ন দেখে এই ৫ শ্রেণির মূল্যায়ন ঠিক করা হবে বলে বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

চূড়ান্ত অনুমোদনের ফলে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলে মার্কশিটে লেখা থাকবে ‘অনন্য’। একইভাবে ফলাফলে ধরণ অনুযায়ী নানা নামে আরো ৬টি ধাপ থাকবে। তবে এই সাত স্কেলকে আরো সহজে বোঝার জন্য নতুন ফলাফলে ইংরেজি বর্ণ যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ফলে ‘অনন্য’কে চিহ্নিত করা হবে ‘এ প্লাস’ দিয়ে। একইভাবে অন্যগুলোর ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যবহৃত বর্ণমালা দিয়ে চিহ্নিত করা হবে। নতুন পদ্ধতিতে সামষ্টিক মূল্যায়নের লিখিত অংশে থাকছে ৬৫ শতাংশ। আর কার্যক্রমভিত্তিক অংশে থাকছে ৩৫ শতাংশ নম্বর। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কার্যক্রম বলতে বোঝানো হচ্ছে অ্যাসাইনমেন্ট করা, উপস্থাপন, অনুসন্ধান, প্রদর্শন, সমস্যার সমাধান করা, পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রভৃতি। আরো সহজ করে বললে হাতে-কলমে কাজ। নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীকে ভালো ফলাফল করতে হলে স্কুলে ৭০ শতাংশ উপস্থিত থাকতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে। এ পরীক্ষার মূল্যায়নে নির্ধারিত পারদর্শিতা (নৈপুণ্য) অনুযায়ী সাতটি স্কেলের প্রস্তাব করেছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। যাতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকসহ সবাই শিক্ষার্থীর অবস্থান বুঝতে পারে। তবে এ স্কেলগুলো মানুষের কাছে আরো স্পষ্ট করার জন্য প্রচলিত গ্রেডও যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, সভায় পাবলিক পরীক্ষায় মূল্যায়ন কাঠামো চূড়ান্ত হয়েছে। শিগগিরই এর বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে। আর ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির মূল্যায়ন কাঠামো ষাণ¥াসিক মূল্যায়ন দেখার পর চূড়ান্ত করা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর) অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান এ প্রসঙ্গে বলেন, পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়নের সাত স্কেল সহজে বোঝার জন্য আক্ষরিক গ্রেড দিয়ে বিষয়টি উপস্থাপনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা কিন্তু নিউমেরিক গ্রেডিং নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাত স্কেলের সঙ্গে এ প্লাস, এ, বি, সি ইত্যাদি যুক্ত হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে এনসিটিবি প্রস্তাবিত সাতটি স্কেল ছিল- অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক। এখন নতুন মূল্যায়নে ‘অনন্য’কে এ প্লাস, ‘অর্জনমুখী’কে ‘এ’ গ্রেডের নাম দিয়েও ফলাফল প্রকাশ হতে পারে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা যেভাবে প্রস্তাব করেছিলাম, আগে যা যা ছিল, সেভাবেই থাকছে। ছোটোখাটো কিছু সংশোধনীসহ মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, সভায় প্রস্তাবিত কাঠামো, নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের

ক্ষেত্রে ৬৫ শতাংশ লিখিত এবং ৩৫ শতাংশ কার্যক্রমভিত্তিক থাকছে।

বৈঠক সূত্র জানায়, এনসিটিবির উপস্থাপিত পাবলিক পরীক্ষা মূল্যায়ন কাঠামোতে তেমন কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। শুধুমাত্র সাত স্কেলকে আরো সহজে বোঝার জন্য ইংরেজি বর্ণ যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর মাধ্যমিক স্তরের মূল্যায়ন কাঠামো চূড়ান্ত করার আগে ষাণ¥াসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের ফলাফল দেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা ও পারদর্শিতার পাশাপাশি আচরণগত দিক মূল্যায়নের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক মূল্যায়নের মতো এ মূল্যায়নেও সাতটি স্তর বা সূচক থাকবে। রিপোর্ট কার্ডে ‘আচরণিক ক্ষেত্র’ নামে আলাদা একটি ছক থাকবে। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে এই মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, ‘আচরণ’ বলতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর আচরণ, দলগত কাজে অংশগ্রহণ, আগ্রহ, সহযোগিতামূলক মনোভাব প্রভৃতি বিষয় বোঝানো হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরা শিখন কার্যক্রম চলার সময় এই আচরণগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন। এরপর আচরণিক নির্দেশকগুলোতে শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা নির্ধারিত হবে।

এনসিটিবির প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, আচরণিক নির্দেশকগুলোতে শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা বছরে দুবার শিক্ষকেরা ‘নৈপুণ্য অ্যাপ’-এর মাধ্যমে ইনপুট দেবেন। এর মধ্যে একবার ষাণ¥াসিক মূল্যায়নের সময়, আরেকবার বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সময়। এরপর শিক্ষার্থীর ১০টি বিষয়ের আচরণিক নির্দেশকের অর্জিত মাত্রা সমন্বয় করে চূড়ান্ত ট্রান্সক্রিপ্ট এবং রিপোর্ট কার্ড নৈপুণ্য অ্যাপের মাধ্যমে প্রণয়ন করা হবে। প্রসঙ্গত, গত বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। আর চলতি বছর বাস্তবায়ন করা হয় দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এরপর ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে এই শিক্ষাক্রম চালু হবে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে মোট ১০টি বিষয় রয়েছে। সেগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, ধর্মশিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি।

সাত স্কেলে মূল্যায়ন : প্রতিটি বিষয়ে নির্ধারিত পারদর্শিতার (নৈপুণ্য) ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর অর্জন সাতটি স্কেল বা সূচকে মূল্যায়নের পর রিপোর্ট কার্ডে প্রকাশ করা হবে। সাতটি স্কেলের জন্য থাকবে সাতটি ছক। এতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক- সবাই শিক্ষার্থীর অবস্থান বুঝতে পারবেন। সাতটি স্কেল হলো অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক। সর্বোচ্চ স্কেল ‘অনন্য’ বলতে বোঝানো হবে, শিক্ষার্থী সব বিষয়ে পারদর্শিতার চূড়ান্ত স্তর অর্জন করেছে। আর ‘প্রারম্ভিক’ স্তর হলো সবচেয়ে নিচের স্তর।

৬৫ শতাংশ লিখিত, কার্যভিত্তিক ৩৫ শতাংশ : প্রতি শ্রেণির (ষষ্ঠ থেকে দশম) লিখিত মূল্যায়নে ওয়েটেজ ৬৫ শতাংশ এবং কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়নে ৩৫ শতাংশ ওয়েটেজ থাকবে। এখানে কার্যক্রম বলতে বোঝানো হচ্ছে, অ্যাসাইনমেন্ট করা, উপস্থাপন, অনুসন্ধান, প্রদর্শন, সমস্যার সমাধান করা, পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রভৃতি। এর আগে অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কমিটি লিখিত মূল্যায়নের ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ আর কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়নের ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ রাখার সুপারিশ করেছিল। তবে গত ১৪ মে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সেটিতে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির মূল্যায়ন হবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, আর দশম শ্রেণি শেষে পাবলিক (এসএসসি) পরীক্ষা বা মূল্যায়ন শিক্ষা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি বিষয়ে ষাণ¥াসিক, বার্ষিক মূল্যায়ন এবং পাবলিক মূল্যায়নের নির্ধারিত সময়সীমা হবে এক কর্মদিবসে সর্বোচ্চ ৫ ঘণ্টা।

ক্লাসে ৭০ শতাংশ উপস্থিত থাকতে হবে : একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে ৭০ শতাংশ কর্মদিবস উপস্থিত না হলে পরবর্তী সময়ে শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে না বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে সব বিষয়ে শিক্ষকের সম্মিলিত আলোচনায় ছাড় দিতে পারবেন প্রধান শিক্ষক। দশম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্যও এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। একই সঙ্গে তিন বা তার বেশি বিষয়ে যদি কোনো শিক্ষার্থী বিকাশমান বা নিচের স্তরে থাকে, তাহলেও সে পরবর্তী সময়ে শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারবে না। তবে কোনো শিক্ষার্থী পরবর্তী সময়ে শ্রেণিতে উত্তরণের জন্য বিবেচিত না হলেও সব শিক্ষার্থী বছর শেষে পারদর্শিতার ভিত্তিতে ট্রান্সক্রিপ্ট পাবে। একই সঙ্গে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির রিপোর্ট কার্ডে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকের মতামত দেয়ার সুযোগ থাকবে। ষাণ¥াসিক ও বার্ষিক মূল্যায়নের জন্য খাতা এবং বিষয়ের চাহিদা অনুযায়ী পরীক্ষণ, মডেল তৈরি, নকশা, গ্রাফ প্রভৃতির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর দশম শ্রেণির পাঠ শেষে যে পাবলিক পরীক্ষা (এসএসসি) অনুষ্ঠিত হবে, তার উপকরণ সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাকেন্দ্রে থাকবে।